ভারতীয় মুসলিমদের সংকটকাল: নাগরিকত্ব, অর্থনীতি ও অধিকার

Spread the love

ভারতীয় মুসলিমদের সংকটকাল: নাগরিকত্ব, অর্থনীতি ও অধিকার

পাশারুল আলম

ভারতের সংবিধান তার প্রতিটি নাগরিককে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। সংবিধানের ১৪ ধারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে, “রাষ্ট্র ভারতের রাজ্যভুক্ত সকল ব্যক্তির প্রতি আইনের দৃষ্টিতে সমতা রক্ষা করবে,” এবং ১৫ ধারা বলে, “রাষ্ট্র ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ বা জন্মস্থান ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে বৈষম্য করবে না।” এই মৌলিক অধিকারগুলি ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনার মূল ভিত্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত রাজ্য ও কেন্দ্রে, এই সাংবিধানিক আদর্শগুলি ক্রমশ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নিপীড়ন, পুশব্যাক নীতি এবং অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই নিবন্ধে আমরা এই সংকটের বিভিন্ন দিক এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
১. পুশব্যাক নীতি: সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসম, পশ্চিমবঙ্গ, এবং উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোতে মুসলিম নাগরিকদের “অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করে পুশব্যাক করার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাজার হাজার মানুষ, যাদের অধিকাংশই মুসলিম, কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) অস্ত্রের মুখে তাদের সীমান্ত পার করতে বাধ্য করছে। এই পুশব্যাক নীতি শুধু ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ও ২১ ধারার (জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার) লঙ্ঘনই নয়, বরং ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের (ICCPR) সরাসরি পরিপন্থী।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে (যেমন, Maneka Gandhi v. Union of India, 1978) স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাকে ন্যায্য শুনানি ও পরিচয় প্রমাণের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এই “ডিটেনশন-ডিপোর্টেশন” প্রক্রিয়ায় কোনো “due process” মানা হচ্ছে না। ফলে, অনেক ভারতীয় মুসলিম নাগরিক, যাদের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড বা অন্যান্য নথি রয়েছে, তারাও এই অমানবিক নীতির শিকার হচ্ছেন।
২. পরিযায়ী মুসলিম শ্রমিকদের উপর সুসংহত নিপীড়ন
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে, বিশেষ করে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, এবং উত্তরপ্রদেশে, বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের লক্ষ্য করে একটি সুসংহত অভিযান চলছে। নির্মাণ শিল্প, হোটেল, রেস্তোরাঁ, গার্মেন্টস, এবং চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে “ভেরিফিকেশন” প্রক্রিয়ার নামে হয়রানি করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যাদের নাম বা ভাষা মুসলিম বলে মনে হয়, তাদের বিনা তদন্তে “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং কাজ থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে।
এই প্রক্রিয়া সংবিধানের ১৯(১)(ডি) ধারার সরাসরি লঙ্ঘন, যা প্রতিটি নাগরিককে ভারতের যেকোনো স্থানে চলাফেরা ও বসবাসের স্বাধীনতা প্রদান করে। এছাড়া, এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ ১৫ ধারারও পরিপন্থী, যা ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করে। এই নীতি শুধু অর্থনৈতিকভাবে মুসলিম শ্রমিকদের দুর্বল করে না, বরং তাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসও বটে।
৩. অর্থনৈতিক অবরোধ: মুসলিম সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নকরণ
মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানগুলো কেবল পুশব্যাক বা শ্রমিকদের হয়রানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ, যার লক্ষ্য মুসলিম সম্প্রদায়কে আর্থ-সামাজিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), ২০১৯: এই আইন আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, এবং পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি, এবং খ্রিস্টান অভিবাসীদের নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়, কিন্তু মুসলিমদের বাদ দেয়। এটি ভারতীয় আইনে প্রথমবারের মতো ধর্মীয় পরিচয়কে নাগরিকত্বের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC): অসমে NRC-এর একপাক্ষিক প্রয়োগে লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা, নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় নথি প্রমাণের জটিলতা এবং বৈষম্যমূলক প্রয়োগ মুসলিমদের অসহায় করে তুলছে।
ওয়াকফ বোর্ড ও মাদ্রাসার বাজেট কর্তন: বিভিন্ন রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা তদন্তের নামে হয়রানি এবং মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ কমানো মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলছে।
ব্যবসায়ীদের উপর হয়রানি: মুসলিম ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে হঠাৎ কর ফাইলিং, এনআইএ তদন্ত, বা দোকান-হোটেলে অতিরিক্ত নিয়মকানুন আরোপের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই সব পদক্ষেপের সম্মিলিত প্রভাব মুসলিম সম্প্রদায়কে আর্থিকভাবে দুর্বল করে তাদের সামাজিক নির্বাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
৪. মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের উদ্বেগ
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন Amnesty International ও Human Rights Watch বারবার সতর্ক করেছে যে, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। Amnesty International-এর ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “মুসলিম সম্প্রদায় অস্পষ্ট প্রশাসনিক ক্ষমতার অধীনে নির্বিচারে আটক, বাড়িঘর ধ্বংস, এবং বাস্তুচ্যুতির শিকার হচ্ছে, যার জন্য কোনো ন্যায্য আইনি প্রতিকার নেই।”
এছাড়া, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও CAA এবং NRC-এর বৈষম্যমূলক প্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এই আইনগুলো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই নীতিগুলো শুধু ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বিরোধী নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডেরও লঙ্ঘন করে।
৫. প্রতিরোধের কৌশল: ঐক্য, সংবিধান ও সচেতনতা
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দলিত, আদিবাসী, এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই পারে এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ফল আনতে। কিছু সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে:
যৌথ বিবৃতি ও সাংবাদিক সম্মেলন: মুসলিম, দলিত, এবং প্রগতিশীল অমুসলিম সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ এবং সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের নীতির সমালোচনা করা যেতে পারে।
মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে পুশব্যাক, হয়রানি, এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের ঘটনাগুলোর তদন্তের জন্য আবেদন করা যেতে পারে।
আইনি সহায়তা কেন্দ্র: পুশব্যাক ও হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিনামূল্যে আইনি সহায়তা কেন্দ্র খোলা, যাতে তারা তাদের নাগরিকত্ব ও অধিকার প্রমাণ করতে পারে।
অমুসলিম নেতাদের সম্পৃক্ততা: প্রভাবশালী অমুসলিম ব্যক্তিত্ব, যেমন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, এবং সমাজকর্মীদের এই প্রতিবাদে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার করা।
গণআন্দোলন ও সচেতনতা: সামাজিক মাধ্যম, র‍্যালি, এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।
পরিশেষে বলা যায় গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি হুমকি হিসেবে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের বিরুদ্ধে চলমান এই নিপীড়নমূলক নীতি কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংবিধানের মূল ভিত্তির উপর আঘাত। যখন রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মীয় বিভাজনের পথে এগোয়, তখন নাগরিক সমাজের দায়িত্ব হয়ে পড়ে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সময় এসেছে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির একযোগে কাজ করার। এই সংকটকালে নীরবতা নয়, সোচ্চার প্রতিবাদই হবে ভারতের গণতন্ত্র রক্ষার পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *