———-কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের শেষ দিনগুলি ও
পুত্র বধূ উমা কাজী
প্রতিবেদন . শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন বাংলা:- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সেবিকার যত্নে, মায়ের স্নেহে আগলে রেখেছিলেন যিনি, তিনি উমা কাজী। এই ব্রাহ্মণ-কন্যাটি ছিলেন কবির পুত্র কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী, বিদ্রোহী কবি নজরুলের পুত্রবধূ।
“যেখানেতে দেখি যাহা;
মা-এর মতন আহা।
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনোখানে কেহ পাইবে, ভাই !”
কাজী নজরুল ইসলাম নিজের “মা”বাদেও আর একজন নারীর মধ্যে নিজের মাকে খোঁজে পেয়েছিলেন ! যে নারী সন্তানের মতো নির্বাক ও প্রায় স্মৃতিশক্তিহীন কবি নজরুলকে মায়ের ভালোবাসায় আবদ্ধ রেখেছিলেন। আর স্নেহ-মায়া, ভালোবাসায় দিয়ে, যে সমস্ত রকম ভেদাভেদ দূর করা যায়, তার উদাহরণ উমা কাজী এই মানুষটি!
কাজী নজরুল-এর বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী, অর্থাৎ নজরুলের পুত্রবধূ।
আসলে, তিনি ছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। হিন্দু ও ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা হয়েও মুসলিম পরিবারের পুত্রবধূ হয়েছিলেন ! সেই অনেক বছর আগে। উমার বাবা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং মা বাদলা মুখোপাধ্যায়। তার জন্ম বর্ধমানের কাটোয়া অঞ্চলে।
লেখাপড়া শেষ করে কলকাতার ‘লেডি ডাফরিন মেডিকেল হাসপাতাল’ থেকে ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়েছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। থাকতেন সেখানকার নার্সিং হোস্টেলেই। ছোটকাল, থেকেই সেবিকা হতে চাইতেন তিনি। সেখানকারই এক হেড নার্স ঊষা দিদি, উমাকে এক নতুন পথের দিশা দেখান। উমাকে তিনি নিয়ে যান অসুস্থ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়ীতে। কবির সেবা করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক নার্সের। নির্বাক কবি তখন কলকাতার মানিকতলায় থাকতেন। নানা অসুস্থতায় জর্জরিত হলেও, দুই বাংলাতেই সমান্তরারালে তখন কবিকে নিয়ে কোনো অংশে উন্মাদনা কম নয়!
এমনই সময়ে কবির মাথার কাছে গিয়ে বসলেন তরুণী উমা। নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবী বলেছিলেন, “তুমি কি পারবে ‘মা’ কবির সেবা করতে ? ঐ যে দ্যাখো, উঁনি খবরের কাগজ ছিঁড়ছেন। উঁনি এখন শিশুর মতো।” এ প্রশ্নের উত্তরে উমা বলেছিলেন, “আমরা তো কলকাতার হাসপাতালে শিশু বিভাগেই ডিউটি করেছি। কবি যদি শিশুর মতো হন, তবে নিশ্চয়ই পারবো।”
সেবা ও স্নেহের পথ পরিক্রমায় উমাই হয়ে উঠলেন কবি নজরুলের প্রিয় মানুষ। তাঁকে স্নান করানো, খাওয়ানো, দেখ-ভাল করা, গল্প শোনানো। উমার হাতের স্পর্শ যেন কবির কাছে মায়ের আঁচলের মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে উমার সেবার মনোবৃত্তি দেখে, মিষ্টি ব্যবহার দেখে কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী,উমার প্রেমে পড়ে গেলেন । উমাও সব্যসাচীকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেললেন।
বিয়ে হল ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের। সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখে, উমা মুসলিম পরিবারকে আপন করে নিলেন। মুসলিম ধর্মান্তরে উমা মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন, উমা কাজী। কবি ও কবিপত্নী প্রমীলা নজরুলও এমন এক মেয়েকে ঘরের বৌমা হিসেবে পেয়ে খুশি হলেন। উমা মুসলিম পদবী গ্রহণ করলেও, তাঁর নামে থেকে গেল দুর্গা’র চিহ্ন।
শাশুড়ি প্রমীলাদেবী উমা বৌমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। এদিকে কবি নিজেও বৌমা অন্তঃপ্রাণ। বৌমা চন্দন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে না দিলে স্নান করবেন না নজরুল, দাঁড়ি বৌমাই কেটে দেবে, খাইয়ে দেবে বৌমা। আদরের বৌমার কাছে শিশুর মতো আবদার বায়না করতেন কবি। এমনকি পরিধেয় জামাকাপড়ে নীল বোতলের আতর-সুগন্ধিও বৌমাকেই লাগিয়ে দিতে হবে।
উমা একদিকে নিজের নতুন সংসার সামলাচ্ছেন আর অন্যদিকে কবিকেও সামলাচ্ছেন। ধীরে ধীরে এল সব্যসাচী-উমার ঘরে তিন সন্তান,
– মিষ্টি কাজী,
– খিলখিল কাজী এবং
– বাবুল কাজী। তিন নাতি-নাতনি দাদা নজরুলের কাছেই থাকত বেশি সময়। কবিও তো শিশুর মতোই। সন্তানদের সঙ্গেই কবিকেও আসন পেতে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিতেন উমা কাজী।
পরবর্তীতে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সুস্থ করতে দুটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়, যে বোর্ডের সদস্যদের কবির সমস্যাগুলি বুঝিয়ে দিতে যেতেন, উমা নিজেই । কিভাবে কবির স্মৃতিশক্তি ফেরানো যাবে, কথা বলানো যাবে, এ সব ভাল করে শুনে সেবার ধরণও বুঝে নিতেন উমা। পাশাপাশি স্বামীর খেয়াল রাখা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, সবটাই দেখতেন উমা কাজী।
এরি মধ্যে কবিপত্নী প্রমীলা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শাশুড়ির সব দেখভালের দায়িত্বও নিলেন উমা কাজীই। কবির আগেই চলে গেলেন কবিপত্নী। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সংসার জীবনের পর, ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রমীলা কাজী। তাঁকে কলকাতা থেকে চুরুলিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাজী পাহালোয়ানের দরগার পাশে কবিপত্নীকে সমাহিত করা হয়।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর উদ্যোগে স্বপরিবারে কবিকে বাংলাদেশে আনা হয়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডে (বর্তমান নজরুল ইনস্টিটিউট সংলগ্ন) কবি ভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন। কাজী সব্যসাচী কর্মসূত্রে কলকাতায় থেকে গেলেও উমা কাজী কবিকে দেখার জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ধানমণ্ডির বাড়িতে নজরুল নাতি-নাতনি নিয়ে খেলা করতেন, বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।
কবির জন্মদিন পালন হতো বেশ বড় করে। অতিথিরা আসতেন, কবিকে সবাই মালা পরাতেন । কবি সেইসব মালা পরে খিলখিল করে হাসতেন। হারমোনিয়াম দেখিয়ে সবাইকে বলতেন গান করতে। নাতি-নাতনিরাও নজরুল সঙ্গীত গাইতেন। নির্বাক কবিই কখনও হেসে উঠতেন আবার কখনও নির্বাক হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে যেতেন। একটার পর একটা নিজের সৃষ্টি শুনে। সব যন্ত্রণা যেন গানে গানে ঝরে পড়ত কবির চোখের জলে।
জীবনের শেষ দিকে বিছানাতে স্থায়ী ঠিকানা হলো কবির। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতেন উমা। তিনি যে সেবিকা থেকে ততদিনে তিনি যে কবির ‘মা’ হয়ে গিয়েছিলেন ! তাই, তো এত কিছুর মধ্যেও এতটুকু ফাঁক-ফোঁকর পড়েনি! ছেলে-মেয়েদেরকে বড় করার বা শাশুড়ির অবর্তমানে সমগ্র সংসার সামলানোর বা কাজী সব্যসাচীর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠার।
২৯ আগস্ট ১৯৭৬ ইং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল প্রয়াত হন। চির বিদায়ের শেষ সজ্জায় কবিকে সাজিয়েও দিয়েছেন উমা কাজী। তিন বছর পরে ১৯৭৯ সালের ২ মার্চ কলকাতায় মারা যান আবৃত্তিকার স্বামী কাজী সব্যসাচী। অকালেই চলে যান অসুখে। ফলে আরও কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে উমার কাঁধের উপর। তখন ম্লান হয়ে আসছে কাজী পরিবারের যশ-খ্যাতি। একা হাতে বিখ্যাত কবি পরিবারকে কঠিন লড়াইয়ের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেন উমা। তিনি না থাকলে কাজী পরিবার আজ খ্যাতি আর পরিচিতির জায়গাটা হয়তো ধরেই রাখত পারতো না। বিখ্যাত পরিবারে বিখ্যাত সদস্যদের পেছনে কাণ্ডারীর মতো শক্তির উৎস হয়ে উঠেছিলেন এই উমা মুখোপাধ্যায় তথা উমা কাজী।
উমা নিজেই যখন দাদী-নানী হলেন, তখন তিনিও কবির মতই তাঁর নাতি-নাতনিদের গল্প বলতেন। কাজী নজরুল, প্রমীলাদেবী, কাজী সব্যসাচী সকলের কথা তিনি বলতেন নাতি-নাতনিদের। তারাও কাজী নজরুলকে ছুঁতে পারত উমার গল্পে। উমা জানতেন, উত্তরাধিকারী নবীন প্রজন্মকে কবির কাজে আগ্রহী করলে কবির কাজ বেঁচে থাকবে, আরও এগুবে তাঁর সৃষ্টি। উমা যেন সারাজীবন কবির সেবিকা ও সাধিকা হয়ে রইলেন। এইভাবেই ৮০টি বসন্ত পেরিয়ে প্রয়াত হলেন উমা কাজী। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আর শেষ দিকে স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছিলেন, কবির মতোই। ১৫ জানুয়ারি ২০২০ইং সালে ঢাকার বনানীতে ‘কবি ভবন’-এ প্রয়াত হন ভালোবাসার মনুষ্যত্ব ও সেবার ধর্ম সারাজীবন ধরে পালন করা মানুষ উমা কাজী। বনানীতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
কাজী বংশের এই শ্রেষ্ঠ “মা”কে বর্ণনা করা যায় নজরুলের কবিতা দিয়েই !
“হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরাণ,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আবদার দিন-রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।”
লেখকঃ শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়,
(সংগৃহীত)