বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে ঘিরে বিজেপি’র সাম্প্রতিক কৌশল

Spread the love

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে ঘিরে বিজেপি’র সাম্প্রতিক কৌশল

গৌতম রায়

আগামী তিরিশে সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাক্রম নিয়ে রায় দিতে চলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। এই বিষয়টি ঘিরে এখনো রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তেমন কিছু শোরগোল না পড়লেও, আশঙ্কা হয় যে, আগামী কয়েকদিনের ভিতরেই এই রায়দানের বিষয়টিকে ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির জলঘোলা করতে শুরু করবে। কারণ, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাক্রম এবং ষড়যন্ত্রের দায় যদি লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার প্রমুখ বিজেপি নেতৃত্বের বিপক্ষে যায়, তার ফসল ঘরে তুলে, তথাকথিত রামমন্দিরের ভিত পুজোর পরেও যে উগ্র হিন্দুত্বকে চাগিয়ে দিতে পারল না আরএসএস, বিজেপি – সেটাকে এই মামলার রায়কে ঘিরে চাগিয়ে দেওয়া সম্ভবপর হবে।

আর যদি এই মামলার রায়, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত মামলার রায়ের আদলে হয়, যাতে আদবানি, যোশী, উমা ভারতীর মতো বিজেপি নেতা, নেত্রীদের ক্লিন চিট দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভিন্ন মাত্রায়, মামলার রায়কে নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এতোটুকু সময় নষ্ট করবে না হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির। বস্তুত, এই মামলার রায় আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম ইত্যাদির মতো, সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলির পক্ষেই যাক, আর বিপক্ষেই যাক, গোটা পরিস্থিতিকে নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, একটা ধর্মান্ধ আবরণের ভিতর দিয়ে চরমভাবে ব্যবহার করা হবে।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাস করেন, ভারতের এমন মানুষদের একটা বড়ো অংশই আগামী তিরিশে সেপ্টেম্বরের রায় ঘিরে তেমন একটা আশাবাদী নন। দেশভাগের পর, ভারতে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো, সবথেকে বড়ো সংগঠিত অপরাধ, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস। তৎকালীন সময়ে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের নেতৃত্বাধীন পি ভি নরসিংহ রাও-এর সরকার যদি আন্তরিক হতো, তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ভয়ঙ্করভাবে পরিকল্পনা করে ঘটানো অপরাধ, এই মসজিদ ধ্বংসকে এড়ানো যেতো। উত্তরপ্রদেশে সেই সময়ে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি নেতা কল্যাণ সিং-এর নেতৃত্বাধীন সরকার। এই সরকার যে প্রত্যক্ষভাবে তাদের দলের শীর্ষনেতা আদবানি, যোশী প্রমুখের উপস্থিতিতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সবরকমের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, কেন্দ্রের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সেই খবর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও জানতেন না, সেই সময়ের গৃহমন্ত্রী জানতেন না, কেন্দ্রে সবথেকে প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি জানতেন না – রাজনীতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা থাকা একটি শিশুও তা বিশ্বাস করে না।

সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি’র মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং,মসজিদ রক্ষার সংকল্প ঘিরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, খোদ সুপ্রিম কোর্টকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও কেন নিজের গোয়েন্দাদের সতর্কবার্তা, আরএসএস-বিজেপি বাবরি মসজিদ ভাঙতে বদ্ধপরিকর এটা বিশ্বাস না করে, সুপ্রিম কোর্টে কল্যাণ সিং-এর দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করেছিলেন, এটা একটা গভীর প্রশ্নের বিষয়। রাও মন্ত্রীসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঘিরে তখন একটা বড়ো সংশয় ছিল।নিজের সংখ্যালঘু মন্ত্রীসভাকে টিকিয়ে রাখতে বিজেপি’র সঙ্গে কোনো গোপন বোঝাপড়া নরসিংহ রাও করেছিলেন কি না, এই প্রশ্নের হয়তো কোনোদিনই সুরাহা হবে না। কিন্তু নিজের সরকার বাঁচাতে বাবরি মসজিদকে, তথা দেশের সুমহান ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে কি বলি দিয়েছিলেন রাও? এই সন্দেহ তাঁকে ঘিরে চিরদিন থেকেই যাবে।সেই সঙ্গেই ’৯২-এর ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যে পর্যন্ত অযোধ্যায় উপস্থিত থেকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে চরম উসকানি দেওয়া বাজপেয়ীকে কেন মসজিদ ধ্বংসের দিন অযোধ্যার ত্রিসীমানায় দেখতে পাওয়া গেল না? এটাও একটা জোরদার প্রশ্ন। পরবর্তীতে সংসদে চাপের বিতর্ক হলেই প্রমোদ মহাজনের সঙ্গে যেভাবে বেশ কিছু সময়ের জন্যে অদৃশ্য হয়ে যেতেন বাজপেয়ী, আবার কিছুটা সময় পর ফিরে এসে,স্বভাবসুলভ কবিত্বের ভঙ্গি ভুলে গিয়ে নিম্নমানের আক্রমণে মেতে উঠতেন সংসদে, বিষয়টি কি তেমন কিছু হয়েছিল?

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে পরিচালনা করবার ক্ষেত্রে কি নরসিংহ রাও, এইচ ডি দেবেগৌড়া, ইন্দ্র কুমার গুজরাল, দুই দফায় ডঃ মনমোহন সিং-এর সরকার যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিল? অটলবিহারীর সরকার সেই ভূমিকা পালন করবেই না, তাই তাঁর সরকারের এই প্রশ্নে ভূমিকা ঘিরে আলোচনা নিরর্থক। মোদীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর মোদীর আমলে আদালতের ভূমিকা ঘিরে যে প্রশ্ন ক্রমশ উঠতে শুরু করেছে, বিশেষ করে, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমি যেভাবে নিছক বিশ্বাসের জোরে, মসজিদের ভিতরে জোর করে রেখে যাওয়া একটি ধাতুমূর্তির জমি বলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, তাতে এইসময়কে ঘিরে ন্যায়সঙ্গত কিছু বিধিবিধান আদালতের কাছ থেকে পাওয়া যাবেই না, এটা বেশিরভাগ ভারতবাসীর বিশ্বাস।

নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালের দস্তুর হিসেবে বিচার বিভাগের ভূমিকা এখন একটি বিতর্কিত পর্যায়। এই অবস্থাতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত মামলাতে, যারা মসজিদ ধ্বংসের প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, কিংবা মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা আদৌ কোনো শাস্তি পাবেন কি না, সে সম্পর্কে দেশবাসীর ভিতরে তৈরি হয়েছে গভীর সংশয়। বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখার পর, মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় যুক্ত আরএসএস, বিজেপি নেতারা আদৌ কোনো শাস্তি পাবেন, এটা ভারতের কোনো যুক্তিবাদী মানুষই এখন আর বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। হিন্দুত্ববাদী যেসব নেতা মসজিদ ধ্বংসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের অপকর্মের বহু সাক্ষ্য প্রমাণ পুলিশ সংগ্রহ করেছে।উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কিভাবে মসজিদ ভাঙার কাজে মদত জুগিয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পদচ্যুত হয়ে, কলকাতায় এক দলীয় সভাতে বলেছিলেন। সেই স্বীকারোক্তির বয়ান পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ভিডিও চিত্রে ধারণ করেছিল। জ্যোতিবাবু সেই ভিডিও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিষয়টি ঘিরে তদন্তকারী লিবেরাহান কমিশনে সাক্ষ্যদান কালে,সেই ভিডিও ক্যাসেটটি বিচারপতি লিবেরাহানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই ভিডিও ক্যাসেটের কথা বিচারপতি লিবেরাহান, তাঁর দীর্ঘ রিপোর্টে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। সেই ক্যাসেটটি পরবর্তীতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে দাখিলও করা হয়েছে। কিন্তু এইসব সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ গভীরভাবে সন্দিহান। তাঁদের প্রশ্ন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত আসল লোকজন শাস্তি পাবে তো?

কোভিড ১৯-জনিত পরিস্থিতিতে যে অপরিকল্পিত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে, তার জেরে গোটা দেশে সবদিক থেকে একটা ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। অপরিকল্পিত লক ডাউনের জেরে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সঙ্কটকে তীব্রতর করে তুলেছে ছাঁটাই, বেকারি। অতীতে ছাঁটাইয়ের প্রশ্নে খাড়াটা সবথেকে বেশি নেমে আসত নিচু তলার কর্মীদের উপর। কোভিড-১৯-কে কেন্দ্র করে শাসকের অপদার্থতার জেরে এখন সব অংশের কর্মীরাই ছাঁটাইয়ের শিকার। বেসরকারিস্তরে উচ্চপদস্থ কর্মীদেরও একটা বড়ো অংশ এখন কর্মহীন। উচ্চবিত্তের একটা বড়ো অংশ এই করোনাকালে অতি দ্রুত মধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছেন। যদিও সরকারের নীতির ফলেই আদানি, আম্বানিদের মতো কতিপয় উচ্চতরও নয়, উচ্চতম বিত্তের মানুষদের এই করোনাকালের দৌলতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।

এই যে গোটা দেশব্যাপী গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট, যা ক্রমশ অর্থনীতির পরিবৃত্তকে ছাপিয়ে একটা বড়ো রকমের সামাজিক সঙ্কটের আবর্ত রচনা করেছে, গোটা পরিস্থিতিকে অন্যখাতে বইয়ে দিয়ে, মানুষকে তাঁদের জীবন-জীবিকার নিত্যকালের সমস্যাকে ভুলিয়ে দিতে কি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ব্যবহারের কৌশল করছে শাসক বিজেপি? একটা বড়ো অংশের মানুষের ভিতরে এমন একটা আশঙ্কার পরিবেশ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে যে, ক্রমবর্ধমান আর্থিক সঙ্কট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে, আদবানি, যোশী, উমার মতো প্রবীণ নেতৃত্বকে ব্যবহারের কৌশল কি নিতে চলেছে আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র বর্তমান নেতৃত্ব?

সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত রায় দেওয়ার পর, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেই রায় কার্যকর করতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর তথাকথিত রামমন্দিরের শিলান্যাস করেছেন এমন একজন মানুষ, যিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়ে এই মুহূর্তে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন রয়েছেন। এ হেন ‘হিন্দুত্বে’র পোস্টারবয়কে দিয়ে মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর মন্দিরের শিলান্যাস করিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পর্যবসিত করতে পেরেছে সঙ্ঘ, বিজেপি সহ গোটা সঙ্ঘ পরিবার। তবু এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে, কোভিড ১৯-জনিত অর্থনৈতিক, সামাজিক মন্দাকে অন্যখাতে তারা পরিচালিত করতে সফল হয়নি। হিন্দুত্বের ভয়াবহ উন্মাদনায় দেশকে মাতাল করে, ভোট রাজনীতির খেলায় নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র সাফল্য এনে দেওয়াই হলো আরএসএস’র একমাত্র লক্ষ্য। সেই দিকে দৃষ্টি দিয়েই তারা গোটা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রক্রিয়াটিকে পরিচালনা করেছে। সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর মন্দিরের ভিত স্থাপনের মতো মানবতার চরম অবমাননাকর কাজ করবার পর, এখন আর সেই বিষয়টিকে অবলম্বন করে ভোট রাজনীতির ডিভিডেন্ড আরএসএস নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র অ্যাকাউন্টে এনে দিতে পারছে না। ফলে ধর্মভিত্তিক উন্মাদনাকে অন্যখাতে চাগিয়ে, ভোট রাজনীতির সাফল্যকে বিজেপি’র ঘরে তোলার নতুন ধরনের চেষ্টা যে তারা সুপ্রিম কোর্টের বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত রায়, যাই হোক না কেন, সেই রায়কে ব্যবহার করে নিজেদের ঘরে তুলবে, এই আশঙ্কা থেকেই যায়।

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ধর্মীয় উন্মাদনার পারদ একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির করবে – এই ভয়ঙ্কর আশঙ্কা কখনোই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভয়াবহ অপদার্থতা, বিশেষ করে কোভিড ১৯-কে ঘিরে স্বাস্থ্যজনিত সঙ্কট, তীব্র বেকারি, ছাঁটাই, কর্মহীনতা, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি – এইসব ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কটের নতুন আবর্ত নির্মাণ করছে, যার জেরে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষিতও জোরদারভাবে সংক্রমিত, এইসব বিষয়গুলি যাতে সাধারণ মানুষকে বিজেপি’র প্রতি ক্ষুব্ধ করে না তোলে, সেই উদ্দেশেই আদালতের রায়কে ধর্মীয় বিদ্বেষকে নতুন করে লাগামহীন করে তুলতে ব্যবহার করা হবে। সাধারণ মানুষ যাতে প্রশ্ন না করেন কেন এতো ছাঁটাই,সে জন্যেই আদবানি, যোশীদের মতো প্রবীণ নেতাদের, ‘রামে’র নামে ‘বলি’ দিতে পিছপা নাও হতে পারেন মোদী, অমিত শাহ’রা। ‘রামে’র জন্মভূমি ‘শত্রু’র হাত থেকে উদ্ধার করতে প্রবীণ আদবানিকে এই বৃদ্ধ বয়সে কতো কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে – এইধরনের ভাবাবেগকে চাগিয়ে দিয়ে নতুন করে আট, নয়ের দশকের ধাঁচে ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টাতে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের মেতে ওঠার আশঙ্কাকে কোনো অবস্থাতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিজেপি গত ছয় বছরের বেশি সময় দেশের সরকার পরিচালনা করছে। এই দীর্ঘসময়কালে তারা তাদের দলের স্বার্থ, হিন্দুত্বকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে রূপান্তরিত করবার উদ্দেশের বাইরে ন্যূনতম একটি পদক্ষেপও নেয় নি। দেশের জিডিপি’র সাম্প্রতিক রেকর্ড নিম্নগতিই প্রমাণ করছে, দেশকে কোন্‌ ধ্বংসের পথে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা ধারাবাহিক ভাবে টেনে নামিয়েছে। জাতীয়, আন্তর্জাতিকস্তরে অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক, সবক্ষেত্রেই দেশের সম্মান, মর্যাদাকে টেনে নিচে নামিয়েছে বিজেপি। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অহেতুক নষ্ট হয়েই চলেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ভ্রান্ত, অপরিণত দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে। একটি উদাহরণ এই প্রসঙ্গে রাখা যেতে পারে।

ভারতে যথেষ্ট ভালো পেঁয়াজ উৎপাদিত হলেও, ফড়েদের দল বিজেপি’র বদান্যতায়, মধ্যসত্ত্বভোগী দালালদের হাতযশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রক এই ফড়েরাই। ফলে কৃষক ফসলের দাম পায় না। দেশের বাজারে পিঁয়াজের উৎপাদন খুব ভালো থাকা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যেই পেঁয়াজের দাম কিলো প্রতি একশো টাকাও ছাপিয়ে যায়। কি কেন্দ্র, কি রাজ্য – কোনো সরকারই বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অথচ, উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পায় না কৃষক। ফলে ক্রমেই বাড়ছে ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা। কৃষি সংস্কারের নামে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে বাজার অর্থনীতির হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। আর কৃষকের আয়কে আরও সঙ্কুচিত করতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে, পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ পর্যন্ত করছে ভারত সরকার। ফলে সেই দেশে ইসলামীয় মৌলবাদীদের পক্ষে ভারত বিরোধিতা এবং বিদ্বেষ ছড়ানোটা অনেক সহজ হচ্ছে।

এইসব পর্যায়ক্রমকে কাজে লাগাতেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নিজেদের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে বিজেপি। ধর্মকেন্দ্রিক উন্মাদনাকে আশ্রয় করে উন্মত্ততার ভিতর দিয়ে, দেশের ক্রমবর্ধমান নানা সঙ্কট ঘিরে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেই এখন নিজেরা বাঁচতে চাইছে বিজেপি।

সৌজন্য :- দেশ হৈতেষী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.