**বন্দি ভারতবাসী**
আর মাত্র কয়েকদিন। আমাদের জাতীয় নির্বাচন। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত। ভোট দেবেন প্রায় নব্বই কোটি ভোটার। ভোটাররা ঠিক করে দেবেন আগামী পাঁচ বছর আমরা কাদের গোলামী করবো।
প্রথমেই বলে রাখি, আজকাল আমি বহু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগি। সঠিক-বেঠিক সব যেন গুলিয়ে ফেলি। উঁকি দেওয়া প্রশ্নের সমাধান আজ আর করতে পারিনা। মানে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। যাকে সহজ সরল বাংলা ভাষায় ব্রেন হ্যাং হওয়া বলে। সম্ভবত এটা আমার আলস্য মস্তিষ্কের অবসাদ।
এই যেমন,গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে যারা সাধারণ ভোটারদের ভোট দিতে দিলোনা, বহু জায়গায় প্রার্থীও দিতে দিলোনা। এবার তারাই যেন ভোট ময়দানে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী। বুঝে উঠতে পারিনি, সেদিন কেন তারা ভোট দিতে দিলোনা ? আর আজ কোনো তারা এতো ভোটের কাঙ্গাল? এসব ভাবতে গেলে মস্তিষ্কের জড়তা গ্রাস করে। তখনই ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
আবার, যখন দেখি কোনো নেতা আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, যার বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ, যার জন্য গণ আন্দোলন, রাজপথ সরগরম, সাধারণ মানুষ সোচ্চার, মিনি নবান্নে (চায়ের দোকানে) তুমুল ঝড়। সে ঝড়ো হওয়ার দোলাচলে রাতের আলোআধারীতে কোনো একদিন হয়তো তিনি দল পরিবর্তন করলেন। রাজপথে দাঁড়িয়ে চিল্লানো লোকগুলোর কাছে যিনি ছিলেন জোচ্চোর, দুর্নীতিবাজ; রাতারাতি দল পরিবর্তনে তিনিই হয়ে গেলেন তাদের কাছে আদর্শিক নেতা এবং পরশপাথর। প্রশাসনও ঐ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার টিকি ও ছুঁইতে পারেনা। কারণ, তাদের আছে ক্ষমতা নামক একপ্রকার রক্ষাকবচ। এসব ঘটনা বুঝতে চাইলেই আমার ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
চৌত্রিশ বছরে বাংলায় যাদের হাজারে হাজার কর্মী খুন হলো, স্বার্থের তাগিদেই আজ তাদের সাথে জোট-ভোট খেলা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাই। জোট যখন ঘোট পেঁকে যায়, তখন একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। আবার উভয়েই কিছু আসনে প্রার্থী না দিয়ে গোপন অভিসারে মেতে ওঠে, তখন বিবেককে বলি চুপ করে যা, ওসব তুই বুঝবি না। তখনই ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
হতবাক হয়ে যাই, যখন দেখি চিরন্তন দ্বন্দ্বের প্রতীক সাইকেলে চড়ে হাতিকে ঘুরতে। আবার, কখনো দেখি আজ যিনি এনডিএ-তে, তো কাল তিনি ইউপিএ -তে আবার কখনো দেখি ফেডারেলে। ভাবি, হচ্ছেটা কি? আজ যিনি ‘মা”, কাল তিনি মাসি। আজ যিনি তাজা কাল তিনি বাসি। আজ যিনি আপন কাল তিনি খাসি। আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা কে যে কখন কার? তখনই ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
কখনো দেখি ভোটের ময়দানে অ, আ, ক,খ জ্ঞান নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নেই তার জনপ্রতিনিধি হবার যোগ্যতা। কিন্তু তার হয়তো! আছে, নাচন-কুদন করার অভ্যাস, আর আছে অযাচিত অর্থ। সেটাতেই ভর করে দাদা-দিদির আশীর্বাদধন্য হয়ে হয়তো তিনি হয়ে গেলেন জনপ্রতিনিধি। বুঝতে পারিনা তাঁরা রাজপ্রতিনিধি হয়ে জাতির জন্য কি করবেন? জাতিকে তারা কি উপহার দেবেন? আবার এটাও ভাবি চোর, ধর্ষক, প্রতারক, দাঙ্গাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা যদি ভোটে দাঁড়িয়ে জিততে পারে, তাহলে এদেরই বা দোষ কোথায় ? আবার, সংসদ আর বিধানসভাতে যখন চেয়ার ছোড়াছুড়ি আর হাতাহাতি করতে দেখি। তখন ভাবি ইনারাই কি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধানের পাহারাদার? আর এরাই কি আব্রাহাম লিংকনের উত্তম উত্তরসূরি? এসব ভাবতে গেলে ব্রেনের অসারতা চলে আসে। তখনই ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
যখন দেখি এক নেতা অন্য নেতার বিরুদ্ধে, একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে যাবতীয় শালীনতাবোধ উপেক্ষা করে বিষোদগার করে। তির্যক বাক্যবানে ঘায়েল করে, অকথা-কুকথার রাশি রাশি ফেনা তোলে। এমনকি বাপান্ত করে গালিগুলুজ করে, তাদের সে কুরুচিকর শব্দবন্দে অপভাষার প্লাবনপঙ্কে তীব্র স্রোতের ঢেউয়ে সুবাস-সুভাষ অতলতলে তলিয়ে যায়। কিন্তু, আবার যখন বিরুদ্ধবাদী কোনো নেতা সামান্য মশার কামড়ে যদি অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে মহা ধুমধামে মহা-মায়া সহকারে ফুলের গুচ্ছতোড়া নিয়ে করজোড়ে সুস্বাস্থ্য ও শুভকামনাও করে। তখনই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবি, এ মঞ্চস্থ নাটকের যবনিকা কোথায়? এসব নিরুত্তরের উত্তর পেতে কেন জানি ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
দুঃখ লাগে যখন দেখি নেতারা ক্ষমতা দখলের জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বন্যা ঝরায়। কখনো একাউন্টে পনের লক্ষ টাকা, দু’কোটি চাকরি, তো কখনো গরিবের মাসে নূন্যতম ছ’হাজার। এসব প্রতিশ্রুতিতে জনগণ এদের মসিহা ভেবে ভোট দেয়। কিন্তু, একদিন এসব কথা জুমলায় পরিণত হয়। তখন ভাবি জাতীয় নেতারা যদি মিথ্যাবাদী হয়, তাহলে অধীনস্থদের দোষ কোথায়? তাছাড়া, যখন নেতাদের বক্তব্য শুনি, বুকভরে ওঠে, আত্মহারা হয়ে পড়ি, আনন্দে হৃদয় নেচে ওঠে, বিগলিত হয়ে যাই, খুউউব ভালো লাগে। এমন লোককেই তো দেশের জন্য দরকার। যিনি দেশের স্বার্থে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন “ম্যায় হু চৌকিদার”। কিন্তু নির্বাক হয়ে যাই যখন দেখি চৌকিদারের সামনে দিয়ে আন্তর্জাতিক চোরগুলো নিরাপদে নির্বিঘ্নে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পৌঁছে যায়। তখনই আমার ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, আফসোসের শেষ থাকেনা ; এমন নেতাদের যখন ক্ষমতার অলিন্দে বসানোর জন্য রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করতে দেখি; মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত হতে দেখি; ভাই ভাইকে যখন খুন করতে দেখি। খুন হওয়া ভাইয়ের লাশের আমোদিত গন্ধে যখন নেতাদের হুড়মুড়িয়ে পড়তে দেখি, যখন তাদের মিটিমিটি হাসতে দেখি, আর ভোটের অঙ্ক কষতে দেখি। শোকসন্তপ্ত পরিবেশে যখন “এ ফুল” বলে ও ছিলো আমার, তখন “ও ফুল” বলে ও ছিলো আমার, কেউবা রক্তমাখা হাত উঁচু করে ও ছিলো আমার বলতে দেখি। পাঁজর ভাঙা পিতার বুকফাটা কান্না যখন দেখি। বুক খালি হওয়া মায়ের আহাজারি যখন দেখি। বাঁধভাঙা প্লাবনের ন্যায় তার পরিবারকে অথৈ সাগরে ভাসতে যখন দেখি। তখনই আফসোসের শেষ থাকেনা। তখনই আমার ব্রেন হ্যাং হয়ে যায়।
হ্যাং হওয়া আলস্য মস্তিষ্কে তখন নিরালায় নিভৃতে ভাবি, যত কথাই বলিনা কেন! আমরা নেতাদের কাছে বন্দি ভারতবাসী।
আলমগীর সর্দার
সভাপতি ,পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে আহলে হাদীস