বাংলায় বিজেপির পরাজযের কারন লিখেছেন :- পাশারুল আলম
প্রতিবেদন :-
পশ্চিমবঙ্গ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোট গণনা শেষ হল। আসামে বিজেপি 75 আসন কংগ্রেস জোট 49টি আসন, তামিলনাড়ুতে বিজেপি জোট 78টি আসন কংগ্রেস ইস্তালিন জোট 155টি আসন, কেৱলে বিজেপি 0 আসন বাম জোট 99টি আসন, কংগ্রেস জোট 41টি আসন ,পদিচেরি বিজেপি 16টি আসন, কংগ্রেস 14টি আসনে জয়ী হয়েছে। এই ফল নিয়ে স্থানীয়ভাবে হয়তো তোলপাল হচ্ছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে চর্চা শুরু হয়েছে, এই চর্চা যে হবে তা কারো অজানা ছিল না। যা ফলাফল তৃণমূল 214টি আসন, বিজেপি 76টি আসন, সংযুক্ত মৌর্চা 1টি আসন। (এখনো চূড়ান্ত ফল আসেনি, তাই সামান্য পরিবর্তন হতে পারে) আসলে কেউ ভাবতেই পারেননি, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি হেরে যাবে। এটাকে অবশ্য হারা বলেনা। যথেষ্ট সংখ্যক আসন পেয়ে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দল হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। কেননা তিন থেকে এক লাফে 76টি আসন। এই ফল বিজেপির হার কিনা বলা মুশকিল কিন্তু বিজেপি দলের জাতীয় নেতাদের হার হয়েছে। শুধু হার হয়েছে বললে ভুল হবে। এটা তাদের জন্য চরম ও চূড়ান্ত পরাজয়। সত্যি কথা বলতে কি তাদের মুখ ঢাকার উপায় নেই।
আমরা জানি বঙ্গ বিজয়ে যেভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি ছাড়াও হিন্দুত্বের বেস্ট বয় যোগী আদিত্যনাথ সহ একাধিক নেতা-নেত্রী পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে উঠে পড়ে লেগে ছিল তা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। যখনই এই রাজ্যে ভোট আসবে তখনই 2021 সালের কথা স্মরণে থাকবে। এটা ভোট ছিল নাকি যুদ্ধ নাকি খেলা ? আসলে এটা ছিল বাঙালি চেতনা বনাম বাঙালি আবেগের লড়াই । এই লড়াইয়ে বাঙালি চেতনার জয় হয়েছে।
বিজেপির এই পরাজয় ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে দিল। কারন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ এবার ঘুরে দাঁড়াবে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে 2024 সালে বিজেপি কেন্দ্র সরকার ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। এই ফল মমতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন জোট গড়ে উঠবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও এই প্রক্রিয়া জটিল ও সময় সাপেক্ষ, তবে এখন থেকে এই কাজ শুরু করে এগিয়ে গেলে ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ শুরু হবে। সেতো পরের কথা, কখন কিভাবে এই জোট তৈরি হবে ? কাকে সামনের সারিতে রাখবে ? তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যেও বিস্তর রাজনীতি হবে। সময় সময় আমরা তা দেখতে পাব কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এত চেষ্টা চরিত্র করেও কেন ক্ষমতা দখল করতে পারল না ? তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। অন্য দিকে তৃণমূলকে এই জয় পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। এই রকম একটা মুখোমুখি লড়াইয়ে বিজেপি কেন হারল এবং তৃণমূল কিভাবে জয় পেল সেটাই ভাববার বিষয়।
এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়। বিজেপি বহু চিন্তা ভাবনা করে নির্বাচনের দিন তারিখ কমিশনকে দিয়ে কার্যকরী করেছিল। এই অভিযোগ অনেকের। সত্য কি মিথ্য তা বিবেচ্য নয় কিন্তু বিজেপি এই দিন তারিখকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য ঘন্টা মিনিট দিয়ে বাংলা জয় করার নব নব ফর্মুলায় নির্বাচনকে সাজিয়ে এক প্রকার বাংলাকে করায়ত্ব করে ফেলেছিল। তাই বহু মানুষ ধরে নিয়ে ছিলেন কথিত ‘আসল পরিবর্তন’ শুধু সময়ের অপেক্ষা। তা যে হবে না, তা কেউ কেউ টের পেয়েছিলেন। তারা বুঝতে পারলেও জোর গলায় বলার সাহস দেখাতে পারেনি। এর কারণ ছিল, তা হল বিজেপি যেভাবে প্রচারকে চরম ও চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সেই সমস্ত ভাবনার চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে আরও কিছুদিন। তবে বেশ কিছু কারনে জন্য বিজেপির এই পরাজয়।
প্রথমত: বিজেপি মাঠে নেমে ছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের 70 শতাংশ ভোটারকে পাখির চোখ করে। তাই শুভেন্দু থেকে দিলীপ ঘোষ কম কথা বলেনি। বাকি নেতা-নেত্রীরা আড়ালে আবডালে সে কথা সব সময়ে বলেছে। এর ফলে সংখ্যালঘু 30 শতাংশ ভোটারের কাছে বিজেপি নিজের দোষে পৌঁছাতে পারে নি। যদি বিজেপি এই গেম না খেলে শুধু মাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তৃণমূলের বিরোধিতা করত তাহলে ভালো সংখ্যক মুসলিম ভোট বিজেপির দিকে যেত। সেটা একেবারেই সম্ভব হয়নি। মুসলিম তুষ্টি করণের কথা বলেছে কিন্তু কোথায় কিভাবে এই তুষ্টিকরণ হয়েছে ? তার কোনো প্রমাণ হাজির করে নি বা করতে পারেনি। তাই এই আবেদন তেমনভাবে গ্রহনযোগ্য হয়নি। উল্টে মুসলিম জন-মানসে সরকার বিরোধী যে মনোভাব ছিল তা বিলীন হয়ে পুনরায় তৃণমূলের দিকে চলে গেছে। বিজেপির এই কথন তৃণমূলের কতটা ক্ষতি করেছে তা দেখার বিষয় কিন্তু বিজেপির এই ভুয়ো শ্লোগানে মুসলিম জন মানস প্রচন্ডভাবে আহত হয়েছে ।
দ্বিতীয়ত:-বিজেপি ভেবেছিল তৃণমুলকে ভেঙে তাদের নেতা -নেত্রীকে দলে এনে যেমন দুর্বল করা যাবে তেমনি তাদের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রার্থী করে জয়কে সুনিশ্চিত করা যাবে। এর ফল উল্টো হয়েছে। সাধারণ মানুষ এই নোংরা রাজনীতিকে ভালো চোখে নেয়নি। কেননা, যে সমস্ত নেতা-নেত্রী তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গেছে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল অপরিসীম। তারা তৃণমূলে থেকে গেলে বিজেপির লাভ হত বেশী। তাদেরকে দেখিয়ে ভোট করতে পারত কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্থ বলে যাদের নামে অভিযোগ ছিল তাদের নিজ দলে নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে বহু সংগঠিত আসন যা কিনা লোকসভার ভোটে এগিয়ে ছিল তা বিজেপিকে হারাতে হয়েছে।
তৃতীয়ত;-সি,এ,এ, আইন নিয়ে তাদের দ্বিচারিতা মতুয়া ও উদ্বাস্তু সমাজের মধ্যে প্রবল মতভেদ ছিল। আসামে বলছে সি,এ,এ, চালু হবে না। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে বলেছে প্রথম মন্ত্রী সভায় সি,এ,এ, চালু করা হবে। যে আইনের রুলস তৈরী হয়নি তা কিভাবে চালু করবে। সে বিষয়ে সঠিক উত্তর তাদের কাছে ছিল না। এই নিয়ে দফায় দফায় মতুয়াদের সাথে তাদের বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকগুলিতে সঠিক উত্তর দিতে না পারার কারণে বহু মতুয়া বিজেপি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে।
চতুর্থত:- লোকসভা ভোটের পূর্বে তৃণমূল বুঝতেই পারেনি যে পশ্চিমবঙ্গে চোরা স্রোতে বিজেপি এত বড় জায়গা করে নিয়েছে। 2019 সালের লোকসভা ভোট তৃণমূলের চোখ খুলে দেয়। লোকসভা থেকে বিধানসভা পর্যন্ত অনেক ছিদ্র বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন রাজবংশী জন সমাজের তিনটি গুরুত্বপুর্ন ইয়ন্স এর মধ্যে অতুল রায় ও বংশীবদনকে নিজের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছে। যদিও অনন্ত মরারাজ বিজেপির পক্ষ নিয়েছিল। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের একটি অংশ আর নস্যশেখ সমাজের মানুষ মিলে উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপির বাড়া ভাতে বালি দিয়েছে। একইভাবে বাঙ্গাল মানসে বিজেপি কিছু জায়গা করে নিতে পারলেও ঘটি সমাজে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার তেমনভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। এদের মধ্যে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের আবেদন বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া আদিবাসী ও মহিলা সমাজে মমতা নিজের বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। বিমল গুরুং কে আপসে নিয়ে এসে পাহাড়ে বাড়তি সুবিধা করে নিয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পঞ্চমত:-নোটবন্দী, জি,এস,টি, দেশের ক্ষতি করেছে এটা জেনেও বহু বঙ্গবাসী বিজেপির দিকে ছিল কিন্তু এক এক করে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিক্রি করার প্রবণতা বঙ্গবাসীকে ভাবিয়ে তুলে এবং বিজেপির বহু সমর্থক থমকে দাঁড়িয়ে যায়। এই থেমে যাওয়ায় বিজেপিকে থামিয়ে দিয়েছে।
ষষ্ঠত:-উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে স্টার প্রচারক হিসাবে রাখা বিজেপির সঠিক কাজ হয়নি। কেননা, যোগী আদিত্যনাথের বিষয়ে বঙ্গবাসীর মনে মোটেই শ্রদ্ধা নেই। এদিকে একের পর এক বিজেপি নেতা বলেছে বাংলায় তারা যোগী রাজ কায়েম করবে। বাস্তবে তার জনসভা যেমন জমেনি উল্টে এতে তৃণমূলের লাভ হয়েছে অনেক বেশী।
সপ্তমত:- মমতা ব্যানার্জিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বহু বঙ্গবাসী ভালো নজরে নেয়নি। সন্দেহ নেই, নরেন্দ্র মোদীর জন সমর্থন আছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বহু মানুষ তৃণমূল বিরোধী হলেও মমতা বিরোধী নয়। এই বিষয়টি বিজেপি ধরতে পারেনি। জন সমর্থনের দিক থেকে মমতা যে মোটেই কম যায়না তা বুঝে ব্যক্তি আক্রমন না করে সরকারি নীতি নিয়ে সমালোচনা করলে খুব বেশী না হলেও শিক্ষিত সমাজের কিছু ভোট বিজেপির দিকে যেতে পারত। এই ভুলের কারণে বিজেপি যতটা লাভবান হতে চাইছিল তা হতে পারেনি।
অষ্টমত:- পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে আবাঙালীর দ্বারা। তাদের আস্ফালন দেখে বহু বাঙালী চিন্তিত ছিল। যদিও পরবর্তীকালে অখিলেশ ও তেজস্বীর প্রচেষ্ঠায় বহু অবাঙালী ভোটার বিজেপি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাঙ্গালীদের ক্ষমতা খর্ব হবে এই ধারনা বেশ শক্তিশালী হয়। বহিরাগত শ্লোগানের মধ্য কিছুটা সত্যতা ছিল। তা বাঙালি জন মানসে কাজ করেছে। এই রকম একাধিক কারনে বিজেপির এবার বাংলা জয় থমকে গেল।
সবিশেষে বলা যেতে পারে বাঙালী এবার আবেগ আর চেতনার মধ্যে যুদ্ধ করেছে। এটা বাঙালীর জন্য কম সংকট ছিল না। কোন পথে হাটলে বিপদ কম। এই ভাবনায় আবেগ আর চেতনার লড়াই হয়েছে। এই লড়াইয়ে বাঙালি চেতনার জয় হয়েছে। তা যেমন ছিল তেমনি বামপন্থী ও কংগ্রেস শেষ সময়ে আব্বাস সিদ্দিকীর প্রদত্ত অক্সিজেন পেয়ে কিছুটা সবল হয়ে যথেষ্ট মনোবল নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে ছিল। এতে বিজেপির ভোট অনেকটা কমেছে। অন্যদিকে বলা যেতে পারে যথাসম্ভব এরা নিজেদের ভোট নিজের প্রতীকে নিয়ে তৃণমূলের জয়ের রাস্তাকে সুগম করেছে। কংগ্রেস ও বামপন্থীদের অক্লান্ত পরিশ্রম বিজেপিকে যেমন প্রতিহত করেছে তেমনি তৃণমূলকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। যদিও এই বিষয়টি সম্পুর্ন রূপে মানসিক ছিল।
এবারকার নির্বাচনে তৃণমূল জয়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাস্তব ছিল একেবারে আলাদা। তার কারণ দশবছর শাসন করার ফলে সরকার বিরোধী একটা মনোভাব জন-মানসে তৈরী হয়েছিল। প্রতিষ্ঠান বিরোধী এই ফসল বাম কংগ্রেস ও বিজেপি কেউ সুচারিভাবে তুলতে পারেনি। তার কারণ বিজেপি শুরু থেকে সমীকরণের রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। ফলে তাদের কাছে সমীকরণ মুখ্য ইস্যু হলেও সরকারের সমালোচনা গৌণ হয়ে পরে। অন্যদিকে বাম কংগ্রেস জোট এই ইস্যু নিয়ে ভোট করতে চেয়েছিল কিন্তু বিজেপির প্রচার এমন জায়গায় নিয়ে গেল যে, তাদের আবেদন শোনার মত মন মানসিকতা রইল না। বরং মমতা যখন বলেন, বাম কংগ্রেরকে ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করবেন না, তা মানুষের কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য মনে হয়েছে। মমতা যতটা বিজেপিকে আক্রমন করেছে তার সিকিভাগ কংগ্রেস বামেরা বিজেপিকে বিঁধতে পারেনি। ফলে সরকার বিরোধী ভোট তেমনভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে বাম কংগ্রেসের এই দুর্দিনের জন্য সংযুক্ত মৌর্চা তেমনভাবে দায়ী নয়। কারণ এবারকার ভোট বাঁচা মরার ভোট হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। নির্বাচন যত এগিয়ে এসেছে ততই একটি জিনিস প্রবল হয়েছে, তা হল মোদী না মমতা। মিডিয়া সহ তৃণমূল ও বিজেপি দুই শাসক দল যখন এই রকম একটি খেলা শুরু করেছে তখন বাম কংগ্রেস তাদের অজান্তে মাঠের বাইরে চলে গেছে।
অপর দিকে তাকালে এবার তৃণমূল খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। সেই সুযোগ বিজেপি ধরতে পারল না। যে সমস্ত বিষয়ে বিজেপি ভাবলে তারা লাভবান হতে পারত তা হয়ে উঠেনি।
প্রথমত:- এবার পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ মোটেই তৃণমূলের দিকে ছিল না। কেননা, বিজেপি যখন তুষ্টিকরনের কথা বলে ভোট সমীকরণ করার চেষ্টা করছিল তখন মুসলমানেরা ভাবছিল, কোথায় তুষ্টিকরণ ? সাচার কমিটির রিপোর্টে মুসলিম সমাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছিল তার থেকে মুসলিম সমাজের বিন্দু বিসর্গ উন্নতি হয়নি। এরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিয়ে রয়ে গেছে। অথচ বিজেপির প্রচার মুসলিম সমাজকে নানাভাবে ভয় ভীতি দেখাতে শুরু করে। যেমন, এম,পি,আর,এন,আর,সি, সি,এ,এ, যোগী রাজ ইত্যাদি বলে মুসলিম সমাজকে তৃণমুলকে ভোট দিতে বাধ্য করেছে। এই ভোট তৃণমুলকে জয় এনে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। জানিনা এবারকার সরকার সত্যিকারের মুসলিম উন্নয়নে সঠিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে কিনা ?
দ্বিতীয়ত:-তৃণমূল এবং মমতা ব্যানার্জী প্রথম থেকে নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমন করেছে। যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর মুখ সামনে না নিয়ে এলেই তৃণমূল যদি দিলীপ ঘোষকে বিজেপির মুখ হিসাবে প্রচার করে মাঠে নামত তাহলে এই যুদ্ধ যতটা কঠিন হল ততটা কঠিন হত না। মুখ্যমন্ত্রীর ভোট তাই এই ভোটে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে একটা ভুল বার্তা গেছে। পক্ষান্তরে আমরা দেখেছি দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনে কেজরিওয়াল নরেন্দ্র মোদিকে টার্গেট করেনি। তৃণমূল নরেন্দ্র মোদীকে টার্গেট করে বিজেপিকে এক্সট্রা অক্সিজেন দিয়েছে। তাই খেলার ছোট মাঠ অনেক বড় মাঠে রূপান্তরিত হয়েছে। মমতাকে টার্গেট করে বিজেপি যে ভুল করেছিল একই ভুল তৃণমূল করেছে। এই খেলায় গোল খাওয়ার উপক্রম হলে বাংলার সেক্যুলার মানুষ গোল রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এই সেক্যুলার শক্তির সহযোগিতা তাদের অনেকেই এক সুরে আওয়াজ তুলল ‘নো ভোট টু বিজেপি’ । এছাড়া মেধা পাটকরের নেতৃত্ত্বে কৃষকদের একাধিক কৃষক পঞ্চায়েত না হলে তৃণমূল ভয়ংকরভাবে পরাস্ত হতে পারত। এছাড়া এবারকার ভোটে রাজ্য কর্মচারী বিজেপির দিকে ঝুঁকে থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী ব্যাপক হারে তৃণমুলকে ভোট করেছে। পাশাপাশি কেন্দ্র সরকারে একাধিক জন বিরোধী আইন যেমন, কৃষি আইন, শ্রম আইন, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিক্রি সহ স্বল্প সময়ে লক ডাউনের ঘোষণা সর্বপরি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি চোরাস্রোতে বহু বিজেপি সমর্থক তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যার ফলে বিজেপির আশা নিরাশায় পর্যবসিত হয়েছে। নন্দীগ্রামে মমতা ব্যানার্জির যে ফল তা নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। নন্দীগ্রামের জয়পরাজয় বাংলার রাজনীতির বিষয়ে কোনো বিষয়ে নয়। আসল বিষয় হল বাংলার মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই প্রত্যাখ্যান মমতাকে সামনে রেখেই হয়েছে।
তৃতীয়ত:- এবারকার ভোটে বিজেপি ও তৃণমূল জাতি সত্বার বিষয়ে বিশেষ সচেতন ও খুব হিসেব করে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার চেষ্টা করেছে। যেমন দীর্ঘদিন যাবৎ পশ্চিমবঙ্গে একটি বাঙালী সত্বা জাগরিত ছিল। এই সত্বাকে অনেকাংশে কলকাতা নিয়ন্ত্রণ করত। এবার কিন্তু তেমনটা হয়নি। তার কারণ, এবার বাংলার ভোটার কেউ নেপালী, কেউ গোর্খা, কেউ লেপচা, কেউ রাজবংশী, কেউ নস্যশেখ, কেউ মতুয়া, কেউ নমঃশূদ্র, কেউ কুর্মি, কেউ আদিবাসী, কেউ শেরশাহবাদী, কেউ বাঙালী। এই রকম বহুত্ববাদের বেড়াজালে কলকাতার আবেদন সর্বজনীন হয়ে উঠেনি। এতে তৃণমূল অপেক্ষা বিজেপি বেশী ফায়দা তুলতে সক্ষম হয়েছে। কেননা এই বিষয়ে বিজেপি যতটা পারদর্শী তৃণমূল ততটা নয়।
যাইহোক বিজয়ী দলের সব ঠিক আর পরাজিত দলের অনেক ভুল। এটাই মূল্যায়নের রীতিনীতি। তবে এই ভোটে কেন মমতা তার একটি ছোট রূপ এইভাবে দেওয়া যেতে পারে। প্রথম ম মুসলিম, দ্বিতীয় ম মহিলা আর বিজেপির সাপ্রদায়িক তাপের তা এই তিন মিলে এবার বাংলায় মমতা।
অবশেষে বলি যে বিষ বায়ু বিজেপি বঙ্গবাসীর মনে দিয়ে গেল, সেখান থেকে বের হয়ে আসায় এখন প্রথম কাজ। নির্বাচনে কি হল ? কে কি বলল ? কে জিতল ? সব ভুলে গিয়ে সৌভ্রাতৃত্বের বাতাবরণ তৈরী করাই হোক প্রথম কাজ।