ঘোর অমানিশায় এভাবে যেতে হয়, এবাদুলদা :- চন্দ্রপ্রকাশ সরকার

Spread the love

ঘোর অমানিশায় এভাবে যেতে হয়, এবাদুলদা !

চন্দ্রপ্রকাশ সরকার :- আবার মর্মান্তিক বিয়োগব্যথা! এবার এবাদুল হক। কবি ও সম্পাদক। তাঁর সম্পাদিত ‘আবার এসেছি ফিরে’ ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রের ৪২ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা তথা শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে গত জানুয়ারি মাসে। পেশায় ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। জন্ম এবং কর্মস্থল ভগবানগোলা। সবাই জানেন সেটি একটি মফস্বল জায়গা। সেখান থেকে সদর বহরমপুরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে পত্রিকা প্রকাশনা চাট্টিখানি কথা নয়!
১৯৭৯ সালে আবার এসেছি ফিরে প্রকাশের কিছু পরেই বহরমপুরের গ্রান্ট হলে কোন একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে এবাদুল হকের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আমার আসল বয়স আর তাঁর অবসর গ্রহণের সময়কাল(জানুয়ারি ২০১৯) যোগ-বিয়োগ করে দেখেছি বয়সে আমি বছর খানেকের বড়। আমি তাকে ‘এবাদুল দা’ বলতাম, তিনি আমাকে বলতেন শুধুই ‘দাদা’। তা ভালো মানুষের দাদা হতে কার না ভালো লাগে ! এরকম নির্লোভ, নিরহংকার ও নির্ভীক মানুষ আজকাল খুব বেশি দেখা যায় না। উদার-মুক্তমনা, সত্যসন্ধানী, যুক্তিবাদী চেতনায় চালিত ছিল তাঁর জীবন। বিজ্ঞাপনবিহীন বিপুলায়তন পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশনায়, বলাবাহুল্য, তাঁকে বিপুল আর্থিক ও শারীরিক ক্লেশ সইতে হয়েছে। কিন্তু কখনও তিনি কোনভাবে আপোস করেননি।
আর শারীরিক ক্লেশ স্বীকার ও মানসিক জেদের ব্যাপারটি এবাদুলদাকে কাছ থেকে না দেখলে ধারণা করা কঠিন। ভয়াবহ এক পথদুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। একটি পা বাদ যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু সেই পা স্বাভাবিক হয়নি কোনদিন। প্রথমদিকে কয়েক বছর ক্রাচে ভর দিয়ে চলতেন। পরে ক্রাচেরই বিকল্প বিশেষ ধরনের লাঠি নিয়ে গাড়িতে ওঠা-নামা করতেন। ট্রেনে ওঠা-নামা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই ভগবানগোলা থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাঝেমাঝেই বহরমপুরে আসতেন পত্রিকার কাজে। অসুস্থ-অশক্ত শরীরেও যেতেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সাহিত্যসভায় যোগ দিতে। বিশেষত ‘দ্য ডোমকল কলিং’-এর ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার যেতেন ডোমকলে। গাড়িতে ওঠা-নামার সময় দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট লুকোনোর চেষ্টা করতেন। মাস কয়েক আগে বিশিষ্ট কবি নাসের হোসেনকে শেষ বিদায় জানাতে সাতসকালে চলে এসেছিলেন বহরমপুরে। ঠকঠক করে কাঁপছিল তাঁর শরীর। কোনরকমে হাত ধরে নামানো হলো গাড়ি থেকে, আবার শেষকৃত্য শেষ হওয়ার পর একইভাবে তুলে দেওয়া হল গাড়িতে।
এবাদুলদা কোনদিন সাহিত্যের ‘সৌখিন মজদুরি’ করেননি, তাঁর যাবতীয় সাহিত্য-প্রচেষ্টার পিছনে ছিল গভীর সামাজিক দায়বোধ। এ রাজ্যের লিটল ম্যাগ আন্দোলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কবি-কৃতির সৌরভ শুধু পশ্চিম বাংলায় নয়, ওপার বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত তাঁর সম্পাদিত কবিতা-পত্রিকা ‘এবং পুনশ্চ’র তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা তথা সর্বশেষ সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ৪১ জন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। তরুণ সাহিত্যসেবীদের কাছে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের ছায়াস্বরূপ। অভিভাবকসম স্নেহে অনুজপ্রতিমদের যেমন সোহাগ দিতেন, তেমনি আবার তাদের বেচাল বা বাচালতায় দিতেন বকুনিও। তবে সেই বকুনিতেও থাকতো অদ্ভুত এক মিষ্টতা।
এবাদুল হকের সাহিত্যানুরাগ সেই কিশোর বয়স থেকেই। ১৯৭৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রলয় পত্রিকায় কলম ধরার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্য-পথে যাত্রা শুরু। পরে ওই পত্রিকা সম্পাদনাও করেন। ১৯৭৭ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় রামধনু। ‘আবার এসেছি ফিরে’র যাত্রা শুরু ১৯৭৯ সালে। আজ সকাল ১০ টা পর্যন্ত ছিলেন সারা রাজ্যে সমাদৃত ও সম্ভ্রম উদ্রেককারী এই পত্রিকার সম্পাদক।
অসীম নিষ্ঠায় শুধুমাত্র পত্রিকা সম্পাদনাই নয়, সদাসক্রিয়, নিরলস সৃজনশীল এবাদুল হকের মননঋদ্ধ সৃষ্টিসম্ভারও নেহাত কম নয়। এ পর্যন্ত তাঁর অন্তত আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি হল কাকলি, সূর্যাস্তের আগে ও পরে, নাগকেশরের ফুল, বাউল জল, অগ্নিজল, একগ্লাস জলের ছায়া, পলাতক ছায়া এবং নারী। প্রকাশিত হয়েছে শতখানেক গল্পের একটি সংকলন অনন্ত। ১৭ টি নাটকের সংকলন ‘এখনও লক্ষিন্দর’ তাঁর নাট্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। ১৯৮২ সালে উত্তরবঙ্গ নাট্যজগৎ(শিলিগুড়ি) তাঁকে নাট্যকার হিসেবে প্রথম পুরস্কারে ভূষিত করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত সারা বাংলা লিটলম্যাগ প্রতিযোগিতায় পরপর দুবার — ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে — প্রথম পুরস্কার লাভ করে তাঁর পত্রিকা আবার এসেছি ফিরে। ২০১২-তে লাভ করে বাংলা আকাদেমি প্রথম পুরস্কার। ২০১৬ সালে সারা ভারত লিটলম্যাগ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান, সেই সঙ্গে পান সাদাত হাসান মান্টো পুরস্কারও।
সর্বার্থেই বর্তমান সময় বড় অস্থির, অসুস্থ। এই রকম এক দুঃসময়ে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে চলে গেলেন এবাদুল হক। তিনি আর কোন দিনও ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিসম্ভার আর ‘আবার এসেছি ফিরে’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রয়ে যাবে একটি স্থায়ী জায়গা নিয়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন অসংখ্য অনুরাগী ও গুণগ্রাহীর অন্তরে।

@ চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
১৭ মে ২০২১
(তথ্যঋণ: নবিউল ইসলাম, সম্পাদক, প্রদর্শিকা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.