গঙ্গা আজ শববাহী
পাশারুল আলম
প্রতিবেদন :- ভারতবর্ষের জাতীয় নদী গঙ্গা। এই নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সব চেয়ে অধিক জনবসতি।
গঙ্গার দুইধারে উর্বর জমি আর তার জলপ্রবাহ অনাদিকাল থেকে ভারত ভূমিকে সিঞ্চিত করেছে। তাই তো একটি নদী মায়ের মর্যাদা পেয়েছে। শুধু মা বলে থেমে যায়নি, তাকে দেবী রূপে পূজা করছে মানুষ। যার আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে এক বৃহৎ কৃষি ক্ষেত্র। যতদিন আধুনিক সভ্যতার বিস্তার হয়নি ততদিন গঙ্গার পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। আজকাল সবার মুখে গঙ্গার দূষণ নিয়ে নানান কথা শোনা যায়। সরকার গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্য কোটি কোটি অর্থ খরচ করে কিন্তু গঙ্গা দূষণের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে কেউ মনে করে না। ইদানিং গঙ্গায় ভাসমান লাশ বিশ্বের পরিবেশবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে।
গঙ্গা শুধু কৃষি ক্ষেত্রে তার অবদান রেখেছে তা নয়, এই নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে একাধিক ছোট বড় শহর ও গ্রাম। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল কাছে এই নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এই নদীর ধারে বসবাসকারীরা শুধু গঙ্গার দ্বারা উঅকৃত তা কিন্তু নয়। সমগ্র ভারতবর্ষ এই নদীর দ্বারা উপকৃত। তাই গঙ্গার এত কদর। সেই নদীর জলে ভেসে চলছে কয়েক হাজার মৃত মানুষের লাশ। কেন এমন হল, এর হাত থেকে কি উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়?
করোনা কালে যখন দেশব্যাপী হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মরছে। তখন অসহায় কিছু মানুষ এবং ধর্মীয় একটি সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নদী বক্ষে ভাসিয়ে দিচ্ছে মৃত মানুষের দেহ।
গঙ্গা নদী ভারতীয়দের নিকট কেন এত পবিত্র এবং প্রয়োজনীয়। তার কারণ গঙ্গার জল দিয়ে সেচ হয়, এই নদীজলে স্নান হয়। বহু মানুষ এই নদীর জল পান করে। জীবিত মানুষ পায় এর আশ্রয় তেমনি মৃত মানুষ এর বক্ষে পায় শান্তি। তাই সবাই চায় তার অস্থি যাতে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। এই শান্তি আর পবিত্র গঙ্গা বক্ষ হয়ে উঠেছে এক শববাহী নদী।
গত জানুয়ারি থেকে আনাগোনা চলছিল করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে দেশে। যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে গেল, তখন কেন্দ্রীয় সরকার মেতে থাকল ভোট রাজনীতিতে। অন্যদিকে মহা ধুমধাম করে পালিত হল কুম্ভমেলা। যে সময়টা ছিল দেশের মানুষকে সচেতন করার সময় সেই সময়ে তা যেমন করা হয়নি, তেমনি দেশে বিদেশে প্রচার করা হল আমরা করোনা জয় করে ফেলেছি। এটা কোনো সাধারণ মানুষ করলেন না। এই প্রচার করলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ফলে জনমানসে এই বিশ্বাস তৈরি হল যে,আমাদের দেশ থেকে করোনা বিদায় হয়েছে। এই বিদায় বার্তা দেশের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। আজ যখন করোনা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার হাত তুলে দিয়ে সমস্ত দায় দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে সামলানোর কথা বলছে। এই কথা কেন্দ্র সরকার গত বছর প্রথম যখন করোনা দেশে আসে তখন বললে রাজ্যগুলির অনেক সুবিধা হত। অথচ গত বছর রাজ্য সরকারকে করোনা বিষয়ে কোনো কিছু কেনার বা কোনোভাবে অর্থ সংগ্রহ করার কিংবা স্বাস্থ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে ভাবার অবকাশ পর্যন্ত দেয়নি। তখন কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা দিল সমস্ত ভারতীয়দের ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য পয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকা বাজেটে রাখা হল। সেই অর্থ কোথায় গেল ? তার কোনো উত্তর নেই। এমন এক সময়ে রাজ্যগুলি নির্দেশ দিচ্ছে যে, আপনারা নিজেরাই ভ্যাকসিন কিনুন বা যোগাড় করুন। এই সময় রাজ্যগুলির হাতে না আছে অর্থ না আছে বিশ্বেই মধ্যে ভ্যাকসিনের যোগাড়। এই কথা যদি প্রথমেই বলত তাহলে তারা অন্যান্য বাজেট বরাদ্দ কেটে দেশে কিংবা বিদেশে ভ্যাকসিন ক্রয় করার উদ্যোগ নিতে পারত। এরফলে না হল ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা, না হল ওষুধের সংকুলান। রাজ্যে রাজ্যে স্বাস্থ ব্যবস্থা যে কি হাল তা কারো অজানা নয়।
একদিকে রাজনেতা ও ধর্মীয় গুরুদের অসাবধানতার কারনে ঘরে ঘরে প্রবেশ করল করোনা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে করোনা আক্রান্ত হয়ে। এদের মৃত্যুর কারণ কি করোনা নাকি আমাদের সরকারের পূর্ব পরিকল্পনার অভাব। অভাব তো বটে না আছে অক্সিজেন, না আছে ওষুধ, না আছে হাসপাতালে বিছানার ব্যবস্থা। নেই আর নেই। এহেন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার বললেন স্বাস্থ রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়। এবার রাজ্যগুলির হাহাকার শোনার কেউ রইল না। ফলে রাজ্যে রাজ্যে শুরু হল মৃত্যু মিছিল।
জীবিত অবস্থায় মানুষ তার বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলল।
দুর্ভাগ্যের বিষয় মরেও শান্তি নেই।
মরেও অধিকার নেই। আইন অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের তার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে অন্তুষ্টি পাওয়ার অধিকারী। আমরা জানি এটিও একটি সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার হারিয়ে অসহায় মানুষ নিজেদের স্বজনকে হয়তো গঙ্গার ভাসিয়ে দিচ্ছে, হয়তোবা অর্ধদদ্ধ শব কিংবা গঙ্গা চড়ে দাফন করে দিচ্ছে। এই প্রথম গঙ্গার এমন দৃশ্য দেখা গেল তা কিন্তু নয়, আজ থেকে শত বছর পূর্বে স্পানিজ ফ্লু মহামারী কালেও এই রকম দৃশ্য দেখেছিল মানুষ। তবে দেশ তখন পরাধীন ছিল, দেশ শাসন করছিল ইংরেজ। দেশ স্বাধীন হয়েছে, শাসন করছেন মাননীয় নরেন্দ্র মোদীজি। তবুও একই দৃশ্য। অথচ গঙ্গা দূষণ মুক্ত করার জন্য গঙ্গা নমামি প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বাজেট হয়। গঙ্গা নমামি প্রকল্প বাবদ কোটি কোটি টাকার বাজেট হয়। এই খাতে দূষণ শোধন কম হয় কিন্তু প্রচার বাবদ খরচ বেশি হয়। যারা গঙ্গাকে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে এসে ভোট ভিক্ষা করে তারা আজ নীরবে সব কিছু সহ্য করছে। এই দূষণ শত বছর পূর্বের থেকে বেশি ভয়ঙ্কর হবে। তার কারণ সেই সময় গঙ্গায় কুমির ও বড় বড় মাংশাসি মাছ ছিল। আজ সেসব হারিয়ে গেছে। এদিকে বর্ষা আসছে। নদী চড়ে যেসব শব দাফন করা হয়েছে সেইসব শব আবার ভেসে উঠবে। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে এই ঘটনা ঘটলেও এর প্রভাব পড়বে হাজার হাজার গ্রামে ও গঙ্গার ধারে গড়ে উঠা বড় বড় শহরগুলোতে। যেমন, ইলাহাবাদ( প্রয়াগরাজ),হরিদ্বার, কানপুর, বারাণসী, গাজীপুর, পাটনা, মুঙ্গের,ভাগলপুর, ফারাক্কা, বহরমপুর কাটোয়া, কলকাতা, হাওড়া, হলদিয়া সহ একাধিক ছোট বড় শহর আর গঞ্জের বাসিন্দাদের উপরে। এই দায় থেকে সরকার হাত ধুয়ে বসে থাকতে পারেনা। বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশ সরকার ঘোষণা করেছে, কোভিড রোগে আক্রান্ত মৃত শবদাহ করার অর্থ না থাকলে সরকারের কাছে আবেদন করলে পাঁচ হাজার টাকা দিবে সরকার। এ এক অদ্ভুত ঘোষণা। বাড়িতে শব রেখে সরকারি টাকার সন্ধানে যাবে মানুষ। তাছাড়া পাঁচ হাজার টাকায় একাজ সম্পুর্ন হবে না। সরকারের উচিত ছিল, চুল্লি কিংবা সরকারি উদ্যোগে শ্মশান পরিচালনা করা। তাই সমস্যার সমাধান হয়নি। গঙ্গার এই দুরবস্থা নিয়ে চিন্তিত নদী বিষয়ক ও পরিবেশবাদী মানুষেরা। তারা এই বিষয়ে আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে। ততদিনে পরিবেশের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে যাবে।