নিউজ ডেস্ক :- ভারত বিশ্বের চতুর্থ তেল ব্যবহারকারী দেশ। আমেরিকা, চীন, রাশিয়ার পরেই তেল ব্যবহারে ভারতের স্থান। এরপর প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে যানবাহনের ব্যবহারের সংখ্যা। আর তাই পেট্রোল বা ডিজেলের দাম তাই কমে না কোনদিন ভারতে তা সদাই উর্ধমুখী হয়েই থাকে। আর জনসংখ্যার তেলের চাহিদার বৃদ্ধির সাথে সাথে ভারত সরকারকে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বাড়াতে হয়। যার ফলে সরকারের আয়ের বা রাজস্বের অনেক টাকা পেট্রোল বা ডিজেল আমদানি করতেই খরচ হয়ে যায়। যদি সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয় ১০০টাকা ধরা হয় তাহলে এই অপরিশোধিত তেল কেনার খাতেই ভারতের প্রায় ৬৫টাকা খরচ হয়ে যায়।
আমাদের দেশে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হওয়ার জন্য ভারতকে বিদেশের উপর নির্ভর করতে হয় তেলের জোগানের ক্ষেত্রে। তাই প্রতি বছর বিদেশি মুদ্রার একটা বড় অংশ ভারতের এইভাবেই বেরিয়ে যায়। কারন ভারতকে বিদেশি মুদ্রায় তেলের দাম মেটাতে হয়। ভারতে প্রতিদিন ১৪লক্ষ ব্যারেল এর মতো ডিজেল ব্যবহার হয়। আর পেট্রোলের ক্ষেত্রে পরিমান কিছুটা কম। কিন্তু তবুও যেহারে পেট্রোল বা ডিজেলের দাম সরকার সাধারণের জন্য বাড়িয়ে চলেছে তার পেছনে কারন খুঁজতে আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের এই প্রতিবেদনে।
ভারতের আমদানি করা তেলের উপর বাড়তি খরচ
ভারত সরকার যে দামে বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত পেট্রোল বা ডিজেল ক্রয় করে, তারপর সেই একই হারে বাজারে বিক্রি করে না। এই অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার পর তার উপর বিভিন্ন কর আরোপিত করে। আর এই কর আরোপন করার ফলে বাড়তে থাকে পেট্রোল বা ডিজেলের দাম। প্রথমেই অপরিশোধিত তেল কেনার পর সেই তেল দেশে নিয়ে আনার জন্য ভারত সরকারকে দিতে হয় পরিবহন খরচ। তা যদি পাইপ লাইনের মাধ্যমে আসে তাহলে তাতে লাগে আলাদা খরচ আর যদি তা কন্টেনার করে জলপথে নিয়ে আসা হয় পরিশোধন কেন্দ্রে তাতে একে বলা হয় পরিশোধন পরিবহন খরচ বা Refinery Transfer Price (RTP)। অর্থাৎ অপরিশোধিত তেলের দামের সাথে তা নতুন করে যুক্ত হয়। অর্থাৎ তেল মার্কেটিং কোম্পানি যেমন IOCL, BPCL & HPCL এইসব কোম্পানিকে এই দামে অপরিশোধিত তেল কিনতে হয়।
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কর
অপরিশোধিত তেল আমদানি করার পর তা পরিশোধন করার আগে বা পরে তার উপর নেওয়া হয় বিভিন্ন কর। এই কর নিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার।
প্রথমেই নেওয়া হয়ে থাকে কেন্দ্রীয় এক্সাইজ ট্যাক্স বা আবগারি কর যা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে থাকে। গত জুন মাসের হিসাবে বিভিন্ন দেশীয় তেল কোম্পানি গুলো এক লিটার অসংশোধিত তেল কিনতে করতে খরচ করে ৩৭ টাকা ১৯ পয়সা। সেখানে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার এক লিটার তেল থেকে কর হিসাবে আদায় করে ৩৫ টাকা ৭৬ পয়সা। অর্থাৎ প্রায় ১০০%।
তাহলে বুঝতেই পারছেন কী হারে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার আমাদের মতো সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সকল ভারতবাসীর কাছে পেট্রোল বা ডিজেল বা অন্যান্য তরল জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করছে। আর সকল ভারতবাসী কীভাবে এই কর ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে।যখন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার তেলের দামকে বাজারের উপর ছেড়ে দিয়েছে তখন থেকেই জ্বালানি তেলের দামের এই উর্ধমুখী ভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। গত ২০১৬ সালের জুন মাসে সরকার যখন সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিদিন জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের হিসাবে বাড়ানো বা কমানো হবে, তখন থেকে পেট্রোলের দাম বেড়েই চলেছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পদ্ধতি যা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন অনুসরণ করে সেই অনুযায়ী ডিলারদের প্রতি লিটার পেট্রোলের যা দাম চার্জ করা হয়েছে গত দুই মাসের আগের হিসাব অনুযায়ী তা হল ৩৭ টাকা ১৯ পয়সা। আর এরপর এই তেলের দামের সঙ্গে যখন ২৫.৪৪% আবগারি কর, ৪.৭২% ডিলার কমিশন ও ২১.২৬% VAT যোগ করা হয় তখন তার দাম একলাফে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এবার বিভিন্ন রাজ্যের কর অনুযায়ী তা আবার বাড়তে থাকে।
যদিও ভারতের মতো অন্যান্য রাষ্ট্রে যে একই রকম জ্বালানি তেলের দাম আছে তা কিন্তু নয়। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ বা উন্নত দেশে তা বিভিন্ন রকম। আমেরিকায় তেলের উপর ১৭% কর আদায় করা হয় বর্তমানে কেনা দামের উপর। আর ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্থানে সেটা ২৩.৫%। এমনকি ভারতের অন্য প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৫% কর্পোরেট কর এবং ১৫% কর জ্বালানির উপর নেওয়া হয়। ইউরোপিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দেশের ক্ষেত্রে তা হয় ২১% এর কাছাকাছি। যদিও নরওয়ে ও নেদারলান্ডের ক্ষেত্রে এই করের হার ভারতের চেয়ে বেশি। এইসব হিসাব গত দুই মাসের তথ্য অনুযায়ী।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সকল দেশ একমাত্র চীনকে ছাড়লে যেখানে পেট্রোলের গড় দাম প্রায় ৮০.৮৩ টাকা, ভারতে পেট্রোলের ও ডিজেলের দাম সবচেয়ে বেশি। পাকিস্থানে যেখানে বর্তমানে পেট্রোল তেলের দাম লিটার প্রতি ৫১.৬৪ টাকা সেখানে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ৭১.৫৪ টাকা এবং ৬৩.৯১ টাকা। এইসব হিসাব গত দুই মাসের আগের হিসাব অনুযায়ী।
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতিদিন ওঠানামা করে। ভারতে অপরিশোধিত তেলের দাম এবং যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল কেনা হয় তার গত ৫ বছরের হিসেব হল :
ব্যারেল প্রতি, ২০১৫-১৬ সালে ৪৬.১৭ ডলার , ২০১৬-১৭ সালে ৪৭.৫৬ ডলার , ২০১৭-১৮ সালে ৫৬.৪৩ ডলার হিসেবে অপরিশোধিত তেল ভারত কিনেছে। ২০১৮ এবং ২০১৯-২০র হিসেবে এর পরিমাণ যথাক্রমে ব্যারেল প্রতি ৬৯.৮৮ ডলার এবং ৬০.৪৭ ডলার। ২০১৫-১৬ সালে ২,০২৮৫০ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়েছে। ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে অপরিশোধিত তেল আমদানির পরিমাণ যথাক্রমে ২,১৩,৯৩২ মেট্রিক টন, ২,২০৪৩ মেট্রিক টন, ২,২৬,৪৯৮ মেট্রিক টন এবং ২,২৬,৯৫৫ মেট্রিক টন। ভারতে যে অপরিশোধিত তেল আনা হয় তা মূলত দুই প্রকারের। ওমান এবং দুবাই থেকে সাওয়ার গ্রেড ছাড়াও সুইট গ্রেড অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তা ভারতীয় তৈল শোধনাগারে পরিশোধন করা হয়।
পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নির্ধারিত হয়। ২০১০ সালের ২৬শে জুন পেট্রোলের এবং ২০১৪ সালের ১৯এ অক্টোবর ডিজেলের দাম বাজারের দামের সঙ্গে নির্ধারণ করা শুরু হয়েছে। এই সময়ের পর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব তেল সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম নির্ধারণ করে। এই সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক বাজার এবং রুপি ও ডলারের মূল্য অনুসারে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম কখনও বাড়ায়, কখনও কমায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলি প্রতিদিন খুচরো তেলের দাম (পেট্রোল ও ডিজেল) নির্ধারণ করে। ২০১৭ সালের ১৬ই জুন থেকে এই দাম নির্ধারণ হচ্ছে। উপভোক্তাদের সুবিধার জন্য স্বচ্ছভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়।
দিল্লীর বাজারে ইন্ডিয়ান অয়েলের গত ৫ বছরে তেলের দাম :
পেট্রোলের লিটার পিছু দাম
২০১৫-১৬ সালে ৬১ টাকা ৫৯ পয়সা, ২০১৬-১৭ সালে ৬৪ টাকা ৬১ পয়সা, ২০১৭-১৮ সালে ৬৯ টাকা ২০ পয়সা, ২০১৮-১৯ সালে ৭৫ টাকা ৩৭ পয়সা, ২০১৯-২০ সালে ৭২ টাকা ৬৯ পয়সা এবং দোশরা ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই দাম ৭৯ টাকা ১২ পয়সা।
ডিজেলের লিটার পিছু দাম
২০১৫-১৬ সালে ৪৭ টাকা ০১ পয়সা, ২০১৬-১৭ সালে ৫৩ টাকা ২৪ পয়সা, ২০১৭-১৮ সালে ৫৮ টাকা ৭৮ পয়সা, ২০১৮-১৯ সালে ৬৮ টাকা ২২ পয়সা, ২০১৯-২০ সালে ৬৫ টাকা ৭৮ পয়সা এবং দোশরা ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই দাম ৭২ টাকা ৩১ পয়সা।
রাজ্যসভায় আজ এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে এই তথ্য জানিয়েছেন পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী শ্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান।
কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি যে, অজানা নেই যে, Petrol, Diesel-এর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ হল সরকারের চাপানো কর ও শুল্ক। সাধারণ মানুষকে পেট্রোল পাম্প থেকে যে দামে Petrol, Diesel কিনতে হয় তার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশই হল কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারি শুল্ক-কর!
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানান, তেলের উপর ধার্য কর এবং সেস-এর মধ্যে রাজ্য সরকার প্রতি লিটার পেট্রোলে পাচ্ছে ১৮.৪৬ টাকা আর ডিজেলে লিটার পিছু পাচ্ছে ১২.৫৭ টাকা।
মোদী সরকার ২০১৪ সালে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন পেট্রোলে উৎপাদন শুল্ক ছিল প্রতি লিটারে ৯.৪৮ টাকা আর ডিজেলের ক্ষেত্রে উৎপাদন শুল্ক ছিল ৩.৫৬ টাকা। এখন ওই শুল্ক বেড়ে হয়েছে পেট্রলে ৩২.৯০ টাকা এবং ডিজেলে ৩১.৮০ টাকা।
প্রতি লিটার Petrol, Diesel-এ মোট কত টাকা কর দিচ্ছেন জানেন?
তেলের উৎপাদন শুল্কের উপর ডিলার কমিশন জুড়ে যে দাম দাঁড়ায় তার ওপর রাজ্য সরকারের ভ্যাট ও সেস জুড়ে রাজ্য ভিত্তিক দাম স্থির হয়। এই বিপুল পরিমাণ উৎপাদন শুল্কের সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের কর যুক্ত হওয়ার তেলের দাম এখন আকাশছোঁয়া।
কেন্দ্র ও রাজ্যের করের বোঝা কিছুটা মুকুব হলে তেলের দাম হয়তো অনেকটাই কমানো যেত। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই Petrol, Diesel-এর উৎপাদন শুল্ক হ্রাসের সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছে।