*বনেদি বাড়ির দূর্গাপুজো* – *হুগলি জেলার নালিকুলের সিংহ বাড়ির ২০০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপূজা*
প্রতিবেদন: মনোজ কুমার সরকার
প্রায় আড়াইশো বছরের কিছু আগে ঈশ্বর কালিকুমার সিংহ নালিকুল নওপাড়া এবং হুগলী জেলার বিভিন্ন মৌজায় জমিদারি স্থাপন করেন | নওপাড়ার সদরবাড়ি থেকে এই জমিদারির কাজ চালানো হতো | তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসনকালে কালিকুমার সিংহ যথেষ্ট দক্ষতার সাথে জমিদারির কাজ পরিচালনা করতেন | পরবর্তী সময়ে ঈশ্বর কালিকুমার সিংহ ও তাঁর পুত্র সনাতন সিংহ মহামহিম কুলদেবতা রঘুনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই সময় থেকে রঘুনাথজির নিত্য সেবা শুরু হয় | সেই নিত্য সেবা আজও সমানভাবে নিষ্ঠার সাথে করা হয়ে থাকে |
ঈশ্বর কালিকুমার সিংহ-এর মৃত্যুর পরে তাঁর পৌত্র এবং সনাতন সিংহের পুত্র, এককড়িনাথ সিংহ আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে স্বপ্নে চতুর্ভূজ মহামায়া দুর্গার দর্শন পান এবং তাঁর পুজো করার নির্দেশ পান | সেই স্বপ্নাদেশের পরে, এককড়িনাথ সিংহ মহাশয়, হরিপাল থানার অন্তর্গত নালিকুল নওপাড়াতে দুর্গাদালান নির্মাণ করেন | কথিত আছে যে এই দূর্গা দালান পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চতাতে তৈরী | দূর্গা দালান তৈরির সাথে সাথে ওই সংলগ্ন এলাকাতে একটি আটচালা এবং ভিয়েন ঘর তৈরী করেন | এই আটচালা এবং ভিয়েন ঘর ব্যবহার হতো দূর্গা, লক্ষী, মনসা এবং সুবচনী সত্যনারায়ণ পূজার সময়।
পরবতী সময় থেকে এখনও পর্যন্ত একই নিয়ম মেনে সমানভাবে দুর্গাপূজা হয়ে চলেছে | এই পুজোর বিশেষত্ব হলো এখানে মা দূর্গা চার হাতে মা মহামায়া রূপে পূজিত হন | মহাষষ্ঠীতে মায়ের বোধন হয় এবং তারপরের দিন মহাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত ১৫০ কেজি আতপ চালের ভোগ, সঙ্গে ১৫ রকমের ফল এবং ৬০টি নারকোলের নাড়ু ও অন্যান্য পূজার সামগ্রীসহ নিবেদন করা হয় | প্রতিবছর দুর্গা দালানেই প্রতিমা তৈরী হয় | জন্মাষ্টমীর দিন রঘুনাথ মন্দিরে পুজো হয় এবং তার পরেরদিন দুর্গাপ্রতিমার কাঠামো পুজো হয় |
প্রায় চল্লিশ রকমের উপাদান দিয়ে দেবী দুর্গার স্নান সম্পন্ন হয় এবং সিংহবাড়ির নিজস্ব পুকুরে নবপত্রিকা স্নান করানো হয় | সপ্তমী, সন্ধি পুজো এবং নবমীর দিন বলিদানের প্রথা ছিল, বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে সেই প্রথা বন্ধ করা হয়েছে | বর্তমানে বলিদানের জন্য চালকুমড়া, আখ, আদা, গোড়া লেবু ব্যবহার করা হয় | মহাষ্টমীর দিন ‘রচনা’ অর্থাৎ বিভিন্ন রকম রঙিন কাগজের মালা ও সাজসজ্জা দিয়ে আটচালা সাজানো হয় |
সন্ধিপুজোর শুরুতেই ১০৮ টি প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং এখানে উল্লেখ্য যে পুজোর সকল রকম জোগাড় এবং আনুষঙ্গিক কাজকর্ম পরিবারের পুরুষ সদস্যরা করে থাকে | বাড়ির মহিলারা পুজোয় যোগদান করেন, পুষ্পাঞ্জলি দেন এবং অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন | নবমীর দিন প্রথা অনুযায়ী কুমারী পুজো হয় এবং তারপরে হোম এবং ধুনো পোড়ানোর রীতি পালন করা হয় | ধুনো পোড়ানোর উপাচারে পরিবারের মহিলা সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন | দশমীর দিন সকালে অপরাজিতা পুজোর পরে দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গাপূজার সমাপ্তি হয় | বাড়ির পুরুষ সদস্যরা নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাত্রিবেলা মাছ ধরেন এবং তারপরে প্রতিমা নিরঞ্জন করেন | বিসর্জন হবার পর রাত্রিবেলা ‘এক ডালে তিনটে বেলপাতার’ প্রায় ৫০টি এইরকম বেলপাতায় সবাই পাট কাঠির কলম দিয়ে আলতার কালি দিয়ে শ্রী শ্রী দূর্গামাতা সহায় লেখা হয়, তারপর শান্তি জল ও মিষ্টি বিতরণ হয় এবং গুরুজনদের বিজয়ার প্রণাম ও ছোটদের আশীর্বাদ করা হয় | কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন নিয়মনীতি মেনে পারিবারিক লক্ষীপুজো করা হয় |
এইভাবেই নালিকুলের সিংহবাড়িতে দূর্গাপুজো, লক্ষীপুজো এবং তার কয়েকদিন পরে মনসা পুজো ও সুবচনী সত্যনারায়ণ পুজো করা হয়।