ভারতের মরমে আঘাত দিয়েছে কঙ্গনা
পাশারুল আলম
প্রতিবেদন :- জহরলাল নেহেরুকে লিনচিং করতে করতে হঠাৎ করে সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধীকে লিনচিং করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই কাজ করে চলেছে কঙ্গনারা। ভারতভূমিতে এদের সংখ্যা ব্যাপক না হলেও নগন্য নয়। মরমে লেগেছে তাই কিছু কথা বলা আবশ্যক।
কথিত আছে মহাপ্রভু ছিলেন রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। একই রকমভাবে ভারতীয় হৃদয়ে যে যুগল চেতনার প্রকাশ তা হচ্ছে গান্ধী ও নেতাজীর ভাবনা। এদের জীবন দর্শন থেকে ভারতীয়দের বিচ্ছিন্ন করতে গেলে নিজেরাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কাকে বাদ দিবে ভারতীয়রা একজন মহাত্মা আর একজন নেতাজী। কঙ্গনার কথায় একজনকে বেছে নিন। বাছতে গিয়েই এই যুগল বিগ্রহের কথা মনে পরে যায়। ছোট থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছি। একেবারে শিশুকালের প্রভাত ফেরী থেকে আজ অবধি বলে চলেছি, “গান্ধীজী কি জয়, নেতাজী কি জয়”। হঠাৎ করে আত্মস্থ করা এক স্লোগান মন থেকে মুছে দিতে চায় কঙ্গনারা।
গান্ধী আর নেতাজীকে আলাদা করার আগে তাদের দুইজনের সম্পর্ক কেমন ছিল একটু যাচাই করে নিই। মানুষের সঙ্গে মানুষের দুই প্রকারের সম্পর্ক থাকে। এক, আদর্শগত সম্পর্ক, দুই, ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এর বহু শাখা প্রশাখা রয়েছে। মূল দুই শাখায় এই দুই ব্যক্তিত্বের চাহিদা একই। দুজনেই ভারতীয় আত্মায় সমাহিত। দুইজনেই চেয়েছিলেন স্বাধীন এক ভারত। তাদের গন্তব্যস্থল একই লক্ষ্যে। কেউ পথভ্রষ্ট নয়। লক্ষ্য এক থাকলেও পথ চয়নে ভিন্নতা ছিল। উভয়ে তাদের জীবন উৎসর্গ করে ছিলেন দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে। এই ভাবনা থেকে কেউ কোনোদিন একচুল সরে আসেনি। তাই দুই পথে চলেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। তাই মানুষ এদের শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছেন।
কংগ্রেস সভাপতির আসনে দেশব্যাপী সমর্থন পেয়েও সুভাষ বোস এর সভাপতি না হওয়া যেমন সাধারণ মানুষের কষ্টের কারন তেমনি নেতাজী যখন গান্ধী সম্পর্কে বলেন, “সমস্ত দেশের বিশ্বাস আমি জিতেছি, আমি চাই দেশের অন্যতম সেরা মানুষটির বিশ্বাস জয় করতে।” গান্ধী সম্পর্কে নেতাজীর এই ভাবনাকে অস্বীকার করার উপায় কোথায় ? নেতাজীর এই কথা শুনে সব কষ্ট কমে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুভাষ বোস যখন জার্মানীরকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামিল, সেই সময় আমেরিকার সাংবাদিক লুই ফিশার গান্ধীকে নেতাজীর বিষয়ে জানতে চান, ‘এই লোকটির বিষয়ে আপনার ধারণা কি ?’ এর উত্তরে গান্ধীজী যা বলেছিলেন তা কঙ্গনাদের জানা উচিত। তিনি বললেন, ” বোস ওয়াজ আ প্রেট্রিয়ট এমঙ্গ প্রেট্রিয়ট।” অর্থাৎ তিনি ছিলেন দেশপ্রেমীর দেশপ্রেমী। নেতাজী সম্পর্কে গান্ধীজীর এই ধারনা একইভাবে ঊনিশ শ চুয়াল্লিশ সালে বার্লিন রেডিও থেকে তার দেওয়া শেষ ভাষণে নেতাজী, গান্ধীজীকে রাষ্ট্রপিতা হিসাবে সম্বোধন করেছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের পথ ছিল চরম পন্থার। তাই তিনি সেই পথ বেছে নিয়েছিলেন, আর গান্ধীজী ও নেহেরু ছিলেন নরম পন্থার। তাই তারা সেই পথে হাটেন। তাই বলে কেউ কাউজে কোনোদিন আজকের দিনের মতন কামড়াকামড়ি করেননি। তাদের পরস্পরের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাভাব। এই শ্রদ্ধাভাব থেকেই আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়নের নাম তিনি রেখেছিলেন “গান্ধী ব্যাটালিয়ন ও নেহেরু ব্যাটালিয়ন।” এই থেকেই প্রমান হয় গান্ধী ও নেহেরুকে তিনি অস্বীকার করেননি বরং তাদের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। সঠিক হোক বা বেঠিক হোক, সংবাদ এলো, নেতাজী সুভাষ নিহত। সেদিন প্রকাশ্য সভায় নেহেরু সজোরে কেঁদেছিলেন। এরপরও কি সন্দেহ থাকার কথা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ততার ছিল। তা যে ছিল না সে কথা অনিতা বোস ও সুজাতা বোস অকপটে স্বীকার করেছেন। তারা গান্ধী ও নেজাজীর সম্পর্ক বিষয়ে বলেন, ‘উভয়ের সম্পর্ক ছিল ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার।’ এরপরও কি কঙ্গনাদের গবেষণালব্ধ তত্ব বিশ্বাস করতে হবে ?
নেতাজী ও গান্ধীজী পথ আলাদা আলাদা হলেও যখন গান্ধীজীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী ভারতছাড়ো আন্দোনল শুরু হল। তখন সমস্ত দেশ উত্তাল। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই সংবাদ নেতাজীর কানে পৌঁছানোর পর তিনি তার সহযোগী সি,এম, নাম্বিয়াকে বলেন, ” এই সময়ে আমি যদি সঙ্গী হয়ে থাকতে পারতাম।” প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কঙ্গনারা যাদের হয়ে গলা ফাটান সেদিন তারা কোথায় ছিলেন ? এই বিষয়ে কঙ্গনার টুইট থাকলে সাধারণ মানুষ সমৃদ্ধ হতে পারতেন। গান্ধী আর নেতাজী সম্পর্কের ছেদ টানতে চাইলেই তা যে করা সম্ভব নয়, তার অজস্র প্রমান বিরাজমান। ঊনিশ শ চুয়াল্লিশ সালে কস্তুরবা পরলোক গমন করলে নেতাজী বলেন,” আজ ভারতের মায়ের মৃত্যু হয়েছে।” কস্তুরবার প্রতি নেতাজীর কতটা শ্রদ্ধা থাকলে তিনি এই কথা বলতে পারতেন। বর্ণিল রেডিও মারফৎ নেতাজী যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন, তখন তিনি তার ভাষণে গান্ধীজীর আশীর্বাদ কামনা করে তার ভাষণ শুরু করেন। একইভাবে আমরা দেখি নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ঊনিশ শ চুয়ান্ন সালে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। শুধু তাই নয়, নেতাজী পত্নীকে আজীবন দার্জিলিং এর চা পাঠান। তাই বলা যায় গান্ধী, নেহেরু ও নেতাজীর সম্পর্ক নিয়ে জলঘোলা করায় তার উদ্দেশ্য। এই বিষয়ে অনিতা বোসের কথায় স্মরণ করা যেতে পারে, তিনি বলেন, গান্ধীজি অনেককেই দেশের স্বাধীনতার নিয়ে আসার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। এমনকি নেতাজি তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল বলে মত অনিতা বোসের।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি কঙ্গনা তাঁর ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে দাবি করেন, সুভাষ চন্দ্র বসু এবং ভগৎ সিং, মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে কোনও সমর্থন পাইনি। গান্ধীর অহিংসার মন্ত্রকে উপহাস করে তিনি বলেন, অন্য গাল বাড়িয়ে দিলে আপনি ভিক্ষা পাবেন, স্বাধীনতা নয়। এছাড়াও আরও বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরে যা সমর্থন যোগ্য নয়, কঙ্গনা বলে দেশ ঊনিশ শ সাত চল্লিশ সালে প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি, সেটা ছিল ভিক্ষে পাওয়া, আসল স্বাধীনতা এসেছে দুই হাজার চৌদ্দ সালে ।
গান্ধী সম্পর্কে জনগন ও কংগ্রেস কি বলল, তার চেয়ে বড় কথা মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট কি বলে। একটা দুইটা মামলায় নয়, একাধিক মামলায় বিচারকরা গান্ধী সম্পর্কে টিপ্পনী করেছেন। অখিল ভারতীয় শোষিত কর্মচারী সংঘ বনাম ভারতীয় রেল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন, মাউন্ট এভারেস্টের মতন উপস্থিতি রয়েছে রাষ্ট্রপিতার। এখানে মহাত্মা গান্ধী না বলে সরাসরি রাষ্ট্র পিতা বলেছেন, একইভাবে প্রদীপ জৈন বনাম ভারত সরকার মামলায় বলেন, এক রাষ্ট্রের কল্পনা ছিল তার, তার মধ্যে দিয়েই একতা গড়ে উঠেছে, সঠিকভাবে তাঁকে রাষ্ট্রপিতা বলা হয়েছে। এছাড়া একাধিক মামলায় গান্ধীর জীবন আদর্শ ও বাণীর উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন দিল্লির মহল আর গরিবের ঘরের তফাৎ যদি থাকে তাহলে দেশে একদিন সংঘর্ষ হবে। গান্ধীর বাণী উল্লেখ করা হয়েছে বচ্চন সিংহ মামলায়, সেখানে বলা হয়েছে, যে ভুল করেছে তাকে মেরে কোনো লাভ নেই। গান্ধীজী মনে করতেন পাপী নয়, পাপকে ঘৃণা কর।
এইভাবে ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও সংবিধানে গান্ধীর উপস্থিতির কথা বারবার মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন মামলায় রায়ে উঠে এসেছে। তাই আমরা দেখি কেশবানন্দ ভারতী মামলায় জাস্টিস এস,এন, দুবেদী বলেন, ভারতীয় সংবিধানে উপর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবকে ছোট করে দেখতে চায় কঙ্গনা। কঙ্গনা নেতাজী সহ শহীদ ভগত সিংহ সম্পর্কেও মতামত দিয়েছেন, এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ভগত সিংহের ফাঁসি স্থগিত করার জন্য গান্ধীজী লর্ড এডমিনকে চিঠি লিখেন। এতে গান্ধীর অনুরোধ গ্রহণ করা হয়নি বরং নির্ধারিত ঊনিশ শ একত্রিশ সালের চব্বিশ মার্চ এর পরিবর্তে তেইশে মার্চ ফাঁসি দেওয়া হয়। ভগত সিংহ বিষয়ে কঙ্গনার রাজনৈতিক পূর্বজদের কোনো পত্রাদি থাকলে কঙ্গনার প্রকাশ করা উচিত। কেননা শহীদ ভগত সিংহ ভারতীয়দের নয়নের মনি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মত ও পথ ভিন্ন ভিন্ন হলেও লক্ষ্য অভিন্ন ছিল। তা হল ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। তাই প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতীয়দের কাছে সমান শ্রদ্ধার।