আজ গোয়া, কাল মেঘালয় পরশু ত্রিপুরা, এই ভাবে কংগ্রেসকে দুর্বল করে কি বিজেপিকে সামনের লোকসভায় পরাজিত করা সম্ভব? কিন্তু তৃণমূল তাহলে কি উদ্দেশ্যে এই কাজটা করছে? নিন্দুকেরা প্রশ্ন করছেন, কে বা কারা কি উদ্দেশ্যে এই ঘোড়া কিনতে টাকা দিচ্ছেন? কোনও লড়াই ছাড়া, কেন তৃণমূল এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে উঠতে চাইছে?
শুভজিৎ বাগচী :- তৃণমূল কংগ্রেস বছরখানেক আগে ‘খেলা হবে’ শব্দবন্ধ দিয়ে তাদের থিম সং বানিয়েছিল। তখন বোঝা যায়নি খেলা কোন দিকে ঘুরবে। শেষে ‘জয় শ্রী রামের’ বিরুদ্ধে ‘খেলা হবে’ জিতলেও, যত দিন যাচ্ছে, ততই বিষয়টি আরও অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে না, কে কার পক্ষে খেলছে বা কে এই মুহুর্তে কার বিপক্ষে আছে? অথচ খেলা কিন্তু হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের পরে বিজেপি থেকে বহু নেতা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। নীচের তলার ছোট কর্মী থেকে ওপর তলার তারকা প্রার্থী অনেকেই নানান কারণে বিজেপি ছাড়ছেন। কিন্তু বাংলার বাইরে বিজেপি নয়, মূলত কংগ্রেসকে ভাঙছে তৃণমূল। আসামের বাঙালি–অধ্যুষিত তিন জেলায় কংগ্রেসের প্রধান মুখ সুস্মিতা দেব ছিলেন জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের মহিলা সংগঠনের প্রধান। তাঁকে তৃণমূল শুধু নিয়েই আসেনি, রাজ্যসভাতেও পাঠিয়েছে। সুস্মিতার সঙ্গে বেশ কিছু সংগঠকও কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে এসেছেন। লখিমপুর খেরির ঘটনার পরে, এই সুস্মিতা দেবের নেতৃত্বে তৃনমূল কংগ্রেসের মুখপাত্রেরা পৌঁছেছিলেন দুর্ঘটনাস্থলে। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরায় তৃণমূলের প্রায় পুরো নেতৃত্বটাই কংগ্রেস থেকে এসেছে। যখন ত্রিপুরায় সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, তখন এই সুস্মিতা দেবকে দিয়েই একটি নিন্দাসূচক বয়ান দেওয়ানো হয়। তৃতীয়ত, পশ্চিম ভারতের গোয়ায় কংগ্রেসের দুবারের মুখ্যমন্ত্রী (মেয়াদ পূর্ণ করেননি) লুইজিনহো ফেলেইরো ও তাঁর সঙ্গী–সাথীদের দলে নিয়েছে তৃণমূল। এই কারণে ফেলেইরো বলেছেন, কংগ্রেস টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে এবং মমতাই আগামী দিনে একটি নতুন ও সংযুক্ত কংগ্রেস তৈরি করবেন। অর্থাৎ, আগামী দিনে তৃণমূলই হবে কংগ্রেসের বিকল্প।
অন্যদিকে একক শক্তি হিসেবে দল ধরে রাখতে পারছে না কংগ্রেস। অনেক রাজ্যেই কংগ্রেসের প্রধান নেতার সঙ্গে সেই রাজ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। যেমন রাজস্থান কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোটের সঙ্গে অল্পবয়স্ক নেতা শচীন পাইলটের বৈরিতা গোপন নয়। পাঞ্জাবে দল ছেড়ে দিয়েছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং। কংগ্রেসের ভেতরেই প্রায় দুই ডজন নেতার বিক্ষুব্ধ জি-২৩ গোষ্ঠী রয়েছে। এই গোষ্ঠীর নেতা কপিল সিবাল বর্তমানে তৃণমূলের আইনজীবী। কজন তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছেন, তা নিয়ে জল্পনা অব্যাহত। আর এক আইনজীবী নেতা অভিষেক সিংভি তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, তৃণমূল আগামী দিনে কংগ্রেসের অনেক হেভিওয়েট নেতাকে রাজ্যসভায় পাঠাবে, যেমন পাঠিয়েছে সুস্মিতাকে।
কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব যে ক্রমে বাড়ছে, তা বোঝা যায় রাহুল গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকে। উত্তর প্রদেশে কৃষক হত্যার পর তৃণমূলকে বিজেপি সরকার আক্রান্ত কৃষকদের সঙ্গে দেখা করতে দিয়েছে, কিন্তু কংগ্রেসকে বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রাহুল গান্ধী। অন্যদিকে মমতা দলের মুখপত্রে লিখেছেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মঞ্চ করতে চান না ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেসকে বুঝতে হবে তারা পরপর দুবার বিজেপিকে হারাতে ব্যর্থ হয়েছে।
‘দিল্লিতে যদি লড়াই না থাকে, তবে লোকের মনোবল ভেঙে যাবে। সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না’—লিখেছেন তৃণমূল নেত্রী। আর ৮ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যমে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের ছত্তিশগড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্রী লড়াই হয়ে গেছে। তাঁরা পরস্পরের শীর্ষ নেতৃত্ব রাহুল গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তীব্র আক্রমণ করেছেন। এটা এখন পরিষ্কার, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রধান শরিকদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
অবশ্যই লাভ বিজেপির। কারণ, ভাঙাচোরা কংগ্রেস এখনো ভারতে ২৮টির মধ্যে অন্তত অর্ধেক রাজ্যে ক্ষমতাসীন বা প্রধান বিরোধী দল। অথবা ক্ষমতায় থাকা দলের শরিক—যেমন তামিলনাড়ু বা মহারাষ্ট্রে। দুর্বল হলেও কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট গঠন করা অসম্ভব। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ১৩৫ বছরের দলটিকে ভাঙছেন, তখন তিনি বিরোধী জোটের প্রধান দলকেও দুর্বল করছেন। যেমন গোয়ায় কংগ্রেস শক্তিশালী। আগামী বছরের নির্বাচনে কংগ্রেসের জেতার সম্ভাবনাও আছে। সেখানে কংগ্রেসকে ভেঙে দেওয়ার অর্থ বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ করে দেওয়া। এতে লাভ বিজেপিরই। কাল যদি মমতা পাঞ্জাবে অমরিন্দর সিং বা রাজস্থানে শচীন পাইলটকে ওই রাজ্যে তৃণমূলকে নেতৃত্ব দিতে আমন্ত্রণ জানান, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
মমতার দোষ কোথায়?
ভারতে অনেকেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব পেয়ে নিজের রাজ্য নিয়ে খুশি থাকেন। মমতা সেই গোত্রের নন, তিনি দলকে বাড়াতে চান। রাহুল গান্ধী যদি তাঁর দলকে বাড়াতে না চান, তবে তার দায় মমতার নয়, রাহুলের। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়া রাজনীতি হয় না আর মমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই তা তাঁর কোনও সমালোচকই বলবেন না। ফলে তিনি যদি মনে করেন মোদি বনাম রাহুল নয়, ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনে খেলা হবে দিদি বনাম মোদির, তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না।
এ ছাড়া রাহুল গান্ধীর এখনো কোনো বড় রাজনৈতিক সাফল্য নেই। সেখানে মমতা ১০ বছর আগে ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। দুবার (২০১৬, ২০২১) বিজেপিকে হারিয়েছেন এমন নির্বাচনে, যেখানে হিন্দুত্ববাদী দলটি জেতার জন্য পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি হেরে যাওয়ার পর ভারতে আর কেউ মনে করেন না যে রাহুলের নেতৃত্ব মমতার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব। নিজের জন্য জাতীয় স্তরে এই জায়গাটা তৈরি করে, তা কংগ্রেসের হাতে তুলে দেওয়ার লোক মমতা নন।
আরও একটা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের রাজনীতিতে নানান সূচক একত্র করে দেখলে বোঝা যায় এই মুহূর্তে বিজেপি ও কংগ্রেসের পরে তৃতীয় স্থানটি দখল করে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ৩ থেকে রাতারাতি ১ নম্বরে পৌঁছে বিজেপিকে স্থানচ্যুত করতে পারবেন না। তাঁকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে ২ নম্বরে। সেটা করতে গেলে তাঁকে কংগ্রেসকে স্থানচ্যুত করতে হয়। অর্থাৎ, জাতীয় স্তরে মমতার প্রাথমিক প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিক বিজেপি নয়, যেমনটা ছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। জাতীয় স্তরে মমতার প্রাথমিক প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস। তাই কংগ্রেসকে স্থানচ্যুত করতেই কি তিনি কংগ্রেসকে ভাঙার চেষ্টা করছেন?
এটা মমতাও বোঝেন, যে কারণে তাঁর খেলাটা হলো কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে একটা পৃথক ‘মিনি’ জোট তৈরি করা। এই জোটে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ছোট রাজ্যের কিছু এমপি থাকবেন, কিছু হেভিওয়েট কংগ্রেস নেতা মমতাকে সমর্থন দেবেন (কিছু প্রভাবশালী বিজেপি নেতা, যাঁরা দলের মধ্যে মোদিবিরোধী কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না, তাঁরাও পরোক্ষ সমর্থন দিতে পারেন) এবং কিছু অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী যেমন ঝাড়খন্ডের হেমন্ত সরেন বা অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু মমতাকে তাঁদের নেত্রী হিসেবে মেনে নেবেন। একই সঙ্গে কিছু আঞ্চলিক নেতা, যেমন উত্তর প্রদেশের অখিলেশ যাদব বা বিহারের তেজস্বী যাদব মমতার হয়ে সওয়াল করবেন। এদের দুজনের সঙ্গেই মমতার সম্পর্ক ভালো। এসবের পাশাপাশি যদি তিনি শারদ পাওয়ারের মতো প্রভাবশালী নেতার সাহায্য পান, তাহলে কংগ্রেস ১০০–এর বেশি আসন পেলেও প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। এই ফর্মুলায় ভারতে অতীতে অনেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মমতার উত্থানে ও বিজেপি বিরোধিতার মুখে কংগ্রেস যদি শ-খানেক আসন না পায়, তবে জাতীয় স্তরে বিজেপি তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসবে। তখনই স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে এই খেলায় শেষ পর্যন্ত লাভ হলো কার, ক্ষতিগ্রস্তই–বা হলো কে।
ভারতের রাজনীতির জটিল সমীকরণ বলছে কংগ্রেস ছাড়া বিজেপির বিরুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। ভারতের লোকসভায় ৫৪৩ আসনের মধ্যে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে গোটা পঞ্চাশেক আসন পেলেও অনেক রাজ্যেই কংগ্রেস প্রধান বিরোধী শক্তি। যদিও গোয়ার বিধানসভা নির্বাচনের জন্য তৃণমূলের পরিচিত মুখ মহুয়া মৈত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখে মনে হচ্ছে, তৃণমূল এবং কংগ্রেস দু দলই, একটু ধীরে চলো নীতি নিয়েছে। কংগ্রেসও বুঝতে পারছে, মানুষের কাছে যদি কোনো ‘গ্রহণযোগ্য বিরোধীপক্ষ’ না তুলে ধরা যায়, এবং তার ফলে তারা যদি ২০২৪-এর নির্বাচনে ১০০ আসন না পায়, তবে বিজেপিকে হারানো অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল লোকসভায় ৪২-এ ৪২ পেলেও বিজেপিকে হারানো সম্ভব নয়। তাই কি এখন দু দলের পক্ষ থেকেই একে অন্যকে আক্রমণ করা স্থগিত রাখা হয়েছে? তৃণমূল এমন কিছু রাজ্যে যাচ্ছে, যেখানে কম সিট, এবং কিছু সিট যদি তারা পেয়েও যায়, বা সেই রাজ্যে যদি তারা জিতেও যায়, কংগ্রেসের খুব ক্ষতি হবে না, এবং বিরোধী ঐক্যতে ফাটল ও ধরবে না।