ত্যাগের উৎসব ও খুশির উৎসব দুই ঈদ

Spread the love

ত্যাগের উৎসব ও খুশির উৎসব দুই ঈদ

ফারুক আহমেদ :- ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীমকে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন:
“ তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর।”
ইব্রাহীম স্বপ্নে এরূপ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং ইব্রাহীম শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজ্জের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়।

যখন ইব্রাহীম আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তার পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এটি ছিল ছয় সংখ্যক পরীক্ষা। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ ইব্রাহীমকে তার খলিল (বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেন।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি উদ্‌যাপন করে। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানি চলে। হিজরি চান্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সর্বোচ্চ ৭০ দিন হতে পারে।

ঈদুল আযহা বা ঈদুল আজহা বা ঈদুল আধহা হচ্ছে ‘ত্যাগের উৎসব’‎, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের দ্বিতীয়টি। এই উৎসবটি কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। এই উৎসবকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী দুম্বা, গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে।

ঈদ শব্দটি আরবী। ‘আউদ’ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ হল পুনরাগমন যা বারবার ফিরে আসে। বৎসরান্তে নির্দিষ্ট সময়ে বারংবার ফিরে আসে বলেই এই মিলন ও সম্প্রীতির উৎসবের নাম হয়েছে ঈদ। ঈদ সকলের মনে আনে খুশি। তাই খুশির উৎসব হল ঈদ। খুশির জন্য চাই সকলের খোলামেলা মন। মুক্ত মনের বহিঃপ্রকাশেই ঈদ মিলন উৎসব সার্থক হয়। তাই ঈদের আনন্দ খুশি ছড়িয়ে পড়ে সংকীর্ণ ভেদ-বুদ্ধির সীমানা আলগা করে জাতি ধর্ম-বর্ণ ও ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে সকল সম্প্রদায়ের কাছে চিরন্তন সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, শাশ্বত প্রেম ও মহা মিলনের খুশির বার্তা নিয়ে।
‘ফিতর’ অর্থে খুলে খুলে যাওয়া মুক্ত হওয়া বা পূর্ণতা প্রাপ্ত যা সমাপ্ত হওয়া বুঝায়। কেউ কেউ ফিতর অর্থে শেষের পর্বে খাওয়ার অর্থ বুঝে থাকেন। তাই ঈদ-উল-ফিতর সেই বিশেষ দিনটির নাম, যেদিন দীর্ঘ এক মাস রমজানের নিয়মানুগ কঠোর উপবাস, এবাদত ও সবরকম অপরাধ থেকে দূরে থাকার বিধিনিষেধ, অনুশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সাধানায় নিযুক্ত থেকে পুনরায় দৈনন্দিন আহারের নিযুক্ত হওয়ার অনুমতি। আসলে ঈদ-উল-ফিতর হল আল্লাহ’র কাছ থেকে পাপমোচন করে নিজেকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা। তাই মহা আনন্দে পালিত হয় এই খুশির উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। নবী করিম (সঃ) বলেছেন—“নিশ্চয়ই প্রত্যেক জাতির ‘ঈদ’ অর্থে আনন্দোৎসব আছে। তাই আজকের দিন অর্থৎ ঈদ-উল-ফিতর হল আমাদের সকলেরই সেই খুশির ঈদ।” ঈদ সারা বিশ্বে সকল মানুষের জন্য প্রসন্নতার সুখবর এনে দেয়। ঈদের দিন সকল সামর্থ্যবান মুসলিমকেই মুক্ত হাতে ফেতরা, জাকাত, সাদকা ও দান খয়রাত করতে হয়। যার ফলে, আমাদের সমাজের প্রতিটি আর্ত পীড়িত অসহায়, বিপন্ন সর্বহারা ও হতদরিদ্র মানুষেরাও এই খুশির ভাগ নিতে পারেন। এখানেই এই মিলন উৎসবের সার্থকনামা সকলের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়। ঈদ হল ত্যাগের, ধৈর্যের, ক্ষমার, ভালবাসার, সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক। সকলের মনে ন্যায় ও নীতিই সঞ্চারিত করার পক্ষে আদর্শ।
সকল মুসলিম রমজান মাসে রোজা রেখে ক্ষুধা ও তৃষ্ণাকে ভুলে গিয়ে কঠোর সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে নিজের দোষ ত্রুটি সংযোধন করে আত্মশুদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর হয়ে আল্লাহ’র নৈকট্য লাভ করতে পারেন। নবী করিম (সঃ) বলেছেন- ‘যে রোজা আমাদের আত্মশুদ্ধি করে না, সেই রোজা প্রকৃত রোজা নয়, তা নিছক উপবাস মাত্র যা গন্ধহীন ফুল কিংবা নিষ্প্রাণ দেহ মাত্র।’ তাই খাদ্য ও পানীয় থেকে দূরে থাকার নাম রোজা নয়। প্রকৃত রোজা হল অন্যায় ও অসৎ চিন্তা থেকে বিরত থাকা।
‘রমজান’ শব্দের অর্থ হল অগ্নিদগ্ধ। যে মাসে রোজা পালনের মধ্য দিয়ে অনাহারের তীব্র দহনজ্বালা ও সহনশীলতার কঠিন পরীক্ষা, সেই মাসের গুণাগত নাম হল রমজান। রোজার উপবাস দ্বারা প্রশমিত হয় রোজদারের অসৎ চিন্তা ও কুমনোবৃত্তি। সীয়াম সাধনায় মানুষরের মনে বেড়ে যায় তাঁর আত্মিক, মানসিক ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি। তাই মাহে রমজানে মুসলিমদের মনে ও সমাজে নেমে আসে, দয়া-মায়া, স্নেহ-প্রীতি, ভক্তি-করুণা ও সহনশীলতার মতো অজস্র সৎ চিন্তার বিচিত্র সমারোহ।
মুসলিম জাহানে রমজান মাস হল রহমতের মাস, বরকতের মাস, গোনাহ পাপ মাফ হওয়ার মাস, আল্লাহ’র অসীম করুণায় নৈকট্যলাভের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস, ধৈর্যের মাস, সাধনার মাস ও সকল দুস্থ গরিব, অনাথ ও দীন-দুঃখীর সাহায্য করার মাস। প্রকৃত সমাজ বিকাশে ও শিক্ষা প্রসারের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ারও মাস। তাই শাশ্বত কালের চিরন্তন সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রীতির বন্ধন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতর জাতীয় সংহতির জ্বলন্ত প্রতিক হল মহামিলনের মহোৎসব ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ পালনে জাতিধর্ম নির্বিশেষে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মধুর আলিঙ্গণের মধ্যে খুঁজে পাই—বৈচিত্রের মধ্যে একতার মধুর ও অনাবিল ঐকতানের আনন্দ খুশির অত্যুজ্বল সুবর্ণময় তিথি। ঈদ বয়ে আনুক বিশ্বের সকল মানুষের জন্য অফুরন্ত শান্তি সুখ ও সমৃদ্ধি এবং গভীর ভালবাসা। তাই আসুন, আমরা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে দূরে ঠেলে ঈদ মিলনের মধ্য দিয়ে সম্পীতির বন্ধনে ও আলিঙ্গণে আবদ্ধ হয়ে প্রকৃত মানুষ রূপে নিজেদেরকে গড়ে তুলি। আর তা করতে পারলেই দেশ ও দশের সত্যি মঙ্গল হবেই। সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা ও মানুষের ক্ষতিসাধন থেকে সাধারণ মানুষদের বুঝিয়ে সৎ পথে আনতে পারলেই সমাজ উপকৃত হবে। তখনই মহতি ঈদ পালনের উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মনে করি। তাই এই সমাজকে শিক্ষা সচেতন করে তোলা জরুরি। ঈদ মিলনের ময়দানে জায়নামাজে দু’হাত তুলে শেষ দোয়ায় শপথ নিতে হবে আমাদেরকে সকলের জন্য সুস্থ সমাজ গড়ার। মনের মধ্যে রাগ-অভিমানকে কমিয়ে নিজেদের অধিকার নিজেদেরই অর্জন করতে হবে। কারণ কারও মৌলিক অধিকার কেউ পাইয়ে দিতে পারে না, তা নিজ যোগ্যতায় ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও কাটাকাটি না করে, কে কী দিল আর দিল না, এই ভেবে সময় নষ্ট করার থেকে যার যেটুকু ক্ষমতা আছে তাই দিয়ে নিজের অনগ্রসর সম্প্রদায়কে টেনে তুলতে হবে। পাড়ায়-পাড়ায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত প্রতিভাদেরকে শিক্ষা আলোয় আলোকিত করতে হবে নিজেদেরই। তাহলে সমাজ ও দেশ এগিয়ে যাবে সামনে আরও সামনে। ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মুসলিম বলে কিছু হবে না। এমন ধারণা পোষণ করা পাপ। ইসলাম সৎ পথে সঠিক লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়। পারতেই হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী তিনদশক পর থেকে পশ্চিমবাংলার অনগ্রসর মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষা প্রসার ঘটাতে বসন্ত এনে দিয়েছেন মোস্তাক হোসেন। বর্তমানে মুসলিম দরদী সহমর্মী মোস্তাক হোসেনকে অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম উঠে আসুক সমাজকল্যাণে। অনুপ্রেরণা অবশ্যই মোস্তাক হোসেন।

লেখক: সমাজকর্মী, প্রকাশক ও সম্পাদক: উদার আকাশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.