নগরের দাদা পীরের মেলা –
-:আনিসুর রহমান:-
ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্থান অর্থাৎ ভারতীয় উপ মহাদেশে সুফি দরবেশ আওলিয়া ফকির গাজীদের ইসলামের প্রচার প্রসার ,সেটাকে কেন্দ্র করে মাজার দরগা গোটা উপমহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । দরগা মাজারে সিন্নি দেওয়া,সেটাকে কেন্দ্র করে মেলা বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের একটা ঐতিহ্য ।
এই বাংলাতেও ইসলামের প্রচারে পীর দরবেশদের ভুমিকা কম ছিলনা। “সূফী ফকির দরবেশ ও গাজীরা তখন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে নববিজিত ভূমিতে ইসলাম বিস্তারের চেষ্টা করতে লাগল। লুণ্ঠন ও ধ্বংস অপেক্ষা ধর্মপ্রচার ও আধ্যাত্মিক বিচারই হতে থাকে রাজ্য বিস্তারের প্রধান অঙ্গ।” (¡) মুসলমান শাসকরা এই পীর গাজীদের জমি দিতেন বসতি গড়তে। তাঁরা বাংলার গ্রাম গঞ্জকে বেছে নেন ধর্ম প্রচারের জন্য। “যে সূফী পীরেরা বঙ্গদেশে এসেছিলেন তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন ঘরানার। এঁদের মধ্যে বিশেষ করে চিশতিয়া, কালান্দারিয়া, মাদারিয়া, কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দি, আহমদিয়া এবং নকশাবান্দিয়া সম্প্রদায়ের সূফীরা এ দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।”[ii] সুফিদের মধ্যে সালিক (শরিয়তে বিশ্বাসী) এবং মজ্জুব (শরিয়তে বিশ্বাস প্রায় নেই) এই দুই শ্রেণী ছিল। মজ্জুব ফকিররাই বাংলায় সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে। বাংলার হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনার সবচেয়ে বড় নিদর্শন পীরপূজা। “পীর বলতে শাহ্, শেখ, মুরশিদ, ওস্তাদ, সূফী প্রমুখ সাধুসন্তদের বুঝাত। মুসলমান সেনাপতিগণও যুদ্ধে নিহত হলে গাজী-পীর রূপে পূজিত হতেন। …. পীরের দরগাসমূহের প্রতি হিন্দু মুসলমান উভয়েই সমানভাবে শ্রদ্ধা ও অর্ঘ্য নিবেদন করত।”[iii] ফারসি ‘দরগাহ’ শব্দের প্রতিশব্দ মাজার। আওলিয়া দরবেশদের সমাধিস্থল মাজারে পরিণত হয়। দরবেশদের জন্ম মৃত্যু তিথিতে মাজারে উৎসব পালিত হয়ে থাকে। কবরকে মসজিদ বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই মাজারে নামাজের চল নেই। মাজার কেন্দ্রিক এই “পীরপ্রথার উৎপত্তি-স্থল হল ইরান-আফগানিস্থান। কিন্তু বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে এ প্রথার উর্বর ভূমি প্রস্তুত হয়েই ছিল তান্ত্রিক গুরুবাদ ও বৈষ্ণব গোঁসাইবাদ-এর মাধ্যমে।….. অতীতের দেব-দেবীদের কাছে যেমন নানা কারণে লোকেরা মানত করত, পূজা করত, বলিদান করত, সন্ধ্যাবাতি জ্বালাত পিরের দরগায়ও মানত করা, জীবিত বা বিদেহী আত্মার কাছে প্রার্থনা, সমাধিতে সন্ধ্যাবাতি দেওয়া, ধুপধোঁয়ার স্থলে আগরবাতি বা গন্ধবাতি জ্বালানোর রেওয়াজ হয়ে যায়।”[iv]
এই ভাবেই শুরু হয় সিন্নি দেওয়া ,দরগায় ধূপ ধূনো দেওয়া , এই মাজারকে ই কেন্দ্র করে শুরু হয় মেলা ।
মেলা- বাংলা ব্যাঞ্জন বর্ণমালার থেকে মাত্র দুটি অক্ষর নিয়ে তৈরি হওয়া এই শব্দটি ছোট হলেও তার ব্যাপকতা বিশাল। মেলায় যেমন আগত দর্শনার্থীরা-ক্রেতা বিক্রেতারা পরস্পর ভাবের আদান-প্রদান করেন পাশাপাশি অপর দিকটি হলো পণ্যের বেচাকেনা। গ্ৰামের একঘেয়ে জীবনের মধ্যে বন্দী মানুষ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রাণ পায়। একঘেয়েমি দূর হয়, দূরে যায় প্রতিদিনের যাপনের ক্লান্তি, সংকীর্ণতা। মনের প্রসারতা বাড়ে, মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, সামাজিকতার বন্ধন দৃঢ়তর হয়। একটি মেলা আঞ্চলিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বহন করে। তাই বহু যুগ থেকেই পুজো, যজ্ঞ, আবির্ভাব, তিরোভাব প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে কোনো মন্দির এলাকায়, নদীর ধারে বা সমুদ্রের তীরে মেলা বসে আসছে। এই ধারা আজও অব্যাহত।
মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার অন্তর্গত খড়গ্ৰাম থানা এলাকার আতাই গ্রামে নগরের পীরের মেলা এরকম এক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে ।
আনুমানিক দুশো বছরেরও বেশি আগে ‘সাহচাঁদ বাদশা’ নামে এক ফকির আতাই গ্ৰামে এসেছিলেন। জনশ্রুতি, তিনি নানারকম অলৌকিক কার্যকলাপ দেখাতে পারতেন। তা দেখে মানুষ তাঁকে দাদা পীর বলে ডাকত। এই গ্ৰামে একটি দিঘি ছিল যার নাম বড়দিঘি, সেই দিঘির দক্ষিণ পাড়ে বাস করতেন।কথিত আছে ৫৯৬ সালের ২০পৌষ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। সেই বড়দিঘির দক্ষিণ পাড়েই দাদা পিরের মাজার রয়েছে। এই মাজারকে কেন্দ্র করেই বসে মেলা । কথিত রয়েছে দাদা পিরের প্রিয় শিষ্য দাউদ আলি প্রায় দুশো বছর আগে এই মেলার প্রচলন করেন। এখানে দাদা পিরের ভক্তরা তাদের মনোস্কামনা জানিয়ে মানত করেন। মানত পূরণ হলে ভক্তরা এই মাজারে হাঁস, ছাগল, ভেড়া বলি দেন। রান্না করা মাংস, ভাত “সিন্নি” দেওয়া হয়। মিষ্টির দোকান, তেলেভাজার দোকান, খেলনা পুতুলের দোকান, নাগরদোলা, লোহার জিনিস থেকে জুতোর দোকান সবই বসে এই মেলায়। ফকির বাউলরা এসে দেহতত্ত্বের গান গেয়ে বেড়ান। পুতুলনাচের আসরও থাকে। খুশির উপকরণ অঢেল। মাটির ঘোড়া এবং কাঁকনাড়ু বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এই মেলার নিজস্ব খাবার জিনিস হলো কাঁকনাড়ু। দাদা পীরের মেলা ছাড়া এই খাদ্যবস্তুটি কোথাও পাওয়া যায় না। দাদা পীরের মেলা মানেই নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলায় পরিবেশিত হয় আলকাপ, যাত্রা, নাটক। এই মেলায় পুরুষদের থেকে মহিলাদের ভিড় বেশি হয়। হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়। বিপুল মানুষের সমাগমে এই মেলা অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে।।
আবার এটাও জানা যায় বহূ
বছর আগে সৈয়দ শাহচাঁদ বাতলা ইরাকের বাগদাদ শহরের বাসিন্দা ছিলেন। সেখান থেকে খড়গ্রাম থানার মণ্ডলশ্বর গ্রামে আসেন। তাঁর কাছে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নেন ওই থানার আতাই গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য। তারপর থেকে গুরু ও শিষ্য মিলে নগরে থাকতে শুরু করেন। সৈয়দ শাহচাঁদ বাতলা এলাকায় ফকির বলেই পরিচিত ছিলেন। সৈয়দ শাহচাঁদ বাতলার নিজস্ব প্রচুর শিষ্য ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখ্য দাউদ হোসেন। গুরু শিষ্য মিলেই বহু বছর আগে ওই মেলার সূচনা করেন। আজও ওই মেলা একই ভাবে হচ্ছে বলে দাবি।
তিন দিন ধরে মেলায় গুরু ও শিষ্যের নামে ভোগ দেওয়া হয়। ওই পিরের আস্থানার খাদিমদের দাবি প্রতি বছর ১৯ পৌষ ওই উৎসব শুরু হয়। প্রথম দিন ৩৭টি গোটা মুরগির মাংস ও আতব চালের ভাত রান্না করে মাঝরাতে ভোগ দেওয়া হয়। পরের দিন সকালে ওই ভোগ পিরের আস্তানায় আসা দুঃস্থদের বিলি করা হয়। একই ভাবে দ্বিতীয় দিন ৮৪টি গোটা মুরগির মাংসের ও আতপ চালের ভাত রান্না করে মাঝ রাতে ভোগ দেওয়া হয়। শেষ দিন অর্থাৎ তৃতীয় দিন সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। ওই ভোগকে গ্রামীণ ভাষায় ‘সিজেনো’ বা গোটা সিদ্ধ বলা হয়ে থাকে। সিজেনো তৈরি করতে আড়াই কেজি কালো কাঁচাকলাই, বরবটি আড়াই কেজি সঙ্গে তিনটি সাদাগোটা লাউ, পাঁচ কেজি সাদা সিম, পাঁচ কেজি সাদা পুঁইশাক, পাঁচ কেজি গোটা বেগুন লাগে। ২০০ গ্রাম চিনি ও একশো গ্রাম গাওয়া ঘি এক সঙ্গে একটি বড় হাঁড়িতে দিয়ে সিদ্ধ করে মাঝরাতে ভোগ দেওয়া হয়।
আরো তথ্য পাওয়া যায় দাদাপীরের পূর্ব পরিচিতি প্রসঙ্গে জানা যায় উনি গৌড়ের বাদশাহ হোসেন শাহের সময়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইরাকের বাগদাদ শহরের বদল নামে এক জনপদ থেকে এসে, বর্তমান নগরের নিকট আতাই গ্রামে বসবাস শুরু করেন, এবং পরবর্তী জীবন কাল নগরের বুকে অতিবাহিত করেন।
নগরের মেলার প্রথম সূচনা সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা ঠিক এই রকম। সৈয়দ দাউদ আলি তালুকদার পিতা ইফতে খার তালুকদার, নগর নিবাসী মহঃ রফিকে পীর সাহেবের মাজার শরীফ, ও মাজার সংলগ্ন আমবাগান সহ জমি জায়গা পরিচর্যা করা জন্য মোতাওয়ালি ও খাদেম নিযুক্ত করেন।
এক সনদনামা দলিলের মাধ্যমে। উক্ত দলিলে জায়গার মোট পরিমাণ কত, তালুকদারের নিবাস কোথা? এই মর্মে কিছু উল্লেখ নেই।
আনুমানিক ধারণায় জায়গার মোট পরিমাণ ১৫০ বিঘার মতো। বর্তমানে দীঘি সহ ৫০থেকে ৬০ বিঘা ওয়ারীশ খাদেমদের অনুকূলে আছে। উক্ত সনদ নামার সম্পাদিত তারিখ ৯ই রজব ১১৫৪ হিজরী সন। বর্তমান হিজরী সন ১৪৩০। উক্ত সন হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে ২৭৬ বৎসর পূর্বে মেলার সূচনা পর্ব শুরু হয়েছিল।
তথ্যসূত্র : ওয়ারীশ খাদেম তোরাব উদ্দিন (প্রাথমিক শিক্ষক) এর নিকট।
এভাবেই চলে আসছে নগরের পীরের মেলা । এখন প্রতি বছর ২০ শে পৌষ নগরের এই মেলা বসে ,হাজারো হাজারো মানষের সমাগমে জমে উঠে এই মেলা । এলাকার মানুষেরা এই মেলাকে কেন্দ্র করে আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রন করে ,নব বিবাহিত জামাইদের বিশেষ ভাবে এই মেলাকে কেন্দ্র করে নিমন্ত্রন করা হয় ।
বর্তমানে পীরের সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি ,এই নিয়ে সুপ্ত দ্বন্দ্ব আছে খাদিমদের মাঝে।তবুও এই মেলার ঐতিহ্যা আজও অপরিশীম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-
[i] বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা- প্রথম খণ্ড, গোপাল হালদার, এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোং, ১৩৮০, কলিকাতা, পৃ.৩৮
[ii] হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, অবসর, ২০০৬, ঢাকা, পৃ.৬৭
[iii] বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, ড০ অতুল সুর, সাহিত্যলোক, ২০১২, কলকাতা, পৃ.২২৭
[iv] বাংলাদেশ ও ইসলামঃ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আলোচনা, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৯, ঢাকা, পৃ. ১৮১-১৮২
[v] বীরভূমি বীরভুম, সম্পাদনা – বরুণ রায়, প্রথম খণ্ড, প্রাচীন মসজিদ মাজার ও সুফি সাধক গণ- এ মান্নান, দীপ প্রকাশন, কলিকাতা, পৃ.২৩৬,২৪২
২)বিশেষ কলম -২ এম. মনিরুল হক,”মুর্শিদাবাদের একটি প্রচীন পৌষ মেলা” পৃষ্ঠা নং- ৮৩-৮8
৩) বাংলার মেলা কথা – আতাই নগর -দাদা পীরের মেলা = অনলাইন জিও বাংলা – প্রকাশিত ১৩/০২/২০২২
8)আনন্দ বাজার অনলাইন কৌশিক সাহা ,প্রকাশিত ০৭/০১/২০২৩