৭৩ বর্ষের ঐতিহাসিক হরিণ খালির বনবিবি মাতার মিলন মেলায় উপস্থিত এলাকার বিশিষ্ট জনেরা
মোমিন আলি লস্কর জয়নগর
-জয়নগর থানার অন্তর্গত জয়নগর এক নম্বর ব্লকে জাঙ্গালিয়া অঞ্চলের রামরুন্দ্রপুর গ্ৰামে মা বনবিবি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সুন্দরবন এলাকায় বনজীবীদের আত্মবিশ্বাসী একনারী শক্তির নাম বনবিবি। যিনি জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালীদের বাঘরুপী অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। এই বাঘরুপী অপশক্তির হাত থেকে যেমনটি রক্ষা পেয়েছিল সুন্দরবন এলাকার লোক সংষ্কৃতির শিশু চরিত্র দুঃখে।
বছরে মাঘ মাসের ২ তারিখ পৌষ সংক্রান্তিতে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এই দিন পশ্চিমবঙ্গে সুন্দর বন এরিয়ার মধ্যে বিভিন্ন এলাকা মা-বনবিবির মন্দির আছে , বিভিন্ন জায়গায় থেকে নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধ, সকল ধর্মের মানুষ এই মা-বনবিবি মেলা দেখতে চলে আসেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থানটি পরিনত হয় লোকসংস্কৃতির এক মিলন মেলায়। এখানে সকল ধরনের খাবার, কাঁচাসবজী, ফল ও মাছও বিক্রয় হয়।
প্রতিবছর শীত মৌসুমী ২রা মাঘে সমগ্র সুন্দরবন উপকূলে এলাকা জুড়ে সুন্দরবন নির্ভরশীল বনজীবীরা সুন্দরবনের উপর জীবন জীবিকায় নিরাপত্তায় লক্ষ্য বিশ্বাসে বনবিবি পূজা করে থাকেন। বাংলা১৩৬৮ সালে ছটুলাল মন্ডল এবং সুরেশ মন্ডল বর্তমানে মা-বনবিবির মন্দির যেখানে অবস্থিত আছে সেই জমিতে ধান কাটার সময় কথপকথনের মধ্য দিয়ে রামরুন্দ্রপুর মাতা বনবিবি মেলার শুভ উদ্বোধন হয়। কথায় বলে “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”তেমনি দৃশ্য রামরুন্দ্রপুর গ্ৰামে১৩৬১ সালে ঘটনা ঘটেছিল। সেই উপলক্ষে পূজা উদযাপন শুরু হয়। রামরুন্দ্রপুর মাতা বনবিবি মেলার উপলক্ষে বারুইপুর পূর্বের বিধায়ক বিভাস সরদার ও বারুইপুর ব্লক সভাপতি শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী সহযোগিতায় সাংসদ শ্রীমতি মিমি চক্রবর্তী তহবিল থেকে একটি সাবমার্শাল বসিয়ে দেন।এই উদ্যোগ দেখে মাতা বনবিবি মিলন মেলার পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ অভিনন্দন জানিয়েছেন বারুইপুর পূর্বের বিধায়ক এবং সাংসদ মিমি চক্রবর্তী এরকম সহযোগিতায় জন্য।”মাতা বনবিবি মেলার সভাপতি শৈলেন্দ্র নাথ মন্ডল বলেন -আমাদের মেলার কমিটির পক্ষথেকে রাজ্যসরকারের কাছে কাতর আবেদন সবস্থদিক দিয়ে যেমন রাজ্যসরকার আমাদের হাতবাড়িয়ে দিয়েছে ,**ঠিক তেমনি ভাবে আমরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাছে আবেদন রাখছি আমাদের মাতা বনবিবি মেলার স্থলে তেমন কোন ইলেকট্রিক সুবিধা নেই যদি মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মেলাস্থল পর্যন্ত ইলেকট্রিক ব্যবস্থা করেন ,তাহলে আপনাদের এই মাতা বনবিবি মিলন মেলা আরো উন্নতির দিকে যাবে।আমরা আশা রাখি আগামী বছর পর্যন্ত আমাদের এই দাবি রাজ্য সরকার মেনে নেবেন।*
তেমনি জাঙ্গালিয়া অঞ্চলের হরিনখালির মাঠে অর্থাৎ হরিনারায়নপুর, বামনগাছি, জাঙ্গালিয়া অঞ্চলের সন্নিকটে মাঠে বহু পুরানো মা-বনবিবির মন্দির অবস্থিত, বহুদিন যাবত থেকে এই মন্দিরের ২ রা মাঘ পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে পূজা অর্চনা হয় এবং একদিনের মিলন মেলা বসে । এই মিলন মেলায় লক্ষ্যধিক মানুষের সমাগম ঘটে।মেলাটি একদিনের জন্য অনুষ্টিত হয়,মেলাকে মুখরোত তলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ঘুড়ি ওড়ানোর উৎস । দুরদুরান্ত থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই মিলন মেলায় বেড়াতে আসে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে অনেকে তাদের আনন্দের উৎস ঘুড়ি ওড়ানো মেতে থাকেন।এই মেলা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সর্ব ধর্মের মানুষের মিলন ক্ষেত্র।মাতা বনবিবি মিলন মেলায় বিভিন্ন জায়গায় মানুষ কে উৎফুল্ল করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক মূলক অনুষ্ঠান করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল মাতা বনবিবি কাছে শান্তি বর্ষিত হওয়া প্রার্থনা করার জন্য মেলা কমিটির পক্ষথেকে হোমযোগ্য করা হয় ।এই মেলা প্রাঙ্গণে জয়নগর থানার আইসি পার্থ সারথি পালের নেতৃত্বে পুলিশের কড়ানিরাপাত্তার মাধ্যমে এ বছর এই মিলন মেলাটি সুষ্ট শান্তি শৃংখলার মাধ্যমে মেলাটি সুসম্পন্ন হয়।
**মাতা বনবিবি মেলায় এসেছিলেন কুলতলী থানার অন্তর্গত গোরনকাটী গ্ৰাম থেকে এসেছিলেন দেবলা ঘোষ তাহার আটহাজার টাকা হারিয়ে যায়।একটি বাচ্ছা মেয়ে মলিহাটি গ্ৰামে এই টাকা কুঁড়িয়ে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা কে নিয়ে মাতা বনবিবি মেলার অনুসন্ধান অপিসে জমাদেন। অনুসন্ধান অপিস থেকে মাইক প্রচার পর কুলতলী থানার গোরনকাটী গ্ৰামের দেবলা ঘোষ পাগলের মত হয়ে ছুটে আসেন অনুসন্ধান অপিসের দিকে। কমিটি সঠিক প্রমাণ পেয়ে হারিয়ে যাওয়া টাকা তুলে দেওয়া হয়। তিনি হারানো টাকাপেয়ে কমিটি কে এবং মলিহাটি গ্ৰামে বাচ্চা মেয়ে প্রতি অভিনন্দন এবং মাতা বনবিবি মন্দিরে ২০০টাকা দান করলেন ও বাচ্ছা মেয়ে জন্য মার কাছ আশীর্বাদ করেন**।
লোকাকাহিনীতে বন বিবির ইতিহাসের কথা জানা যায়। অনেক পুরানো সেই ইতিহাস।
এতদ্বকালে সুন্দরবনে সে সময় দ্বন্ডবক্ষ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল্য সব্যসাচী তার স্ত্রী রায়মনি, তাদের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল। প্রজাকুলের দেখভাল করতেন। কথিত আছে জঙ্গলে যত দানব দৈত্য ভূতপ্রেত ডাকেনি যোগিনী সব তার অনুগত্য ছিল। তার ছিল ৩৭ কোটি সিপাহি লসকার সমুদ্র সৈকতে কোনো একখানে ছিল তার রাজধানী।
তাদের ছিল একটি সন্তান নাম দক্ষিণারায়, সে দিনে দিনে দস্তর পরক্রমশালী হয়ে ওঠে। তপস্যা বলে বাঘ মূর্তি ধারণ করে মানুষ ধরে খেত। মানুষ ভীতি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। কেউ আর বাদাবনে মধু সংগ্রহ করতে যেতে পারে না। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকলো মানুষজন। পরম করুনাময় খোদাতালা দুষ্টের দমনের জন্য বনবিবি ও শাহ জঙ্গলি কে দুনিয়ায় পয়দা করলেন। ১৮ ভাটিতে যাওয়ার জন্য হুকুম করলেন।
বনবিবির পিতৃপরিচয়ে তৎকালীন মক্কর ধর্মভিরু দরিদ্র এবরহিম ফকিরের দ্বিতীয় স্ত্রী গুলাল বিবির গর্ভে বনবিবি ও শা-জঙ্গলী নামে জমজ ভাই বোনের তাদের মা বনবাসে থাকাকালীন সুন্দরবনের মধ্যে জন্ম হয়। উল্লেখ্য এবরহিম ফকির তার ১ম স্ত্রী ফুলবিবির সঙ্গে ওয়াদা রক্ষার্থে তার কথামতো পুণ মাসে নিষ্ঠুরভাবে গুলাল বিবিকে বনবাসে পাঠায়। পরম করুনাময় রাব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপায় জঙ্গলে দুই ভাই বোন ফলমূল হরিণদুগ্ধ পানে বড় হতে থাকে
এক পর্যায়ে দুই ভাই বোন মা ও বাবা ইব্রাহিম ফকিরের সঙ্গে জঙ্গলে তাদের মিলন ঘটে। তারা বাবা মায়ের কান্নাকাটি উপেক্ষা করে দুই ভাই বোন আল্লাহর ডাকে মদিনাতে চলে যান। ওখানে নবীজির আওলাদ এক কামেল সাহেবের কাছে মুরিদ হলো। মারফত কালাম বিদ্যায় তালিমও নিল। খোদার দরবারে দুই ভাই বোন মোনাজাত করলো। আল্লাহ পাক সন্তুষ্টিতে তাদের উপর ওহী নাযিল হলো।
তোমাদেরকে খেলাফত দান করা হলো। ১৮ ভাটিতে চলে যাও। আল্লাহপাক সব সময় তোমাদের সঙ্গে থাকবে। ওখানে ১৮ হাজার জাত (জীব) পয়দা আছে। তুমি যে ১৮ ভাটিতে সবার মা। বিপদে পড়েছে তোমাকে মা বলে ডাক দিবে তাদের উদ্ধার করবে। সেই থেকে বনবিবি বনের দেবতা, মা বলেই জানেন সবাই। বন বিবির পুথীর ইতিহাসে বলা হয়েছে মায়ের প্রথম পূজা ও তার কীর্তি থেকে বনবিবি ও শা-জঙ্গলী মদিনা থেকে অনেক কষ্ট সহে ভাটির অঞ্চল ১৮ ভাটিতে পৌঁছায় এবং ভুরকুন্ডে তার শিকড় গাড়েন।
এখানে ছিল সেই দুষ্টু শাসক দক্ষিণা রায় তার মা রায় মনিকে যুদ্ধে পরাজিত করে সন্ধি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য জঙ্গলে বাদাবনের প্রথম মৌয়াল ধুনাই মৌলে তার বহর নিয়ে জঙ্গলে যায় মধু ভাঙতে। মধু না পেয়ে এক সময় চতুর দক্ষিণা রায়ের সঙ্গে তার দলের পাচক ছোট ছেলে দুখে কে খেতে দিলে তার সপ্তবহর মোম মধু ভরিয়ে দেবে। ফন্দি করে চতুর্থ ধোনাই মৌলে দুখেকে কেঁদো খালি নামক স্থানে কাঠ কাটার জন্য তুলে দেয়।
দক্ষিণা রায় বাঘ রূপ ধারণ করে দুখে কি খেতে আসলে তার অশীতিপর বৃদ্ধ মায়ের আদেশ মত বনবিবিকে মা-মা বলে চিৎকার করতে থাকে। মা-সঙ্গে সঙ্গে মক্ষি রূপে ছুটে আসে। আক্রান্ত দুখে কে কোলে তুলে নিয়ে জলের ছিটে দিলে জ্ঞান ফিরে আসে। দুখে কে অনেক ধন দৌলত দিয়ে সেঁকো নামক কুমিরের পিঠে তুলে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন। দুখেকে বাঘে খেয়েছে বলে ধোনাই মৌলের মিথ্যা প্ররোচনায় দুঃখের মা পাগল বেশে ঘুরতে থাকে।
দুখেকে পেয়ে তার বৃদ্ধ মা হয়ে মা বনবিবি সন্তুষ্টির জন্য গলায় কুড়াল ঝুলিয়ে সাত সাতগ্রাম মাং (ভিক্ষা) চাল চিনি দুধ দিয়ে রান্না করে বনবিবির পূজায় দেওয়া হল। সেই থেকে যুগ যুগ ধরে অদ্যবধি চলে আসছে মায়ের নামে পুথি পাঠ করে বন বিবি পূজা করা। যেহেতু বন বিবি ইসলাম ধর্মীয় অনুকরণীয় তাই তার পূজায় সকল শ্রেণীর মানুষসহ বনজীবিরা ক্ষীর রান্না করে মোরগ উড়িয়ে মানত নিবেদন করেন।
বনবিবি মা আছেন সুন্দর বনে, থাকুন তিনি অমর হয়ে। নবনির্বাচিত জেলা পরিষদের সদস্য তপন কুমার মন্ডল বলেন তিনি সামনের বছর একটি স্টিললাইট ব্যবস্থা করবেন।
মাতা বনবিবি মিলন মেলায় উপস্থিত ছিলেন জয়নগর থানার আইসি পার্থ সারথি পাল জয়নগর পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এবং জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য তপন কুমার মন্ডল ও তুহিন বিশ্বাস সহ জয়নগর থানার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এবং বিশিষ্ট গুরুজন নেতৃত্বেরা