বিদেশে বিপদগ্রস্থ পরিযায়ী শ্রমিকের ভরসা মুর্শিদাবাদের মতিউর
প্রতিবেদন :- বিদেশে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে পরিযায়ী শ্রমিক ,সৌদি আরব,কুয়েত,কাতারের যে কোন জায়গায় ,অসহায় পরিবারের লোকজন ভরসা মুর্শিদাবাদের মতিউর । দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভরসা সেই মতিউর।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ। এই কর্ণসুবর্ণের যদুপুর গ্রামে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম মতিউর এর। আজ তিনি পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বাইরে বিদেশে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকদের ভরসা। ছোটোবেলা থেকে অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানো তাঁর নেশা। পাড়ার কেউ বিষ খেয়েছে, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কারও রেশন কার্ড নেয়, তাঁর রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা, এলাকার টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা সারানো ব্যবস্থা করা সব কাজেই এগিয়ে এসেছে মতিউর। বর্তমানে গ্রাম ছেড়ে জেলা তথা রাজ্যের বিপদ্গ্রস্থ পরিযায়ী শ্রমিকদের ভরসা হয়ে উঠেছে মতিউর। মুর্শিদাবাদ জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। যদি ২০১১ সালের আদম সুমারি অনুসারে জনসংখ্যা ৭১ লাখ। এই বিপুল জনসংখ্যার একটি বড় অংশের জীবিকা শ্রমিক। তারা কেউ অন্যের জমিতে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত, কেউ বা জেলা বা রাজ্য ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যে কৃষিকাজ, ছোট – বড়, মাঝারি কলকারখানায়, কেউ বা নির্মানশিল্পে শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত। আবার কেউ দেশের বাইরে বিদেশে কর্মরত। পরিবার আত্মীস্বজন ছেড়ে দেশের বাইরে সৌদি আরব, দুবাই, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, ইরান, ইরাক ও জর্ডানে সাফ সাফায় থেকে নানাবিধ কাজে নিযুক্ত। এই সব শ্রমিকদের কেউ নিরক্ষর, কেউ বা শুধু নাম সই করতে জানা, আবার কেউ বা মাধ্যমিক পাশ। এরা বিদেশে কাজের নিয়ম নীতি জানে না। তাই এইসব শ্রমিকদের বিদেশে পাঠিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি মোটা টাকা মুনাফা লুটছে। এইসব অসাধু ব্যক্তির খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পরিবারটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিক মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিদেশ থেকে ফিরতে পারছে না। কেউ থাকছে জেল এ, কেউ বা বেল এ। দেশে ফেরা আর হচ্ছে না। আর অপরদিকে পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবার লিপ্ত হচ্ছে পরকীয়ায়। আর তাঁদের ছেলেমেয়ে হচ্ছে স্কুলছুট বা মোবাইলে আসক্ত। সমাজে চলছে বাল্যবিবাহ, নারী নির্জাতন, শিশুশ্রমিক, পণপ্রথা, ডিভোর্স, এর মতো অসামাজিক কাজ। এই সব বিপদ্গ্রস্থ পরিবার সদস্যগণ দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ব্যাক্তির দ্বারে দ্বারে। এখানেই সাহায্যের হাত বাড়ি দিচ্ছে মতিউর। বিদেশে কর্মরত ছেলে বা স্বামী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, মালিক পাসপোর্ট আটকে রেখেছে, বেতন দিচ্ছে না, অধিক কাজ করাচ্ছে, একামা দিচ্ছে না, ছেলে ভেগে গিয়ে অনত্র কাজে চলে যাওয়ার কারণে বাড়ি ফিরতে পারছে না, মালিক মোটা অঙ্কের গেরামা লাগিয়ে দিয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকটি মারা গেছে লাশ দাফন করতে হবে, লাশ দেশে ফেরাতে হবে সবকিছুরই সমাধানে এগিয়ে আসছে মতিউর। মতিউরের কথায় ২০১৭ সালে তাঁর এক আত্মীয় মালয়েশিয়াতে কর্মরত অবস্থায় বাজ পড়ে মারা যায়। লাশ দেশে ফেরানোর জন্য ছুটে যায় পুলিশ প্রশাসন থেকে সর্বত্র। চিঠি লেখেন জেলাশাসক থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে। সব জায়গাতেই হতাশ। কেউ বলে বিদেশে মারা গেছে লাশ এনে কি হবে। কেউ বা বলেন মারা গেছে অনেক বিদেশী টাকা পাবে, পরিবারের চিন্তা দূর হবে। কেউ বা বলেন চারজন যান বিদেশে গিয়ে লাশ নিয়ে আসুন। এই সব কথা শুনে মতিউর অসহায় হয়ে পড়ে। অবশেষে টুইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন ততকালীন বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মহাশয়ার সাথে। পাশাপাশি দুবাইএ বিদেশ দপ্তরে কর্মরত আই পি এস, শ্রী রাহুল শ্রীবাস্তব মহাশয়ার সাথে। উনাদের যৌথ উদ্যোগে মাত্র ৭ দিনের মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে তাঁর আত্মীয়ের লাশ ভারতে ফিরেছিল। তারপর থেকে দিকে দিকে মতিউরে নাম ছড়িয়ে পড়ে। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে মতিউর প্রায় ১৮০ জন মানুষকে স্বশরীরে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। যাদের কারও কোনো খোঁজ ছিল না। পরিবার ভেবে নিয়েছিল তাঁদের ছেলে মারা গেছে , সেই ছেলেকে ফিরিয়ে এনে পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। এই কাজে মতিউর পাশে পেয়ছেন সমাজসেবিকা সেই সাথে ল-ইয়ার ডঃ বন্দনা শ্রীবাস্তব মহাশয়াকে। উনি সর্বদা আড়ালে থেকে মতিউরকে সাহায্য করে চলেছেন। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সাথে যোগসূত্রের কাজ করে দিচ্ছেন ডঃ বন্দনা শ্রীবাস্তব মহাশয়া। দূতাবাসে কর্মরত অফিসারগণও মতিউরকে সাহায্য করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। বিদেশে কর্মরত দুতাবাসের অফিসারদের সাথে টুইট, মেল, হোয়াটস, ও ফোনের মাধ্যমে অনবরত যোগাযোগ রেখে কাজ করে চলেছেন মতিউর। একে অপরের সহযোগিতায় পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে পাচ্ছে তাদের পরিবারকে, পাচ্ছে নতুন জীবন। মৃত ব্যক্তির পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোটা টাকার ক্ষতিপূরণ। কান্দি থানার পুরন্দরপুর গ্রামের সানোয়ার সেখের পরিবার পেয়েছেন প্রায় ভারতীয় টাকায় ১১ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ। মতিউর আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিদেশে প্রায় ২৪জন পরিযায়ী শ্রমিক বিদেশ থেকে ফিরতে পারছে না। তাঁদের মধ্যে ৯জন বিভিন্ন কারণে জেল এ আছে, ৪ জন নিখোঁজ আছে, মালিকের কাছে পাসপোর্ট আটকে আছে ৪ জন, বেতন সমস্যায় ভুগছে ৫ জন আর দুজনের নামে মালিক গেরামা লাগিয়ে রেখেছে, একজনের নামে ২৪,০০০ রিয়াল আর একজনের নামে ক্যাশবাক্স চুরির কেশ। অপরদিকে হাওড়ার একটি পরিবারের ছেলের লাশ। যে ছেলেটি মারা যাওয়ার ১৫দিন পর পরিবার জানতে পারে তাঁদের ছেলে আর এই পৃথিবীতে নাই। পরিবার এখন দিন গুনছে ছেলের লাশ দেখার অপেক্ষায়। মতিউর এইসব কাজ করে চলেছে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়। বিদেশে বিপদ্গ্রস্থ পরিবারকে মতিউরের বার্তা পাসপোর্ট এর আবেদনের সময়, নাম ঠিকানা সহ জন্মতারিখের পরিবর্তন না করা। বিদেশে যাবার সময় দালাল এর সাথে টাকা পয়সার লেনদেন এর উপযুক্ত ডকুমেন্ট করে রাখা, ভিসা টা অবশ্যই ৯০ দিনের বা ট্রাভেল ভিসায় বিদেশে কার করতে না যাওয়া, কাজের চুক্তিপত্রের নামে ফাঁকা কাগজে সহি বা টিপসহি না করা। এই সব ডকুমেন্টগুলো ভালো ভাবে যাচাই করে বিদেশে যাওয়া। অন্যদিকে পরিবারকে সচেতন হওয়ার বার্তা দিয়েছে মতিউর যেমন পাসপোর্টের কপি, ভিসার কপি, ইমিগ্রেশনের কার্ড নম্বর, মালিকের নাম ঠিকানা ও ফোন নং কাছে রাখা। পরিযায়ী শ্রমিকটি বিদেশে সমস্যায় পড়লে মালিকের সাথে যোগাযোগ করা যায়। পাশাপাশি ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা যায়।