মানবতা বেঁচে আছে- বাবুরাম মন্ডল

Spread the love

অয়ন বাংলা :-     কৃষ্ণনগর কালেক্টারি অফিসে টাঙ্গানো স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্যানেলে নিজের নাম দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না।
শেষ পর্যন্ত জিতেছি। লড়াই সার্থক। আমি শিক্ষিকা হতে চলেছি।
চোখের জল মুছে সর্বপ্রথম যার কথা মনে পড়ল তিনি আমার অচেনা। এখনো তাকে চোখে দেখিনি। মনে হচ্ছিল এক ছুটে চলে যাই সেই অজানা মানুষটির কাছে। গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলি আপনার পাঠানো টাকার মর্যাদা আমি রেখেছি। আপনি আমায় জন্ম দেননি ঠিকই কিন্তু আপনিই আমার বাবা। আমার পথপ্রদর্শক। আমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন। লড়াইয়ের হাতিয়ার।
প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়েই প্রতিজ্ঞা করলাম মাইনে পেয়ে প্রথম ওনার কাছে যাব। দেখা করব। যে করেই হোক খুঁজে বের করব। ভারতবর্ষের যেখানেই থাকুন।
মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর এই অসহায় গরিব মেয়েরটির খবর পেপারে বেরিয়ে ছিল। পিতৃমাতৃহীন মেয়েটি পয়সার অভাবে পড়তে পারবেনা সে খবরও ছিল দৈনিকটিতে।
এরপর হঠাৎই একদিন একটি চিঠি পাই। তাতে আমার পড়াশোনার সম্পূর্ণ খরচ কেউ একজন বহন করবেন বলে লেখেন। শর্ত একটি। কাউকে জানানো যাবে না। দেখাও করা যাবে না।
সেই টাকায় পড়াশোনা করে আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। চাকরি পেয়েছি। স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। কিন্তু পেছন থেকে যিনি সাহায্য করেছেন মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছেন তিনি রয়ে গেছেন একেবারে অন্তরালে।
প্রথম মাইনে পেয়ে মানি অর্ডারগুলো থেকে নাম ঠিকানা জোগাড় করে গরমের ছুটিতে চলেছি সেই অচেনা ভগবান দর্শনে। যাচ্ছি আপাতত নিউ ফরাক্কা স্টেশন। সেখান থেকে তালতলা পোস্ট অফিস। ওখান থেকেই নিয়মিত টাকা আসে।
স্টেশন নেমে জানলাম তালতলা পোস্ট অফিস খুব দূরে নয়। স্টেশনের বাইরে থেকে ঘোড়ায় টানা টমটম যায়।
আশেপাশের লোকজন জানালেন কাছেই ভারত সেবাশ্রম সংঘ আছে। সেখানে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা দুটোই হতে পারে।
ঘোড়ায় টানা টমটমে সেবাশ্রমে পৌঁছে সংঘের সভাপতি সত্যানন্দ বাবাজীর কাছ থেকে জানা গেল পোস্ট অফিস কাছেই। পোস্টমাস্টারের নাম হরিআনন্দ রায়। স্টেশনের পশ্চিম দিকে একটু গেলেই নাকি তার বাড়ি।
সব মিলে গেছে। ঠিক জায়গায় এসেছি মনে হয়।
সামান্য রেস্ট নিয়ে তড়িঘড়ি এসেছি পোস্ট অফিসে। উত্তেজনায় একটু আগেই আসা হয়ে গেছে। বাইরে পথের পাশে গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। আরো কয়েকজন আছেন। বেশিরভাগই বয়স্ক। সম্ভবত রিটায়ার। তারা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছেন।
ঠিক দশটায় এক ভদ্রলোক এলেন। নিজ হাতে তালা খুললেন। তারপর ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন অফিসে।
দেখে মনটা কেমন ভরে গেল। ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন গভীর পদ্মপুকুর। গৌরকান্তি ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠাম বলিষ্ঠ দেহ। মাথার চুল গুলো পেকে দুধ সাদা। যেন শুভ্রকান্তি যোগী পুরুষ।
বয়স্ক লোকগুলোর কাছে গিয়ে জেনে নিলাম পোস্টমাস্টারের পরিচয়। তারপর ধীর পায়ে গেলাম উনার কাছে। গিয়ে ভণিতা না করে বললাম, আমি মৌলি। চিনতে পারছেন। যাকে আপনি প্রতি মাসে টাকা পাঠান!
ভদ্রলোক আমার মুখ পানে চেয়ে রইলেন অপলক। অনেকক্ষণ। শেষে চোখের চশমা খুলে ধুতির আচলে মুছে অবাক হয়ে বললেন, ও আচ্ছা! তুমি তাহলে মৌলি! বাহ। বোসো বোসো। তোমার কথা খুব আলোচনা হয়। ও হ্যাঁ শোনো, টাকা পাঠাই ঠিকই, কিন্তু টাকাটা আমার নয় মা। আর একজনের। তিনি মাসে মাসে এসে দিয়ে যান। উনি লেখাপড়া জানেন না তো তাই। আমার নামেই তোমাকে পাঠাই। তোমার কথা পেপারে দেখে উনাকে আমিই গল্প করেছিলাম। শুনে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। কেঁদেছিলেন। তারপর আমার হাত দু’টি ধরে অনুরোধ করে বলেছিলেন আমি টাকা পাঠাবো। আপনি ব্যবস্থা করে দিন। মেয়েটা পড়াশোনা করে মানুষ হোক।
তারপর থেকেই তিনি নিয়মিত এসে টাকা দিয়ে যান। আর প্রতিবার এসে একটিই অনুরোধ করেন। দয়া করে আমার নামটা লিখে পাঠাবেন না। দান যে গোপনে করতে হয়।
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলেন ভদ্রলোক।
কথা শুনে আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। তাহলে ইনি সেই লোক নন! আমার স্বপ্নে দেখা মানুষ তাহলে ইনি নন! মনটা কেমন ভেঙে গেল। যাই হোক।
শেষে অনেক কষ্টে অনেক অনুরোধ করে উনার কাছ থেকে অজানা সেই মহৎ মানুষটির ঠিকানা আবার জোগাড় করলাম।
হরিআনন্দ বাবু অনেক গল্প করে চোখের জল মুছে বলে দিলেন, তিনি তো মা এখন এখানে থাকেন না। আগে থাকতেন। কিছুদিন পূর্বে তার বাপের বাড়ির দেশ বিহারে চলে গেছেন। সেখানে থাকেন। এখান থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে শ্রীঘর সাত নম্বর গঙ্গার চরে। আরো বললেন ‘কনি’ এই নামটি বললে সবাই চিনিয়ে দেবে।
মন খারাপ হলেও হরিআনন্দ বাবুর থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম আবার তালতলা ঘাটে। এখান থেকেই ভটভটিতে নাকি শ্রীঘর চর যাওয়া যাবে।
পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে পথে আসতে আসতে ভাবছিলাম যেকোনো লোকের কাছে কনি শুধুমাত্র এইটুকু বললেই চিনবে! আশ্চর্য। এতটাই প্রভাবশালী!
হোক না প্রভাবশালী। তবু একবার দেখা করবো। বিনম্র চিত্তে বলবো আমি আপনার জন্যই চাকরি পেয়েছি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
তালতলা ঘাট থেকেই উধুয়াগামী ভটভটি পাওয়া যায়। ওতেই শ্রীঘর চর যাওয়া যাবে। ওদের বললে ওরাই নাকি নামিয়ে দেবে। বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন পোস্টমাস্টার ভদ্রলোক।
প্রায় ঘন্টাখানি অনেকের সঙ্গে ঘাটে অপেক্ষা করতে হলো। বহুডুবি নামক গঙ্গার একটি শাখা নদী ধরে চরে আমাকে পৌঁছাতে হবে।
যেতে যেতে দেখলাম, নদীর দু’ধারেই গ্রাম। বাড়ি-ঘর বেশিরভাগই শুকনো গমগাছ দিয়ে ছাওয়া।
হেলতে দুলতে যখন চরে পৌছালাম রীতিমতো দুপুর গড়িয়ে গেছে। নদী থেকে উঠেই ছোট্ট একটি বাজার। বাজারের সঙ্গে লাগানো স্কুল, তার ঠিক উল্টোদিকে একটি সাদা রংয়ের মন্দির। চারিদিকে পেঁয়াজ রসুনের কটু গন্ধ। বোঝা গেল বাজারটিতে নিয়মিত পেঁয়াজ রসুন কেনা বেচা হয়।
দুপুর বলে বাজার বন্ধ। একদম ফাঁকা। লোকজন নেই। শুধুমাত্র একটি ভাঙ্গা মত দোকান খোলা। কেউ আছেন ভেবে ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল ওটা দোকান নয়। এক কোয়াক ডাক্তারের ডিসপেন্সারি। ডাক্তার ভদ্রলোক টেবিলের ওপরে কতগুলো টাকার দিকে তাকিয়ে আছেন একরাশ বিরক্তি নিয়ে। পাশেই একটি ছোট্ট অত্যন্ত পুরনো চিরকুট হাওয়ায় টুনটুন করে উড়ছে।
ভদ্রলোক দুপুরবেলা অচেনা একাকী যুবতী দেখে অবাক হলেন। তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁচুমাচু মুখে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে!
আমি শুকনো মুখে বললাম, কনি বলে এখানে কেউ থাকেন? খুব দরকার!
ভদ্রলোক অবাক হয়ে অনেকক্ষণ আমার মুখ পানে চেয়ে রইলেন। শেষে একটু হেসে বললেন, উনারে তো কেউ কোনদিন খুঁজতে আসে না! তাই অবাক হইছি। তয় আছে। কনি মাসি তো? ভিক্ষে করে সেই কনি তো? ঐ তো মন্দিরের চাতালে শুয়ে আছে। শরীল ভালো না। গত বন্যায় ওনার কুঁড়েঘর ভাইসা গেছে। থাকার জায়গা নাই। পরক্ষণেই ভদ্রলোক চোখে মুখে অত্যন্ত কৌতুহল ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? কোথা থেকে আইছেন? উনারে খোঁজেন ক্যান!
ভদ্রলোক আমার উত্তরের আশা না করে নিজেই আবার বলতে শুরু করলেন, এই দেখেন মাসি কি বিপদে আমারে ফালাইছে। এই টাকা কয়টা রাইখা গেছে। সেই ফরাক্কা তালতলা পোস্ট অফিসের মাস্টার হরিআনন্দ বাবুর কাছে দিয়ে আসতে বলছে। এখন কি যাওয়া যায় কন? বিকেল হয়ে গেল! কি জ্বালা!
ধীরে ধীরে আমার মাথা যেন দুলছে। আর দাঁড়াতে পারছি না। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এক অসহায় ভিখারিনির কষ্টার্জিত উপার্জনের পয়সায় মানুষ হয়েছি আমি! তার মুখের খাবারের বিনিময়ে মানুষ হয়েছি আমি! অসুস্থ শরীরে ভিক্ষে করে আবার টাকা রেখে গেছেন আমার জন্য! হায় ভগবান এমন মানুষও আছেন পৃথিবীতে! এমন জ্যান্ত ভগবানও আছেন পৃথিবীতে! এ কি শুনছি!
জানিনা কখন যেন নিজের অজান্তেই দুচোখ বেয়ে জল এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো আমার দুগাল। টপটপ করে পড়তে লাগলো টেবিলটার উপর। বন্যার জলের মতো হু হু করে কান্না আসতে লাগলো বুক চেপে। তারপর কেন জানিনা হঠাৎই চিৎকার করে বললাম, আমি সেই মেয়ে। ঐ টাকা আমার। কনি ভিখরি আমাকে টাকা পাঠায়। ওনার টাকায় আমি খেয়েছি, পড়েছি, বড় হয়েছি। ও টাকা আমার। ও টাকা আমার। শুধু আমার।

টাকা।
© বাবুরাম মন্ডল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.