ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব
পাশারুল আলম
প্রতিবেদন:- ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের জন-প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা ঐতিহাসিক এবং সামাজিক আপত্তি দ্বারা চিহ্নিত যা ভারতীয় রাজনৈতিক ভূখণ্ডকে প্রভাবিত করে চলেছে। ধর্মীয়, ভাষাগত এবং জাতিগত গোষ্ঠী সহ সংখ্যালঘুরা ভারতের বৈচিত্র্যময় সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেটা অতীত হোক কিংবা বর্তমান। তবুও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ এবং কার্যকর প্রতিনিধিত্ব সীমিত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, সংখ্যালঘু প্রার্থীদের ক্রমহ্রাসমান উপস্থিতি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা আবশ্যক। যা প্রায়শই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গুলিকে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব পেতে বাঁধা দেয়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান রয়েছে একমাত্র আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব Proportional Representation (PR) নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন চলমান নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বকে শক্তিশালী করার সম্ভাব্য রাস্তাগুলিকে সন্ধান করা যেতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব, বিশেষত লোকসভা, রাজ্যসভা এবং রাজ্য বিধানসভার মতো আইনসভা ও বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থাগুলিতে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে৷ রাজনৈতিক দলগুলি প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্ককে প্রাধান্য দেয়। এমনকি উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু জনসংখ্যার নির্বাচনী এলাকায়ও প্রায় সমস্ত বড় রাজনৈতিক দলগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। মনোনীত প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া এই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয়। এই কারনে দলগুলি সংখ্যালঘু প্রার্থীদের এবং তাদের নির্বাচনী এলাকাকে উপেক্ষা করে। আসন জয়ের সম্ভাবনা সর্বাধিক করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী থেকে প্রার্থীদের বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখায়। এই প্রবণতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক প্রান্তিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এটা শুধু অনুভূতি নয়, এটাই বাস্তবতা।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার যোগেন্দ্র যাদব উল্লেখ করেছেন যে “রাজনৈতিক দলগুলি সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বকে একটি বাণিজ্য বন্ধক হিসাবে দেখে। অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে সংখ্যার উপর নির্ভর করতে পছন্দ করে।” ফলাফল হল সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে দূরে আছে এমন বোধ করে। তাদের কণ্ঠস্বর প্রায়শই সমালোচনামূলক নীতি ও আলোচনা শোনা যায় না। ফলস্বরূপ, সংখ্যালঘুরা সীমিত রাজনৈতিক প্রভাবের সম্মুখীন হয়। যার ফলে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির জন্য কার্যকর সমর্থনের অভাব দেখা দেয়। তারা নিজের মনের কথা বলতে পারেনা। এই প্রবণতা সামাজিক বিভাজনকে আরও গভীর করতে পারে এবং সংখ্যালঘুদের জন্য প্রকৃত পরিবর্তন বা ক্ষমতায়নের সুযোগ কমিয়ে দেয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি এবং সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা এবং সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করা।
এছাড়া রয়েছে সংখ্যালঘু নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব। পদ্ধতিগত বিষয়গুলির বাইরে, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সংখ্যালঘু নেতাদের ভূমিকাও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বকে প্রভাবিত করেছে। অনেক সংখ্যালঘু নেতা সম্প্রদায়ের উদ্বেগের জন্য ওকালতি করার চেয়ে ব্যক্তিগত এবং দলীয় আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেন। সংখ্যালঘু ইস্যুতে দলের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করা ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে এই অনীহা উদ্ভূত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোয়া হাসান উল্লেখ করেছেন যে, “সংখ্যালঘু নেতারা প্রায়শই তাদের সম্প্রদায়ের স্বার্থ পরিবেশন এবং দলীয় নেতৃত্বের অনুগ্রহ বজায় রাখার মধ্যে দ্বন্দ্বে পড়েন।” এই অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা নেতাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো বিশেষ সমস্যাগুলির দিকে মনোযোগ দিতে বাধা দেয়। এর ফলে, এই সমস্যাগুলো বা তো উপেক্ষিত হয় বা পর্যাপ্তভাবে সমাধান পায় না, যা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্প্রদায়ের আস্থা কমিয়ে দেয়।
এই সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার জন্য আরও ভাল প্রতিনিধিত্বের দিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে প্রার্থী নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তি প্রচার করে এমন নীতিগুলির জন্য চাপ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ একটি পদ্ধতি হল সম্প্রদায়ের জন্য সম্মিলিতভাবে যোগ্য এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রার্থীদের মনোনীত করা। যারা সত্যই সংখ্যালঘুদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে। এই জন্য রাজনৈতিক দলগুলির কাছে প্রতি লোকসভা ও বিধান সভায় তিন চার জনের নাম সুপারিশ করতে পারে। প্রার্থীদের এই তালিকা উপস্থাপন করার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ওকালতি করতে পারে। একই সাথে বর্তমান মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। যা প্রায়শই ভোটারের পছন্দগুলিকে উপেক্ষা করে। পণ্ডিত রাজীব ভার্গব এই ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন করেন, তিনি বলেন- “কেবলমাত্র প্রার্থী নির্বাচনে সংগঠিত এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি তাদের জীবনকে ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলিকে প্রভাবিত করার আশা করতে পারে।”
এই প্রস্তাবিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করলে রাজনৈতিক দলগুলিকে শুধুমাত্র নির্বাচনী ফলাফলের পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করতে উৎসাহিত হবে। এই ধরনের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকে শক্তিশালী করতে পারে না বরং সম্প্রদায়ের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য শুধুমাত্র যোগ্য এবং নিবেদিত প্রার্থীদের বেছে নেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এই প্রার্থীর নাম শুধু সংখ্যালঘু প্রার্থীর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে সমস্ত আসনে যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ ও প্রকাশ করা। এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ থেকেও যোগ্য সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারে।
সত্যি কথা বলতে, ভারতীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি অপরিহার্য। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে বিভিন্ন কণ্ঠস্বর অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতিনিধিত্ব করে তা সহজাতভাবে শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক হয়। সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর প্রকৃতভাবে প্রতিনিধিত্ব করা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এর মাধ্যমে দেশ আরও সমন্বিত এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ প্রচার করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী আশুতোষ ভার্শনি পর্যবেক্ষণ করেছেন যে “একটি গণতন্ত্র কেবল তখনই শক্তিশালী হয় যখন দুর্বলতম অংশগ্রহণকারীরা স্থান পায়। প্রকৃত গণতান্ত্রিক অগ্রগতি তখনই অর্জন করা যেতে পারে, যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে সংখ্যালঘুদের কণ্ঠকে সমানভাবে মূল্য দেওয়া হয়।”
পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মোকাবেলা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং একটি সক্রিয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অনুভব। এই উভয়বিধ ধরা প্রয়োজন। সংখ্যালঘুদের অবশ্যই প্রার্থীদের মনোনীত করার ক্ষেত্রে একসাথে কাজ করতে হবে। যারা সত্যিকার অর্থে তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং জাতীয় ও স্থানীয় সমস্যা উজাগর করবে। সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমর্থন করবে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলিকে বৈচিত্র্যময় প্রার্থী চয়নের যে মূল্য, তা স্বীকার করতে হবে। যা ভারতের জনসংখ্যাগত সমৃদ্ধি প্রতিফলিত করে। এই পরিবর্তন সাধিত হলে ভারত আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে। এই প্রচেষ্টা সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে বৃহত্তর আস্থা ও ঐক্য গড়ে তুলতে পারে। সামনে চব্বিশের ভোটে, ভোটারের চয়েজ এমন প্রার্থীর নাম নথিভুক্ত করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সমীপে রাখুন।