নিউজ ডেস্ক:- পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক কোটি লোক নাগরিকত্ব পাবেন, কিন্তু অসমে সেই সংখ্যা পাঁচ লক্ষের বেশি হবে না–খোদ হিমন্তবিশ্ব শর্মার সেই দাবিকে ‘হাস্যকর’ বলছে আসু। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিধি যে ভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, তাতে অসমের পাঁচ লক্ষ উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালিও শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন কিনা, যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারন, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে তিনটি প্রমান দাখিল করতে হবে। নিজের ধৰ্ম যেমন প্রমান করতে হবে, তেমনই দেখাতে হবে বাংলাদেশের নথিপত্রও, যাতে বাংলাদেশের লোক বলে প্রমাণিত হয়। তাছাড়া নাগরিকপঞ্জিতে আবেদনের তথ্য দাখিলের শর্তও থাকবে আইনের বিধিতে।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হয়ে গেলেও আইনের বিধি এখনও প্রস্তত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনকে সামাল দিতে রাজ্য সরকার শুধু অসমের জন্য বেশ কিছু বিশেষ ব্যবস্থা আইনের বিধিতে রাখার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে।
মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল আগেই দাবি করেছেন, আইনের বিধিতে অসমের জন্য কি ব্যবস্থা থাকবে, সেই সুপারিশ কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাই বিধি প্রকাশ পেলেই সব কিছু পরিস্কার হবে, অসমিয়াদের শঙ্কা দূর হবে। নাগরিকত্ব আইনের বিধি প্রস্তুতের বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর রাতেই তিনি দাবি করেন,’পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা বিশাল হলেও অসমের ক্ষেত্রে খুব ছোট প্রক্রিয়া হবে। অসমে তিন থেকে পাঁচ লক্ষের বেশি লোক সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের অধীনে নাগরিকত্ব পাবেন না’।
আইনের বিধি প্রকাশ পেলেই মানুষের বিভ্রান্তি দূর হবে।’
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সুযোগে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি, দেড় কোটি অসমে চলে আসবেন বলে অসমীয়া জজাতীয়তাবাদী শিবিরের প্রচার ভোঁতা করে দিতে রাজ্য সরকার এখন চাইছে, বাস্তবিকই যাতে কম সংখ্যক লোক নগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। তাছাড়া আবেদনের জন্য দু-মাস কিংবা তিন মাসের এক নিদির্ষ্ট সময় বেঁধে দিতে,যাতে এরমধ্যেই বোঝা সম্ভব হয়, কত লোক নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন।
আইনের বিধি সেই অনুযায়ী প্রস্তুতের চাপ রয়েছে রাজ্যের, প্রয়ােজনে অসমের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছে রাজ্য সরকার। তবে সংশােধিত আইনের অধীনে নাগরিকত্বের জন্য মূলত তিনটি প্রমাণ যে দাখিল করতেই হবে আবেদনের সঙ্গে, সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন হিমন্ত। এরমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নাগরিকপঞ্জিতে আবেদন দাখিলের তথ্য মানে, নাগরিকপঞ্জিতে নাম তােলার জন্য আবেদন করেছিলেন যে সব হিন্দু বাঙালি, তারাই শুধু সংশােধিত আইনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন দাখিলের যােগ্য হবেন। কেউ যদি নথিপত্রের অপ্রতুলতায় নাগরিকপঞ্জিতে আবেদন না করে থাকেন, তিনি বঞ্চিতই থেকে যেতে পারেন।
শুক্রবার এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেন, “ সংশােধিত আইনে মূলত তিনটি বিষয় রয়েছে। প্রথমত,হিন্দু,বৌদ্ধ,জৈন,পার্সি ও খ্রিস্টানরাই শুধু নাগরিকত্ব পাবেন। তার মানে হচ্ছে, নাগরিকত্বের জন্য আবেদনকারীকে প্রথমে নিজের ধর্ম প্রমাণ করতে হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে ‘রহমান’ উপাধির কেউ এসে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন না, কারণ, নিজেকে হিন্দু হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে আবেদনের সঙ্গে। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে থেকে ভারতে আসার প্রমাণ দাখিল করতে হবে আবেদনকারীকে। এর জন্য আইনের বিধিতে কিছু সরকারি নথি চাওয়া হতে পারে। নাগরিকপঞ্জি নবায়নের সময় যেভাবে ১৯৭১ সালের আগের বেশ কিছু সরকারি নথি দাখিল করতে হয়েছে, সেভাবে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগের নথি জমা দিতে হবে। সেটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, শিক্ষাগত যােগ্যতার প্রমাণপত্র, আধার কার্ড, ভােটার পরিচয়পত্র ইত্যাদি হতে পারে। তৃতীয়ত, কোন দেশ থেকে এসেছেন সেই প্রমাণও দিতে হবে।
বিজেপির প্রভাবশালী নেতা হিমন্ত বলেন, পৃথিবীর সব দেশ থেকে এলেই যে সংশােধিত নাগরিকত্ব আইনের অধীনে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে, সেটা তো নয়। শুধু পাকিস্তান , আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হতে হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে আসার প্রমাণ দাখিল করতে হবে আবেদনের সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারের জারি করা কোনও নথিপত্র কিংবা শরণার্থীর সার্টিফিকেট, শরণার্থী শিবিরে থাকার ক্যাম্প সার্টিফিকেট ইত্যাদি নথি দেখাতে হবে। তার মানে, এটা প্রমাণ করতে হবে যে আবেদনকারী কেনিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কা থেকে আসেননি। তাই নিজের ধর্ম, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আসার প্রমাণ এবং কোন দেশ থেকে এসেছেন — সেই তিনটি প্রমাণ আবেদনপত্রের সঙ্গে গেঁথে দিতে হবে। আবেদনকারীদের সেই তিনটি তথ্যপ্রমাণ কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থাগুলি ভেরিফিকেশন করবে। তারপর নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্ন আসবে। তাই আসু বা একাংশ লােক যেভাবে বলছেন শুধু একটি অ্যাফিডেভিট দাখিল করালেই নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে, সেটা মােটেই সত্য নয়, যথেষ্ট গুরুগম্ভীর প্রক্রিয়া হবে, বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু এই তিনটি প্রমাণ সংগ্রহ করা উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালিদের পক্ষে যে কষ্টকর হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে কোন দেশ থেকে এসেছে, সেটা প্রমাণে বাংলাদেশের নথি দাখিল করা কষ্টকর হতে পারে। তাই আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক কমতেও পারে। তাৎপর্যের বিষয় হচ্ছে, নাগরিকত্বের জন্য আবেদনে অসমের ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে অাবেদনের তথ্য চাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে রাজ্য সরকার। সংশোধিত আইনের বিধিতে অসমের জন্য সেটাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হিমন্ত জানান, “আমরা কেন্দ্রকে বলেছি, অসমের ক্ষেত্রে নাগরিকপঞ্জিতে আবেদনের তথ্যপ্রমাণও যাতে প্রয়ােজন হয়, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। তার মানে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যারা নাগরিকপঞ্জিতে আবেদন করেছেন, কিন্তু নাম ওঠেনি, তাঁরাই শুধু সংশােধিত আইনের অধীনে নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন দাখিল করতে পারবেন। আইনের বিধিতে অসমের জন্য সেই ব্যবস্থা থাকবে।
কিন্তু যদি কেউ নথিপত্র অপ্রতুলতায় নাগরিকপঞ্জিতে আবেদন দাখিল থেকে দূরে ছিলেন, সংশােধিত আইনে তাঁর আবেদনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাগরিকপঞ্জিতে আবেদনের শেষ দিন ছিল ২০১৫ সালের ৩১আগস্ট। ফলে কীভাবে এটা সম্ভব হবে, বােঝা কঠিন।
(সৌজন্য: যুগশঙ্খ)