বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আরও উন্নতির স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে আর আমাদের দেশ হিন্দু-মুসলিম করছে “হাসতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই, কিন্তু শুধু হিন্দু-মুসলিমে আটকে যাই…”

Spread the love

শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়:- কখনও আড্ডা মারার সময় ভেবেছেন হিন্দুর সঙ্গে আড্ডা মারছেন না মুসলিমের সঙ্গে? হ্যাঁ যাদের সঙ্গে আড্ডা মারছেন তাদের নাম আপনি জানেন, কারণ নাম দিয়ে তো ধর্ম চেনা যায়। তবুও, আড্ডা মারার সময় তো আগে মনে হয়নি যে মুসলিম বলে তার সঙ্গে মিশব না বা বন্ধুত্বই করব না। কিন্তু এখন মুসলিম কারও সঙ্গে রাস্তায় বেরনোর আগে ভাবতে হচ্ছে। কেউ দল বেঁধে এসে ধর্ম জানতে চাইবে না তো? আমি হিন্দু আর সে মুসলিম বলে মারধর শুরু হবে না তো? ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘ভারত মাতা কী জয়’ স্লোগানে ঢেকে যাবে না তো আমার মুসলিম বন্ধুর আর্তনাদ? ভাবতে হয়, ভাবলে ভয়ও হয়। শুধু মনে হয়, এমনটা হোক আমি তো চাইনি, হয়তো আমার মতো এই ১৩০ কোটির দেশও চায়নি। তবে কেন হল এমন পরিস্থিতি? ১৯৮৪, ১৯৯২, ২০০২ থেকেও আমরা শিখে উঠতে পারিনি। ২০২০-তেও আমরা ব্যর্থ।
রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গ তুলতে চাইছি না, কিন্তু বলতেই হচ্ছে। সরকার আমরা নির্বাচন করি যাতে আমরা ভাল থাকি। হ্যাঁ, নিজেদের স্বার্থেই তো সব করি আমরা। আমি ভাল থাকলে তো সব ভাল থাকবে, এমন ধারণাতেই তো ভোট দেন মানুষ। সমর্থন যে যাকে খুশি করতে পারে কোনও দোষ নেই, কিন্তু নিজের বুদ্ধি জলে ভাসিয়ে বড় সমর্থক হওয়ার মধ্যে দোষ রয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির অভিযোগ সবসময় থাকে, এখনও রয়েছে যে, কংগ্রেস ব্যর্থ, কলঙ্কিত। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করেছে, দুর্নীতি করেছে, শরণার্থীদের হয়ে কিছু করেনি, অর্থনীতি নিয়ে… মানলাম, সব মানলাম। কংগ্রেস কিছু করেনি, তাই তো মানুষ বিশ্বাস করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, শান্তির জন্য, অগ্রগতির জন্য। কিন্তু কোথায় কী? ভোট দেওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের বিভিন্ন বক্তব্যে মনের জোর পেয়েছিলেন মানুষ, ভেবেছিলেন দুর্নীতি মিটবে, ‘আচ্ছে দিন’ সত্যিই আসবে, অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, বেকারত্ব মিটবে। আজ এই সরকারের ৬ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে মানুষ বুকে হাত রেখে বলতে পারবে না যে, এর মধ্যে একটাও হয়েছে। তবে একটা জিনিস বিজেপি করছে এবং সফলও হচ্ছে, তা হল মানুষকে ধর্মান্ধ করে তুলতে।

নতুন দশক শুরু করেছি আমরা। উন্নতির দিকে তাকিয়ে রয়েছি। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আরও উন্নতির স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভারত এখনও হিন্দু-মুসলিম করছে। কেন? প্রশ্ন সর্বত্র, কেন আজকের দিনে দাঁড়িয়েও আমরা শুধু ‘হিন্দু হিন্দু হিন্দু’ করে চলেছি। কেন আমাদের কাছে এখনও জাতপাত, ধর্ম এত গুরুত্ব পাচ্ছে? কী দিয়েছে ধর্ম আমাদের হিংসা ছাড়া? কেন এই প্রশ্নটুকু আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের করি না? একটা সরকার, তার কিছু লোক আমাদের যা বলবে তাই শুনতে হবে, কেন? আমার বিশ্বাস, এই প্রশ্নগুলির একটাও যদি মানুষ নিজেকে করত তাহলে হয়তো আজ এদিন দেখতে হত না কাউকে। কিন্তু না। কেন করব প্রশ্ন, কেন এত ভাববো? অবশ্যই, ভাবার জন্য তো সরকারকে নির্বাচিত করেছি, তারা ভাববে আমাদের হয়ে। কিন্তু সেটাও যখন হচ্ছে না, তখন দায়িত্ব তো নিজেদেরই নিতে হবে তাই না?
সমর্থন করুন। সমর্থনে কোনও সমস্যা নেই। আপনি বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস যে কোনও দলের সমর্থক হতে পারেন। কিন্তু সমর্থন করার মানে এই নয় যে, বিরোধিতা আপনি করতে পারেন না। পরিবারের কারও সঙ্গে যখন মতানৈক্য হয় তখনও তো আমরা বিরোধই করি, তাহলে দলের কোনও মতে বিরোধিতা করায় দোষ কোথায়? কেন কোনও দল আপনাকে বলে দেবে যে আপনি বিরোধিতা করলেই দেশদ্রোহী। কেন কোনও দল আপনার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলবে আর আপনি কোনও বিরোধিতা করবেন না, এই প্রশ্নগুলো করতে শুরু করুন। দলকে বা সরকারকে প্রশ্ন করায় আপত্তি রয়েছে মানলাম, নিজেকে প্রশ্ন করতে তো আপত্তি নেই, থাকার কথাও নয়। কেউ মন্দির মন্দির করে গেল, কেউ মসজিদ মসজিদ করে গেল, কিন্তু শিক্ষা, খাদ্য নিয়ে কেউ টু শব্দটাই করল না। ভাবতে মজা লাগে, যারা এই রব তুলে হইহই করছে, তাদেরও তো পরিবার-পরিজন রয়েছে। তাদের কথাও হয়তো তাদের নিজেদের লোকেরা ভাবে না।

একটা জিনিস ভাবতে হবে। কেন মুসলিম বিরোধেই এত জোর দেওয়া হয়। দেওয়া তো উচিত নয়। কারণ আপনি জার্মানির ‘গণহত্যাকারী’ হিটলারকেই দেখুন বা চেরনোবিলের সেইসব বিজ্ঞানীদের কথা ভাবুন, কেউই মুসলিম নয়। আবার অন্যদিকে, আমাদের দেশের নির্ভয়াকাণ্ডের ধর্ষকদের কথা ভাবুন, বা কাঠুয়া ধর্ষণের কথা চিন্তা করুন, তাদের মধ্যেও এই ধর্মের কাউকে পাবেন না। নিরপেক্ষ অবস্থান নিলে তো এদের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে হবে, মাঠে নামতে হবে। তবে, এবার অনেকেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে শতশত প্রমাণ খাড়া করবে। মুম্বই হামলা থেকে শুরু করে সংসদে হামলা, উরি, পুলওয়ামা, সবেতেই যোগ রয়েছে মুসলিমদের। স্পষ্ট করে বলতে হলে পাকিস্তানের যোগ রয়েছে। আর এই প্রতিবেশী দেশের জন্যই আপনি হয়েছেন মুসলিম বিরোধী। বরং বলা ভাল, আপনাকে করা হয়েছে মুসলিম বিরোধী। কিন্তু কীভাবে?

সন্ত্রাসবাদের আখড়া পাকিস্তান। কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মুসলিম প্রধান দেশ জঙ্গিদের আঁতুড়ঘরে মানে যে ভারতের বা সেই দেশেরও সব মুসলিম জঙ্গি বা দেশবিরোধী, এই ধারণা বদলাতে হবে। এমনকি এদেশেও এখন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করা লোকজন ‘পাকিস্তানি’ হয়ে উঠছে। কারণ খুঁজলে দেখা যাবে একমাত্র ‘পাকিস্তান’ নামটাই এর মূল কারণ। আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন, জামার্নি এমনকি চিন নামেও মুসলিম বিরোধীদের রক্ত গরম হয় না। মানছি, পাকিস্তানের সুখ্যাতি করতে হবে এমন কোনও কাজ তারা করেনি। কিন্তু তা বলে মুসলিম দেশ বলে সমস্ত মুসলিমদেরই শূলে চড়িয়ে দিতে হবে, তার কোনও মানে নেই, না নেই, কোথাও লেখা নেই, এমনকি শাস্ত্রেও বলা নেই। গড্ডালিকা প্রবাহে না ভেসে মস্তিকের সামান্য কিছুটা অংশ ব্যবহার করলেই এই ধারণা স্পষ্ট হওয়ার কথা।

অদ্ভুত লাগে, যখন আমরা ভাবি যে, ভারতীয়রা মার্কিন প্রেসিডেন্ট এলে আমেরিকার পতাকা ওড়ায়, ২০০ বছর ধরে আমাদের শাসন করা ইংল্যান্ডের পতাকা দেওয়া জামা-গেঞ্জি পরে, আন্তর্জাতিক ফুটবলের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে হইহুল্লোড় করে সমর্থন করে। শুধুমাত্র পাকিস্তানের নাম শুনলেই ভারত ভক্তিতে মজে যায়। অবশ্য দেশভক্তির ধ্বজা তোলা প্রধানমন্ত্রী খোদ বিদেশ সফরের সময় প্রোটোকল ভেঙে শত্রুদেশে ‘চায়ে পে চর্চা’ করতে যান। সেদিন কিন্তু ‘ভক্তরা’ তাঁকে দেশদ্রোহী বলে না!

ছাড়ুন না এসব ধর্মটর্ম। আসুন না একসঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই। একসঙ্গে হাতে হাত ধরি। মন্দির হোক, মসজিদ হোক সঙ্গে কিছু হাসপাতাল, স্কুল, কলেজও হোক। এমন দিন তৈরি করি যাতে পথে বেরনোর আগে চিন্তা না করতে হয়। আমরা তো প্রচণ্ড জল তেষ্টা পেলে অপরিচিত কারও থেকে জল খাওয়ার আগে ভাবি না যে তিনি মুসলিম না বৌদ্ধ। ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নেওয়ার আগেও কি ধর্ম জিজ্ঞাসা করি? কারও সাহায্য পেতে গেলে কি আগে জেনেনি তাঁর নাম? কোনওটাই করি না। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন এসবের ধার ধারি না, তবে দেশের স্বার্থে ধার ধারব কেন। বাদ দিই না হিন্দু-মুসলিম। দলভক্তিকে দেশভক্তির সঙ্গে গুলিয়ে কী লাভ, তার চেয়ে বরং একটু আলোচনা করি, তর্ক করি। না হলে কে বলতে পারে আজ যারা দাঙ্গা নিয়ে মজা পাচ্ছেন, ভাবছেন এইভাবেই তো দেশ এগোবে, মুসলিম তাড়ালেই উন্নতি হবে, তারাই একদিন নিজের এলাকার সঙ্গে সিরিয়ার মিল পাবেন, ১০০ বার ফোন করলেও বাড়ির লোক ফোন ধরবে না। লাশ খুঁজে দেখতে হবে শয়ে শয়ে, যদি কোনও পরিচিতের সন্ধান হঠাৎ করে মিলে যায়!

সৌজন্য:- মহানগর ওয়েব ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.