অয়ন বাংলা,নিউজ ডেস্ক:-
‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বলতে দোকানে চলল লুঠপাট, মাথা ফাটল যাদবপুরের তড়িৎদার: বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবুল সুপ্রিয়র পা রাখাকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল গোটা এলাকা। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত হাঙ্গামার রেশ কাটেনি। থমথমে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া। রাজনৈতিক চাপানউতোরও থামার নাম নেই। বিজেপি, সিপিএম থেকে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেও চলছে একে অন্যের ওপর বিশৃঙ্খলার দায় চাপানোর পালা। তবে এই সংঘর্ষে আমজনতা যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, সেটা নিয়ে এখনও পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেনি কোনও রাজনৈতিক দল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে তাকালে চোখে পড়বে তড়িৎবরণ দাশের দোকান। ২৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে খাতা–কলম এবং শিক্ষার অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করেন তড়িৎ। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯২ সালে দর্শনে এম.এ পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন তিনি। তার আগে টিউমারের কারণে হাঁটু থেকে বাদ দিতে হয়েছিল বাঁ পা–টি। তড়িৎবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের মধ্যেই দোকান গড়ে দেওয়া হয় তড়িৎকে। সেই থেকেই সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা দোকান সামলান তড়িৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কাছে তিনি পরিচিত তড়িৎদা নামেই। বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন তিনিও। দোকানের জানলার কাচ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মারা হয়েছে ইটও। শুধু তাই নয়, ৫২ বছর বয়সী তড়িতের অভিযোগ, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে দিতে তাঁর দোকান থেকে জিনিসপত্র ছিনতাইও করে নেওয়া হয়। পরে হিসেব করে তড়িৎ দেখেছেন, লুঠ করে নেওয়া সামগ্রীর অর্থমূল্য তিন–চার হাজার টাকা!
বৃহস্পতিবার ঠিক কী ঘটেছিল সুভাষগ্রামের বাসিন্দা তড়িতের সঙ্গে? তড়িৎ বললেন, ‘বাবুল সুপ্রিয়কে কেন্দ্র করে যে বিবাদের সূত্রপাত, সেটা আরও বড় আকার ধারণ করে সন্ধে সাতটা বেজে ১০ মিনিট নাগাদ। আচমকাই প্রচুর লোকজন ঢুকে পড়ে। বিপদ আঁচ করে আমি দোকানের দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে ভিতরে চুপচাপ বসেছিলাম। দোকানের পাশেই এসএফআই–এর পার্টি অফিস। সেখানে হামলা চালানোর পাশাপাশি আমার দোকানেও আক্রমণ করা হয়।’ এই ঘটনার সঙ্গে কি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)–এর সদস্যরা জড়িত? তড়িৎ বলছেন, ‘এখানে যারা এবিভিপি করে তাদের আমি চিনি। তারাও আমাকে চেনে। হলফ করে বলতে পারি, এরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রী নয়। এরা সকলেই বহিরাগত এবং মূলত হিন্দিভাষী।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, যারা সন্ধেবেলা কলেজে ঢুকেছিল, তাদের বয়স ২৫ থেকে ৫০–এর মধ্যে। তড়িতের কথায়, ‘ওরা বারবার দোকানের দরজায় লাথি মারছিল। বাঁশ ও লাঠি দিয়েও আঘাত করা হয়। আমি বারবার অনুরোধ করছিলাম, যাতে আমাকে এবং আমার দোকানকে রেহাই দেওয়া হয়। এটাও বলেছিলাম যে আমি কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়েও ছাড় পাওয়া যায়নি। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে দিতে লুঠপাট চালায়।’ দুষ্কৃতীদের ছোড়া ইটের আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে তড়িতের দোকানের জানলার কাচ। কাচের আঘাতে আহত হয়েছেন তড়িৎ নিজেও। যদিও এই ঘটনার দায় স্বীকার করছেন না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিভিপি–র সদস্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিভিপি–র সাধারণ সম্পাদক সুমন দাসের কথায়, ‘এই ঘটনায় এবিভিপি কোনওভাবে জড়িত নয়। আমরা ওখানে ছিলাম না।’ এবিভিপি রাজ্য সম্পাদক সপ্তর্ষি সরকার বললেন, ‘ঘটনাটার কথা শুনেছি। চার নম্বর গেটের সামনে তো পুলিশ ছিল। তাদের এড়িয়ে কে ওখানে গেল, সেটার তদন্ত হোক। এসএফআই–এর ছেলেরাই আমাদের বদনাম করার জন্য জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে এই কাজ করেছে।’
পরিস্থিতি একটু শান্ত হওয়ার পরে রাতেই তড়িতের শুশ্রূষা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে মেরামত করা হয়েছে তড়িতের দোকান। যাদবপুর থানায় অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি। তবুও অভিমান যেন কাটতে চাইছে না তড়িতের। বলে চলেছেন, ‘এতদিন ধরে এখানে অনেক আন্দোলন দেখেছি। এত হিংস্র, নৃশংস মনোভাব কখনও দেখিনি। আমার কী দোষ বলুন তো, আমি তো কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। আমাকে মারল কেন?’