সুপ্ত চিন্তার প্রতিফলন মুসলিম সমাজকে কালিমালিপ্ত করার গতানুগতিক পুরাতন ছক SOS কোলকাতা’ সিনেমাতে

Spread the love

 নিউজ ডেস্ক:-   বাংলা সিনেমার পর্দায় মুসলিম চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব আগের তুলনায় একটু হলেও বেড়েছে। কিন্তু আক্ষেপের কথা হল সেই পরিসরটুকু যে খুব একটা স্বচ্ছ তা নয়। এখানেও তাদেরকে গতানুগতিক বাঁধাধরা ছকে ‘অপর ‘ বা পর করে দেখানোর প্রয়াস থাকছেই ।

জাতীয়-স্তরের অর্থাৎ হিন্দি সিনেমাগুলিতে যদিও মুসলিমদের এই ‘অপরীকরণ’-এর চল বেশ পুরানই। এটা দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। তবে এখনকার বাংলা সিনেমাও সে পথে ভিড়ে গেছে। উদ্দেশ্য, বাণিজ্যিকভাবে আরো বেশি ফায়দা হাসিল করা। ‘মুসলিম সম্প্রদায়’- কে যাচ্ছেতাই ভাবে ‘ট্রোপ’ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের সম্পর্কে ইচ্ছা-খুশি একটি স্থির-বদ্ধমূল ধারণা মানুষের মগজে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গত দশ বছরে এমন বেশ কিছু বাংলা ছবি আত্মপ্রকাশ করেছে যেখানে মুখ্য ভূমিকায় কোন মুসলিম চরিত্রকে অভিনয় করতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বীর দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘শুধু তোমার জন্য’ (২০১৫) ছবিটির কথা পেশ করা যায়। ছবিটির প্রধান চরিত্র সিরাজ চৌধুরী। যে কিনা ধর্মের দোহাই দিয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আর নিজে বনে যায় একজন ঠগবাজ-প্রেমিক। ওই একই বছরে অপর্ণা সেনের ‘আর্শি নগর’ মুক্তি পায়। এটি সেক্সপিয়ারের কালজয়ী রোমান্টিক নাটক ‘রোমিয় -জুলিয়েট’ অবলম্বনে নির্মিত। কিছুটা অভিজোজিত। ছবিটিতে রনঞ্জয় মিত্র এবং জুলেখা খানের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখানে দেখা যায় জুলেখার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে রনঞ্জয়ের কৌতুহলী উঁকি ঝুঁকি। ২০১৬-তে সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত জুলফিকার মুক্তি পায়। এটি নিয়েও বিস্তর বিতর্ক তৈরী হয়। সেক্সপিয়ারের লেখা ‘জুলিয়াস সিজার’ এবং ‘ক্লিওপ্যাটরা’ নাটক দুটিকে অনেকখানি রদবদল করে ছবিটি নির্মিত। ছবিটির শুরুতে, ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে একটি কন্ঠস্বর শোনা যায়। কন্ঠস্বরটি বলতে থাকে,”তোমরা কি জানো এই দুর্গাপুজার শহর, রবীন্দ্রনাথের শহর কলকাতাতেই আর একটি অন্ধকার এলাকা আছে? এই এলাকা কলকাতার মধ্যে একটি ছোট্ট দেশ। ওই জাতীয় সংগীত আর পতাকাটা বাদ দিয়ে। আন্দাজ করতে পারছো তারা কোন ধর্মের লোকজন?” এভাবেই যাবতীয় নেতিবাচক আখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে ফিল্মটিতে।
আরেকটু এগিয়ে বর্ণনা করা হয়, ” খিদিরপুর, মেটিয়াব্রুজ এবং গার্ডেনরিচের বন্দর সংলগ্ন এই এলাকা যেন কলকাতা শহরের মধ্যে একটি ছোট্ট দেশ। হ্যাঁ, একটি দেশ ওই জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকাটা বাদ দিয়ে।”

যথারীতি ছবিটি নিয়ে শোরগোল বাঁধে। মুসলিমদেরকে কদর্য ভাবে উপস্থাপনের এই প্রয়াসকে নানা মহল থেকে ধিক্কার জানানো হয়। তবে এমন ছবি নির্মাণ উত্তর-উত্তর বাড়ছে বই কমছে না। এই ধারার ছবিতে নব সংযোজন ‘এসওএস কোলকাতা’। গতকাল এটি সিনেমা হল গুলিতে রিলিজ করা হয়েছে। এটি জারেক এন্টারটেইনমেন্ট এবং প্রত্যূষ প্রোডাকশন এর যৌথ প্রয়াসে নির্মিত। এখানেও সেই পুরানো ছকে মুসলিমরা ঘৃণ্য এমন এক ধারণাকে মেলে ধরা হয়েছে।
এই নিবন্ধটি লেখা হয় সিনেমাটি জায়েন্ট স্ক্রিনে মুক্তি লাভের আগের দিন। সেক্ষেত্রে ২:৪৪ মিনিটের ট্রেলার দেখেই আমাদেরকে ক্ষান্ত হতে হয়। তবে ট্রেলারের ওই ছোট্ট স্ক্রিপ্ট দেখে সহজেই অনুমেয় যে এখানেও মুসলিমদেরকে নিয়ে সেই স্টিরিওটাইপিক্যাল বা বদ্ধমূল ধারণাকে মান্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টা। আর এটা বোঝার জন্য গোটা ফিল্ম দেখার প্রয়োজন পড়ে না। সকাল দেখলে দিনটি কেমন হতে পারে তা বেশ বোঝা যায়। ট্রেইলার থেকে আমরা যেটুকু বুঝেছি তাহলো খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মূল পান্ডা ‘মুম্বাই স্টাইলে’ কলকাতাতেও একটি নাশকতার ছক কষছে। বলে রাখা ভালো ‘খাগড়াগড় বিস্ফোরণ’ সর্বোপরি একটি গল্পকথা। এরপর কি হতে পারে, অনুমান করুন? একজন মুসলিম আইপিএস অফিসার জাকির আহমেদের ভূমিকায় যশ গুপ্ত’র আবির্ভাব। তিনি এসে এই গোটা নাশকতার ছক বানচাল করে দেন।

এখানে হলিউড ছবির সঙ্গে একটি সমান্তরাল মিল পাওয়া যায়। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সামাজিক ভাবে বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য এমন স্টিরিওটাইপিক্যাল ছবির অবতারণা করা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই।
আর এর ফলে একটি সম্প্রদায়কে ভীতর থেকে দূর্বল করে দেওয়া সম্ভব হয়। তাদেরকে সহজেই আক্রমনের নিশানা বানানো যায়। তাদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সর্বতভাবে দূর্বল করে দেওয়া সম্ভবপর হয়।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখানে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করবো। ঘটনাক্রমে ছবিটিতে দেখবেন নুসরত জাহান রুহি এবং মিমি চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন। লক্ষ্যনীয় যে দুজনেই তৃণমূল কংগ্রেসের বর্তমান সাংসদ। বসিরহাট ও যাদবপুর তাঁদের নির্বাচনী কেন্দ্র। আর এই দুটি নির্বাচনী কেন্দ্রেই মুসলিমরা সংখ্যা-গরিষ্ঠ। তাই এমন কার্যকলাপের সঙ্গে মুসলিমদের যুক্ত করার অর্থ এই গোটা সম্প্রদায়কে দূর্বল করা। তাদেরকে রাজনৈতিক ভাবে আরো বেশি কোনঠাসা করে দেওয়া।

কিন্তু এমন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি রাখা এই দুই মুভি তারকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জের কথা,
তাই নয় কি?

সময়ের দাবি মুসলিমদের ভিতর থেকে উঠে আসা বর্ধিষ্ণু আওয়াজ গুলিকে রুপোলি পর্দায় মেলে ধরা। বাংলা সিনেমায় তাদেরকে জায়গা দেওয়া। কল্পনায় ভর না করে সত্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিরীক্ষণ করে সিনেমার গল্প চয়ন করা। আম দর্শকদের জন্য সঠিক তথ্য নির্ভর গল্পের অবতারণা করা।

(নিবন্ধটি ‘দি ব্যাকগ্রাউন্ড’ থেকে অনুবাদ করা হয়েছেে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.