এক ব্যতিক্রমী সাংবাদিক- অনল আবেদিন
মোঃ সামসুল হালসোনা, শিক্ষক ও
মানবাধিকার কর্মী
প্রতিবেদন :- প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক এবং নাট্যকার এডওয়ার্ড বুল্যার লিটন(Edward Bulwer-Lytton) ১৮৩৯ সালে তার প্রখ্যাত নাটক ” Richelieu; Or the Conspiracy”তে লেখনির শক্তিকে প্রকাশ করেছিলেন জগৎ বিখ্যাত একটি বাক্য দ্বারা – “The pen is mightier than the sword” লেখনীর শক্তি তরবারির চাইতেও ধারালো”। এই একটি বাক্য গোটা জগতে একটি প্রবাদ বাক্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সাংবাদিক অনল আবেদিনের ক্ষেত্রেও এই শব্দবন্ধ গুলি নিঃসন্দেহে প্রযোজ্য হতে পারে।অনলদার লেখনীর তীক্ষ্ণতা এবং বাস্তব বিশ্লেষণ এমন ক্ষুরধার সম্পূর্ণ ছিল যা তরবারির ধারের চাইতেও ঝাঁঝালো। তিনি গ্রামের একটি ছোট্ট বিষয়কে তার বাস্তব ও বিশ্লেষণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এত সুন্দর করে হাজির করতে পারতেন যা সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তিনি তাঁর অনন্য লেখনীশৈলী ও সত্য অনুসন্ধানের পারদর্শী শিল্পী হিসাবে গোটা রাজ্যে এবং রাজ্যের বাইরেও ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি “খবরের ভেতর খবর” খুঁজে বের করার দক্ষতায় পারদর্শী ছিলেন এবং চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে খবর তৈরি করতেন।
সালটা ছিল ২০০৯। শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে বেলডাঙ্গার কাজীসাহা হাই মাদ্রাসায় সদ্য দুবছর কর্মরত । একদিন সকালে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় অক্ষরে হেডলাইন হয়েছিল ” খুদে হেডমাস্টার”। এমন ব্যতিক্রমী নামাঙ্কিত হেডলাইন সকলেকেই আকর্ষণ করার কথা। তার অনন্য এই প্রতিবেদনটি পড়ে জানতে পারলাম, মুর্শিদাবাদ জেলার মহুলা অঞ্চলের ভবানীপুর গ্রামের নবছর বয়সের পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ হেডমাস্টার বাবর আলীর কথা। আর কে আটকে রাখে বাবর আলীকে!বি বি সি , পরের দিন বাবর আলীকে নিয়ে যে হেডলাইন প্রকাশ করেছিল তা ছিল অনল আবেদিনের নামাঙ্কিত ইংরেজি অনুবাদ” The youngest headmaster of the world”. ব্যাস আগুনের ফুলকির মত সারা বিশ্বে ক্ষুদে হেডমাস্টার বাবর আলীর নাম এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। এমনই ছিল তাঁর লেখনি শক্তি। অজ পাড়া গ্রামের এক অচেনা বালককে সারা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন তার তীক্ষ্ণ বাস্তব এবং চুলচেরা বিশ্লেষণী লেখনি শক্তির মাধ্যমে।
লেখাটি পড়ে জানতে পেরেছিলাম বাবর আলীর প্রতিষ্ঠিত স্কুলের নাম ছিল “আনন্দ শিক্ষা নিকেতন”। আর এই “আনন্দ নিকেতনে” মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবর আলী এই স্কুল শুরু করেন, যেখানে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হয়। স্কুলটি প্রথমে তাঁর বাড়ির উঠোনে শুরু হয়েছিল এবং সময়ের সঙ্গে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। খুদে হেডমাস্টার বাবর আলীর উদ্যোগ এবং তার শিক্ষাদানের প্রচেষ্টা নিয়ে অনল আবেদীনের প্রতিবেদনটি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। এটি শিক্ষার গুরুত্ব এবং একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কীভাবে সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব, তা দেখিয়েছিল।
বাস্তব জীবনে যারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিসীম অবদান রেখেছিলেন, ইতিহাসে তাদের স্থান যথাযথ ভাবে বিশ্লেষণ হয়নি। সেটা অনুভব করেছিলেন অনল আবেদিন।সেইসব ঘটনাবলি এবং বালির চোরা স্রোতে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিবর্গদের বাস্তব কাহিনী তিনি তার চুম্বকীয় লেখনি শক্তির মাধ্যমে তুলে ধরতেন। তিনি সাংবাদিকতাকে শুধুমাত্র পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তা নয়, বরং তিনি সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তার সামাজিক দায়বদ্ধতাও পালন করেছিলেন। তিনি কোনটা “ভিউজ” এবং কোনটা “নিউজ” তার যথাযথ পার্থক্য করতে পারতেন। ভিউজ বলতে তিনি বোঝাতে চাইতেন রং চড়িয়ে কারোর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সংবাদ হিসাবে চালিয়ে দেওয়াকে। অন্যদিকে নিউজ হিসাবে তিনি সত্য, তথ্য নির্ভর এবং বাস্তবধর্মী লেখনিগুলোকে বোঝাতেন।
তিনি যখন আনন্দ বাজারে লিখতেন , তখন তাকে আমি চিনতাম না বা দেখিওনি। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত মুর্শিদাবাদ জেলার আনাচে কানাচের অনেক অচেনা গ্রাম, মহল্লা এবং পাড়ার সম্পর্কে তার লেখনি থেকে পরিচিতি লাভ করি। বলা যেতে পারে মুর্শিদাবাদ জেলাকে তার বাস্তব সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে গোটা রাজ্য সহ সারাদেশে এবং তামাম দুনিয়ার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ বেদনা ,সংস্কৃতি , অর্থনীতি, খাদ্যাভ্যাস, অভাব অভিযোগ , প্রভৃতি বিষয়কে চমৎকারভাবে এবং তার বাস্তব বিশ্লেষনী সাংবাদিক শিল্পীর কলম দিয়ে তুলে ধরেছিলেন যা ডকুমেন্টারি হিসাবে চিরদিন বিরাজ করবে।
সম্ভবত তখন তিনি আনন্দবাজার থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তখন তিনি সাহসিকতার সঙ্গে এবং মুক্ত ভাবে সামাজিক মাধ্যমে বহু মূল্যবান লেখা লিখেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পত্নী রানী স্বর্ণময়ী দেবীকে নিয়ে তার মূল্যবান লেখা। এমন তথ্য সহকারে তিনি মহারানীকে নিয়ে লিখেছিলেন যা একজন ঐতিহাসিকের দায়িত্ব পালন করার মতো। তার ফেসবুক পোস্ট থেকেই প্রথম জানতে পারি কৃষ্ণচন্দ্রের পত্নীর সম্পর্কে। নিজে শিক্ষার আলোতে আলোকিত না হয়েও, রাণী স্বর্ণময়ী শিক্ষার ক্ষেত্রে অপরিসীম সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিক্ষা ও নারীর উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। রাজা কৃষ্ণনাথের স্মৃতিতে তিনি ১৮৫৩ সালে বহরমপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে কৃষ্ণনাথ কলেজ নামে পরিচিত হয়। মহারাণী স্বর্ণময়ী কলেজের আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য জমি এবং অর্থ দান করেন, যা শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। স্বর্ণময়ী দেবীকে এবং তার অবদান সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের কাছে তুলে ধরার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অনল আবেদি নের। তার এই লেখা পড়ে হয়তো অনেকেই মহারানীকে নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করবেন। এইভাবে ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিবর্গকে তিনি তার সৃজনশীল কলম দিয়ে পুনরায় আলোকিত করেছিলেন। এইরকম বহু লেখা লিখে তিনি তার সামাজিক ও সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
অনল আবেদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় তার কর্মজীবনের সময় অসংখ্য উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, যা তার দক্ষতা এবং সাহসী সাংবাদিকতার জন্য প্রশংসিত। তার মধ্যে কিছু বিখ্যাত প্রতিবেদন সমাজ ও রাজনীতির জটিল বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। তার রিপোর্টিং শুধুমাত্র খবর সংগ্রহেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সেগুলি বিশ্লেষণ এবং সমাজে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তার লেখাগুলোকে আমরা নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করতে পারি।
1. সমাজ ও রাজনীতির গভীর বিশ্লেষণ: অনল আবেদিন প্রায়ই রাজনীতি এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন লিখতেন। তার প্রতিবেদনগুলোতে স্বচ্ছতা ও সাহসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
2. মানবিক গল্প ও সমস্যা: তিনি এমন কাহিনী তুলে ধরতেন যা সমাজের প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম এবং সফলতার গল্পগুলোকে আলোকিত করত। যেমন, তিনি গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার অভাব, শিশু অধিকার, এবং দারিদ্র্যের মতো বিষয়গুলিতে আলোকপাত করেছেন। তার লেখাগুলি সবসময় সামাজিকভাবে সচেতন এবং মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যেত। অনল আবেদিনের এই ধরনের সাহসী এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি আলাদা পরিচিতি দিয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বছর দুয়েক আগে এবং সেই সম্পর্ক টিকে ছিল তার মৃত্যু কাল অবধি। তার মস্তিষ্কপ্রসূত * পড়শি কথা” নামক একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত গর্ববোধ করি। পড়শিকথা নিছক একটি পত্রিকার নামই নয়, এটা ছিল একটি সামাজিক সংস্থা যা এই উপমহাদেশের বৃহত্তর দুই সম্প্রদায় তথা হিন্দু ও মুসলমান এর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো মজবুত ও দৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজে নেমেছে । পত্রিকাটি এখনো বিরাজমান এবং এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন অনল আবেদিন। এই পত্রিকাকে হাতিয়ার করে তিনি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কৃতির আদান-প্রদান এবং পরস্পর পরস্পরকে জানার জানার জন্য তিনি তার জীবনের শেষ লগ্নে চেষ্টা করে গেছেন। তার সাথে মেলামেশা করে তার সম্পর্কে যে ধারণা নিজের মধ্যে গড়ে উঠেছে তা হল তিনি ছিলেন আপাদ মস্তক একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এবং মানবিক গুণসম্পন্ন এক দুঃসাহসিক সাংবাদিক। আমরা যারা এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ,তারা পরবর্তীতে চেষ্টা করে যাব যাতে এই পত্রিকা অন্তত বছরের দুবার প্রকাশিত হয় এবং অনলদার স্বপ্নকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার।
যে কোন শিল্পী তার শৈল্পিক সৌন্দর্যের জন্য মানুষের মধ্যে চিরদিন বিরাজ করেন। একজন দক্ষ, মানবিক, সামাজিক দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে তিনি সাংবাদিকতার আকাশে নক্ষত্রের মতো চিরদিন আলো বিকিরণ করে যাবেন। এভাবেই তিনি অমরত্ব লাভ করবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।