বঙ্গ তথা বাংলার জমিনে প্রথম মুসলিম শাসকের শহর গঙ্গারামপুর আজ অবহেলিত দক্ষিণ দিনাজপুর:—লিখেছেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ ইয়ার আলী
ডাঃ ইয়ার আলী অয়ন বাংলা :- আমি কর্মসূত্রে দীর্ঘ পাঁচটি বছর অবস্থান করছি দক্ষিন দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুরে৷ এখান থেকে ১৩ কিমি উত্তর-পূর্বে গঙ্গারামপুর শহর৷ সাব ডিভিশন এলাকা৷ বালুরঘাট হল জেলার সদর শহর৷ অথচ, এই পাঁচটি বছরে কক্ষনই জানতে পারিনি যে, আমার নিকটবর্তী এই গঙ্গারামপুর শহরটি প্রায় আটশত বছর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম শাসিত শহর ছিল৷
বর্তমানের এই গঙ্গারামপুর শহরই তখন ছিল—”দেবকোট” শহর৷ এখনও তার বহু নিদর্শন বর্তমান৷ এই দেবকোট বা বর্তমানের গঙ্গারামপুর নিয়ে ভাঙ্গাগড়া ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে সেই আমলের গৌরবোজ্বল ইতিহাসটি বলব৷ মন দিয়ে পড়বেন এবং অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন— কীভাবে যুগের পরিক্রমায় পৃথিবীর চেহারাটা ধ্বংশাবশেষ এ পরিণত হয়৷ এবং সেটি আমরা অনেকেই বুঝতে চাইনা!
সময়টা দ্বাদশ শতাব্দির শেষ ও ত্রোয়দশ শতাব্দির প্রথমভাগ(১১৮৫-১২১০ খ্রীষ্টাব্দ)৷
চিন এর উত্তরান্চল থেকে দূর্ধর্ষজাতি মোঙ্গলরা চেঙ্গিশ খান ও তার উত্তরসূরী সন্তানেরা( ওগেদাই খান) মহম্মদ ( সঃ) ও তাঁর খোলাফায়ে রাশেদিন এর সুশাসনে ইসলামের জীবন-বিধান ও শান্তির বাণীতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিস্তৃত হতে হতে পৃথিবীর অধিকাংশ খোরাশান অন্চল , উত্তর-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ , রাশিয়া প্রভৃতি ভূমিগুলিতে সকল মুসলিমগুলিকে লাখে লাখে গণহত্যা চালাচ্ছে৷ বুখারা, বাগদাদ প্রভৃতি ইসলামী সভ্যতার শহরগুলিকে ধূলিস্মাৎ করে দিচ্ছে৷ বিপরীতে, খোরাশানের বিভিন্ন অন্চল থেকে উদীয়মান তুর্কীরা সেই বর্বর মোঙ্গলজাতিকে ঠেকা দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ আনাতোলিয়ায় উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের বাবা আরতুগ্রুল জীবন বাজি রেখে নানা যুদ্ধকৌশলী ও বুদ্ধিমত্তায় সেই মোঙ্গলদের সাথে যুযুধানে লিপ্ত আছেন৷ এদিকে, মিশরীয় সালতানাত মামলুক সাম্রাজ্য উত্তরপূর্ব ভারতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে৷ সাইফুদ্দিন বাইবার্স দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মামলুক সালতানাতের ভারপ্রাপ্ত গভর্ণর কুতুবুদ্দিন আইবক তখন দিল্লির মসনদে বসে উত্তর ভারতে ইসলামী শাসন করছেন৷
ঠিক সেই সময়ে , পূর্ব ভারত- বঙ্গদেশ( পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ) এ লক্ষণ সেন— নবদ্বীপ,নদীয়াতে; মালদার গৌড়ে এ ( সেই সময় নাম ছিল-লখনৌতি) প্রভৃতি রাজধানীগুলি ছোট ছোট রাজ্যে অমুসলিম শাসকেরা শাসন করত৷ কতকগুলি অন্তর্বর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও কূটকৌশলি পদক্ষেপে সেই সময় কুতুবূদ্দিন আইবকের নজরে আসেন ইখতিয়ারুদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ারুদ্দিন খলজি—যিনি আফগানিস্তান থেকে আগত খিলজি গৌষ্ঠির লড়াকু সেনা ও নেতা ছিলেন৷
এই রকম এক বিশ্ব পরিস্থিতির মহুর্তে বঙ্গদেশে তখন মুসলিম ছিলনা বললেই চলে৷ কুতুবুদ্দিন আইবকের নির্দেশে ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ারুদ্দিন খিলজি মাত্র ১৬-১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে নবদ্বীপ,নদীয়া জয় করেন৷ সেখানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করে, কিছুদিন অবস্থান করেন৷ একজনকে দায়িত্বভার দিয়ে অগ্রসর হন— মালদার গৌড় বা লখনৌতে৷ সেখিনেও জয়লাভ করেন৷
বঙ্গদেশে ইনিই সর্বপ্রথম মুসলিম শাসক ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেনাশক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন৷ ইসলামের সুশীতল ছায়াতে লাখ লাখ অনার্য ও অমুসলিম সম্প্রদায় প্রবেশ করে৷ ফলে, ব্যাপক ইসলামী প্রচার শুরু হয়৷ খালজি দাওয়াতি দ্বীনের কাজে দল নিযুক্ত করে বঙ্গদেশে ব্যাপক ইসলাম প্রচারও করেন৷ সেই শুরু বঙ্গদেশে মুসলিমদের যাত্রা৷ ইখতিরুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ারুদ্দিন খিলজি বেশ কিছু কাল অবস্থান করে পূর্ব ভারতকে ও তিব্বতকে ইসলামের ছায়াতে আনতে আগ্রহী হন৷ তখন ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দ৷ বর্তমানের রাজশাহি,বাংলাদেশ হয়ে তিব্বত সিমানা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে প্রত্যেক যুদ্ধে জয়ী হন৷ কিন্তূ, তিব্বত সীমান্তে বৌদ্ধদের কাছে পরাস্ত হয়ে মাত্র কয়েকশ সেনা নিয়ে পণঃরায় গৌড়ের দিকে বা লখনৌতে প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করেন৷ আরও যুদ্ধপ্রস্তূতি নিয়ে পুণঃরায় তিব্বত আক্রমনের সংকল্প নিয়ে আসতে থাকেন৷ পথিমধ্যে দিনাজপুর জেলা অতিক্রম করে “দেবকোট” শহরে পৌঁছান৷ এই শহরে অসুস্থতা অনুভব করলে, কিছুদিন অবস্থান করেন৷ তিব্বত অভিযানের প্রাক্কালে নিয়োগে রাখা আলি বোর্দান, সিরানি, গিয়াসুদ্দিন বর্তমানের বরিষাল, দিনাজপুর, গৌড়, নবদ্বীপ সামলাচ্ছিলেন৷
দেবকোটে অবস্থান কালে অভ্যন্তরীন কূটচক্রান্তের বলি হন — ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ারুদ্দিন খালজি৷ আলিবোর্দান তাঁকে নিহত করেন৷ তাঁর সমাধি দেবকোটেই করা হয়৷ আজও গঙ্গারামপুরের ঢলদিঘীর পাড়ে অবস্থিত একটি মসজিদে বা তার সংলগ্ন এলাকাই কবর আছে৷ সেই “দেবকোট” আজ ৮০০ বছরের ইতিহাস৷ খিলজির মৃত্যুর পরও প্রায় ১৫০ বছর ইসলামী শাসন ছিল এই গৌড়, দেবকোট তথা বঙ্গদেশে৷ এই সময়ই ব্যাপকভাবে মুসলিম জনপদ গড়ে উঠে৷ ইসলামী কালচার ও সংস্কৃতির পিঠস্থান হয়ে উঠে ঔ শহরগুলি৷
বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম সুমলিম শাসন ও ইসলামের প্রচারে যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হলেন— ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ারুদ্দিন খিলজি৷
ভারত-স্বাধীনতার সময় বহু মুসলিম এতদঅন্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ চলে গিয়েছে৷ ৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বহু মুসলিম মালদা, দিনাজপুর, নদীয়া, দেবকোট ছেড়ে বাংলাদেশ চলে গিয়েছে৷ ফলতঃ এলাকাগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যা নিতান্তই নগন্য হয়ে পড়েছে৷
আদিপুরুষের ভিটার টানে যে সকল মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গে থেকে গেছে— তাদের উত্তরসূরীদের নিয়ে বর্তমানে কিছু কিছু মুসলিম বাড়ী এখনও আছে৷
সেই “দেবকোট” যুগের পরিবর্তন ও সময়ের চাকাতে ঘুরতে ঘুরতে ইট পাথর আর নূড়ির ঢিবি বা জমিনে পরিণত হয়েছে৷ বিশাল প্রাসাদের কিছু কিছু খন্ডিত চিত্র আজও বিরাজমান৷
নিচে এই দেবকোটের কিছু খন্ডচিত্র দেওয়া হল৷
বিস্মৃত ইতিহাসকে মনে করে নষ্টালজিক মনে হচ্ছে! বাংলার জমিনে প্রথম যোগ্য ও মুসলিম শাসক ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ারুদ্দিন খিলজিকে ও তাঁর ব্যাপকতা অনুভব করতে আপনারা “দেবকোট” বা গঙ্গারামপুর দর্শণ করতে পারেন৷
কোথায় জন্ম আফগানিস্তানে; আর কবর তাঁর দেবকোটে৷
তাঁর জীবণের যাত্রা ছিল— ইসলামের প্রসার, প্রচার আর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা৷
আল্লাহ, তাঁকে জান্নাত নসীব করুন৷