কয়েকজন বিজেপি নেতা মন্ত্রীকে ভারতীয় নাগরিক কি না প্রমান করতে হবে এন আর সি হলে

Spread the love

কয়েকজন বিজেপি নেতা মন্ত্রীকে ভারতীয় নাগরিক কি না প্রমান করতে হবে এন আর সি হলে:- লিখেছেন সৌম্য মণ্ডল

প্রতিবেদন সৌম্য মন্ডল:- রাষ্ট্রের কাছে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য কালঘাম ছোটাতে হচ্ছে ভারতের নাগরিকদের। সবাই চিন্তিত এই নিয়ে যে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কী কী কাগজ জোগাড় করতে হবে। অন্যদিকে বিজেপি নেতারা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে এনআরসি এবং সিএএ কতটা কাঙ্ক্ষিত এবং সহজ প্রক্রিয়া। আমরা আজ দেখে নেবো, যদি এনআরসি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ হয়,তাহলে কয়েকজন প্রথম সারির বিজেপি নেতা মন্ত্রীকে নিজের নাগরিকত্ব প্রমানের জন্য কী কী কাগজ জোগাড় করতে হবে।
৮ নভেম্বর ১৯২৭-তে করাচিতে জন্মেছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। যুবক বয়সেই তিনি ব্রিটিশপন্থী উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহঃ আলি জিন্নাহকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। যদিও ‘ভারতপ্রেমী’ এই নেতা ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভারতকে তার দেশ হিসেবে বেছে নেননি, পাকিস্তানেই রয়ে যান। অবশেষে ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তানে হিন্দুদভাইদের ত্যাগ করে,তাদের নেতৃত্বহীন করে দিয়ে ভারতে চলে আসেন।
(গুজরাটের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কি ভারতীয়? জমেছে বিতর্ক)

সুতরাং জন্মের স্থান ও তারিখ অনুযায়ী আদবানিজি ভারতের নাগরিক আইন অনুসারে জন্মগত ভাবে ভারতের নাগরিক নন। সংবিধানের৬ (এ) (বি)(i) ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তির অথবা কোনো ব্যক্তির বাবা মায়ের দাদু ঠাকুমার মধ্যে অন্তত একজন যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন এবং তিনি যদি পাকিস্তানভুক্ত এলাকা (বর্তমানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) থেকে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই এর মধ্যে ভারতে এসে থাকেন তবে তিনি ভারতের নাগরিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে তিনি ভারতে প্রবেশ করেননি। সুতরাং ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার সেই সুযোগও তিনি হারিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতে এসে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানিয়ে যদি নাগরিকত্ব পেয়ে থাকেন এবং তার এত বছরের পুরনো নাগরিকত্বের সার্টিফিকেটটি যদি পোকায় না খেয়ে নিয়ে থাকে তবে তিনি ভারতের নাগরিক।

কিন্তু যদি তিনি নাগরিকত্বের আবেদন না জানিয়ে থাকেন বা তার নাগরিকত্বের সার্টিফিকেটটি নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে তবে তিনি নিজের বানানো ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অনুযায়ী অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।

গুজরাটের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রামনিক লাল রুপানির জন্ম ১৯৫৬ সালের ২ আগষ্ট মায়ানমারে। ভারতের মাটিতে যেহেতু তিনি জন্মাননি তাই জন্মসূত্রে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ভারতের নাগরিক নন। প্রশ্ন হল রুপানির মা বা বাবাকি সংবিধান গ্রহণের আগে অর্থাৎ ১৯৫০ দের ২৬ জানুয়ারির আগে ৫ বছর ভারতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন? যদি করে থাকেন তবে রুপানির মা বাবা ভারতীয় নাগরিক ছিলেন, নয়তো রুপানির কপালে দুঃখ। আর বাবা মা-এর নাগরিকত্বের ভিত্তিতে যদি আবেদন মারফত শিশু রুপানির নাগরিকত্ব অর্জিত হয়ে থাকে এবং এই সব প্রমাণ করার জন্য নথিপত্র যদি দেখাতে পারেন তবে তিনি ভারতের নাগরিক। অবশ্য নথিপত্র যদি পোকায় খেয়ে থাকে তবে তিনি নাগরিক নন।

ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের নামে উইকিপিডিয়া পেজটি অসমে এনআরসি-র চুড়ান্ত তালিকার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তিন দিনে ৩৭ বার পরিবর্তন করা হয়েছে। এনআরসির তালিকা বেরনোর আগে উইকিপিডিয়া পেজে লেখা ছিলো বিপ্লব দেব ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্মেছিলেন। অসমে এনআরসির চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর বিপ্লবের ভারতীয় নাগরিকত্বের উপর প্রশ্ন উঠতে থাকে। এর ফলে উইকিপিডিয়া পেজটি এডিট করে বিপ্লবের জন্মস্থান বদলে ত্রিপুরার গোমাতি জেলার নাম লেখা হয়। তাড়াহুড়োয় পেজ এডিট করতে গিয়ে বাকি জীবনীর সাথে বার বার জন্মস্থানটির বিরোধ বাঁধে। ফলত বার বার গোজামিল দিতে গিয়ে এতবার এডিট করতে হয়।

যদি বিপ্লব দেব বাংলাদেশে জন্মে থাকেন তবে তিনি ভারতের নাগরিক নন। তার বাবা মা বাংলাদেশ/ পাকিস্তানের হওয়ায় তিনি বাবা মার সুত্র ধরে নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অধিকারও তার নেই, যে সুবিধা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী রুপানি পেতে পারেন। যদি না বিপ্লব দেবের মা-বাবা ভিসা পাসপোর্ট বানিয়ে ভারতে এসে আবেদন জানিয়ে নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট পেয়ে থাকেন। নয়তো বিপ্লব দেব বা তার মা-বাবা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ২০০৩ সালের পর বিপ্লব দেবের মত ‘অবৈধঅনুপ্রবেশকারী’দের কাছ থেকে কিন্তু নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাবার অধিকার কেড়ে নিয়েছে বাজপেয়ী সরকার। আর যদি বিপ্লব দেব ত্রিপুরায় জন্মে থাকেন তবে তাকে জন্ম সার্টিফিকেট দেখালেই চলবে। আর যদি জন্ম সার্টিফিকেট না থাকে তবে দেখাতে হবে বিপ্লব দেবের পূর্ব পুরুষ ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে ভারতে ছিলেন। যা দেখানো বিপ্লবের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

২২ অক্টোবর ১৯৬৪ সালে মুম্বইয়ে জন্মেছিলেন অমিত শাহ। শাহ পদবি ইরান থেকে এলেও, এটা বলা যায়না যে অমিত শাহের মা বাবাও ইরানের নাগরিক। আর যদি অমিত শাহের মা-বাবা যদি ইরান থেকে এসেও থাকেন তবুও জন্মের তারিখ ও স্থান অনুযায়ী অমিত শাহ ভারতের স্বাভাবিক নাগরিক। যদি তিনি জন্ম সার্টিফিকেট দেখাতে পারেন। কিন্ত সেই সময় জন্ম সার্টিফিকেট ছিলো না। ফলত অমিত শাহকে দেখাতে হবে তার পূর্বপুরুষ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারির আগে পাঁচ বছর ভারতে ছিলেন বা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে ভারতে ছিলেন।

১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে গুজরাটের ভাটনগরে জন্মেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুষ্টু বাঙালিরা বলছে জন্মস্থানের নামের সাথে মোদির স্বভাবের মিল আছে, যাকে বলে সার্থক জন্মা। সংবিধানের ৫ নং ধারা অনুযায়ী মোদিজি জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। তাই শুধু জন্ম সার্টিফিকেট দেখালেই চলবে। যেহেতু সেই সময় জন্ম সার্টিফিকেট ছিলো না তাই মোদিজিকে দেখাতে হবে তার বাবা অথবা মা ১৯৪৮ এর ১৯ জুলাইয়ের আগে ভারতে ছিলেন তার প্রমাণ বা সংবিধান গ্রহনের আগে তার বাবা-মা ৫ বছর ভারতে ছিলেন তার প্রমাণ।

বিপ্লব দেব বা আদবানি যদি ভারতে ঢুকেই সরকারকে লিখিত ভাবে জানিয়ে থাকেন যে তারা ধর্মীয় হিংসার কারণে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন তবে সিএএ-র আওতায় আসতে গেলে আর তাদেরকে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ধর্মীয় হিংসার শিকার হওয়ার প্রমান দিতে হবে না। কিন্তু তারা যদি ভারতে ঢুকেই সরকারকে ধর্মীয় হিংসার কারণে তাদের ভারতে আসার কথা না জানিয়ে থাকেন, তবে তাদের নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যা তারা বা তার পূর্বপুরুষ আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন এবং ধর্মীয় হিংসার কারণে এসেছিলেন। সাধের সিএএ-র আওতায় আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগটুকুও অবশ্য বিজয় রুপানি বা নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ পাবেন না। কারন তারা বাংলাদেশ পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসেননি।

ভারতে জন্ম সার্টিফিকেটের সূচনা হয় ১৯৬৯ সালে। যদিও এর পরেও তা ব্যাপক ভাবে চালু হয়নি। ফলত ১৯৭০ বা ১৯৮০ দশকে যাদের জন্ম তাদেরও অনেকের জন্ম সার্টিফিকেট নেই। বিজেপির যে কচি নেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এনআরসি-র উপকারিতা বোঝাচ্ছে তাদের জন্ম যদি ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পরে হয়ে থাকে, তাদের শুধু নিজেদের জন্ম সার্টিফিকেট দেখালেই চলবে না, তাদের বাবা অথবা মায়ের ভারতে জন্মের সার্টিফিকেট দেখাতে হবে আর যাদের জন্ম ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের এর পরে তাদের দেখাতে হবে তাদের মা বাবার দুজনের ভারতে জন্মের সার্টিফিকেট। যদি ২০০৪,৩ ডিসেম্বরের পর জন্মানোর দাদু-দিদা বা ঠাকুরদা-ঠাকুমার মধ্যে কোনো এক জোড়া নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারে তবে তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে বসে এনআরসি-র অপকারিতা নিয়ে প্রচার করতে হবে। আর তাছাড়া ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ে আগে পূর্বপুরুষের ভারতে অবস্থানের প্রমাণপত্র আদৌ পাওয়া যাবে কিনা তা পুরোপুরি কাগজখেকো দেশদ্রোহী পোকাদের দয়ার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু বিজেপি নেতাদের চিন্তা কমানোর অন্য রাস্তা আছে। ১৯৫০ সালের মোদিজির ঝাঁচকচকে বার্থ সার্টিফিকেট সহ সমস্ত নথিপত্র জোগাড় করা সম্ভব হবে যদি বিজেপি আইটি সেলের ফটো এডিটররা পবিত্র দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।

আর যদি এনআরসি-র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায়, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ভারতীয় জনগণকে তেমন কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে না, তাহলে বুঝতে হবে নিজেদের নেতাকর্মীদের বাঁচাতেই জনগণের সুবিধা করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মোদিশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.