বাজেট ২০২৫: বৈষম্যের নীতিতে অনড় মোদি সরকার। পাশারুল আলম
প্রতিবেদন :- ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মোদি সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন, যা স্পষ্টতই অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ানোর পথে আরও এক ধাপ এগোল। যেখানে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দিশেহারা, সেখানে এই বাজেট কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষায় মনোযোগী হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাব এবং নীতিগত দিশাহীনতার কারণে এই বাজেট শ্রমিক, কৃষক ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এল।
কল্যাণমূলক ব্যয়ে কাঁচি, ধনীদের জন্য ছাড়
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের সংকট। প্রত্যাশা ছিল সরকার ধনীদের উপর কর বাড়িয়ে সামাজিক খাতগুলিতে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। কল্যাণমূলক খাতে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে, যেখানে কর্পোরেটদের উপর কর বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
২০২৪-২৫ সালে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ২০.২২ লক্ষ কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯.২৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা প্রায় ৯৪,০০০ কোটি টাকা কম। এর অর্থ, সরকার বাজেট ঘোষণার সময় বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
বিগত বছরে এমজিএনআরইজিএ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, গ্রামীণ পানীয় জল মিশন এবং শিক্ষাবৃত্তির মতো প্রকল্পগুলিতে অর্থ বরাদ্দ ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনার বরাদ্দ এক ধাক্কায় ১৫,৬৮৪ কোটি টাকা থেকে ১,২৪২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা কৃষকদের জন্য বড় ধাক্কা।
কৃষি ও শ্রমজীবীদের প্রতি অবহেলা
ভারতের কৃষকদের জন্য এই বাজেট কোনো আশার আলো নিয়ে আসেনি। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) নিয়ে কৃষকরা আন্দোলন করলেও সরকার বাজেটে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। কৃষি খাতে ভর্তুকি ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির বরাদ্দ কমানো হয়েছে, যা কৃষকদের সংকট আরও গভীর করবে।
একইভাবে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষেত্রেও এই বাজেট আশানুরূপ কিছুই দেয়নি। গত এক বছরে দেশের বেকারত্ব হার বাড়লেও এই বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা শ্রমজীবী মানুষদের সুরক্ষা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। স্কিম কর্মী—আশা, আঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি হ্রাস এবং চাকরির অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কর্পোরেটদের প্রতি পক্ষপাত এবং মধ্যবিত্তের সামান্য সান্ত্বনা
একদিকে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমূলক ব্যয় কমানো হচ্ছে, অন্যদিকে কর্পোরেট খাতের উপর করের বোঝা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই।
বর্তমানে কর্পোরেট করের হার ব্যক্তি আয়করের তুলনায় অনেক কম। এমনকি আয়কর সংগ্রহ কর্পোরেট করের চেয়ে বেশি। তা সত্ত্বেও সরকার বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে কর্পোরেট করের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং মধ্যবিত্তদের জন্য কিছু আয়কর ছাড় দিয়ে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এই ছাড় বাস্তবিক অর্থে খুব সামান্য, কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ইতিমধ্যেই ব্যয়ের চাপে পিষ্ট।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে জনসেবার কাঁটছাঁট
২০২৫-২৬ সালের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারের ব্যয়ের বড় অংশই আগের ঋণের সুদ পরিশোধে যাচ্ছে। বাজেট ব্যয়ের প্রায় ৪০% কেবল ঋণের সুদ শোধে ব্যয় হচ্ছে, যা সরকারের আর্থিক সংকটকেই নির্দেশ করে। অথচ এই ঘাটতি পূরণ করতে কর্পোরেটদের উপর কর বাড়ানোর পরিবর্তে কল্যাণমূলক ব্যয় কমানোর পথ বেছে নেওয়া হয়েছে।
এটি সরকারের ভুল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন, যেখানে ধনীদের সুবিধা বজায় রাখার জন্য গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বলি দেওয়া হচ্ছে। এই বাজেট মোদি সরকারের প্রকৃত নীতি স্পষ্ট করেছে—জনগণের কল্যাণ নয়, বরং কর্পোরেট মুনাফা বৃদ্ধিই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
পরিশেষে বলা যায়, ২০২৫ সালের বাজেট ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়াবে, তা স্পষ্ট। কৃষক, শ্রমিক, নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশা কমানোর বদলে সরকার ধনীদের স্বার্থরক্ষায় মনোযোগী হয়েছে। কল্যাণমূলক ব্যয় হ্রাস, কর্পোরেটদের বিশেষ সুবিধা এবং কর্মসংস্থানের অভাবে এই বাজেট দেশের বৃহৎ অংশের জনগণের জন্য এক হতাশাজনক দলিল হয়ে থাকল।
সরকার যদি অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে চায়, তবে কর্পোরেটদের কর বৃদ্ধি, শ্রমজীবী মানুষদের সুরক্ষা এবং কৃষকদের ন্যায্য দাবির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় এই বাজেট ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করে দেবে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
![](https://ayanbangla.in/wp-content/uploads/2022/06/tea.jpeg)
![](https://ayanbangla.in/wp-content/uploads/2022/05/Ads.jpeg)