বাসব রায়: পেটোয়া চ্যানেলের অবোধ সাংবাদিকের সাজানো প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী কী অসত্য বলেছেন সবাই জানেন, এ বিষয়ে (২৪ ডিসেম্বর) থেকে প্রচুর লেখালিখিও হয়েছে। তবে আমি দেখতে চাই যা সত্য বলেছেন, সেটুকু। যেমন সত্য বলেছেন, এ বছরের ৩১ জুলাই এনপিআর-এর নোটিফিকেশন জারি করা হয়েছে। শুধু (২৪ ডিসেম্বর) ক্যাবিনেট তাতে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সরকার অর্থবরাদ্দ করেছে। আবার বলেছেন, পপুলেশন রেজিস্ট্রার বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রারের জন্য একটি অ্যাপ হবে। ওই অ্যাপের মাধ্যমে অসম বাদে গোটা দেশের লোকজন সব তথ্য জমা করবেন, যেসব তথ্য চাওয়া হবে। যেমনটা মাসখানেক আগে দেশবাসী করেছেন ভোটার কার্ড সংশোধন প্রক্রিয়ায়।
এটা ঠিকই যে, ২০১০ সালে কংগ্রেস সরকার পপুলেশন রেজিস্ট্রারের কাজ শুরু করেছিল, শেষ করেনি। তখন অবশ্য এনআরসি প্রসঙ্গ ছিল না। আবার এটাও ঠিক যে, কংগ্রেস নয়, বাজপেয়ী সরকারের আমলে দ্য সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন্স অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) রুলস, ২০০৩ তৈরি হয়। এই নিয়মের ৪ নং বিধি অনুযায়ী, বাড়ি বাড়ি সার্ভে করে পপুলেশন রেজিস্ট্রার তৈরি করা হবে, যাতে প্রত্যেক বসবাসকারীর নাম ও বিবরণ থাকবে। অতঃপর সেই পপুলেশন রেজিস্ট্রার যাচাই করে এনআরসি প্রস্তুত করা হবে। নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহজনক ব্যক্তি বা পরিবারকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হবে এবং উপ-জেলা বা তহশিল বা মহকুমা নাগরিক পঞ্জিয়ক সেই ব্যক্তি বা পরিবারকে নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ দেবেন। তারপর খসড়া প্রকাশিত হবে এবং দাবি ও আপত্তি উল্লেখিত কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করবেন। এতে বাদ পড়া সবাই রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করবেন এবং জেলা রেজিস্ট্রার শেষসিদ্ধান্ত নেবেন। এটাই হল সারাদেশে নাগরিকপঞ্জি তৈরির নিয়ম। কথা হল, এই নিয়মে নাগরিকত্ব যাচাই বা পরীক্ষণের বিষয়টি উল্লেখিত কিন্তু যাচাই বা পরীক্ষণের কোনও প্রক্রিয়া বা ভিত্তির উল্লেখ নেই।
এ পর্যন্ত পড়লে আপাতদৃষ্টিতে সব কিছুই স্বাভাবিক ঠেকে। এবং ঠেকে না। কেন না এখানেই সিএএ প্রযুক্ত হবে।
সিএএ-র মূল কথা হল, মুসলমান ও ইহুদি বাদে ভারতের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বা তারা ইতিমধ্যেই নাগরিক। কেন না সিএএ-তে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে আগত হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিস্টান-জৈন-পার্সি সবাই নাগরিকত্ব পাবে। আর এনপিআর হলে মোটামুটি নাম দেখেই বোঝা যাবে মুসলমান ও ইহুদিকে। এবং যাবতীয় সন্দেহের শিকার হবেন তারাই। তাদেরই নোটিশ দিয়ে বলা হবে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে। এবং এটাই সিএএ-র মূলভাবনা। উল্লেখ্য, ভারতে ইহুদি জনসংখ্যা অত্যন্ত কম, ফলত, নাগরিকত্বের নোটিশ বেশি বেশি করে আসবে মুসলমানদের কাছে এবং হ্যাঁ, একমাত্র মুসলমানদের কাছেই।
কেন না হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিস্টান-জৈন-পার্সিকে নাগরিকত্ব প্রমাণের কথা বললে সিএএ-পরবর্তী ভারতে কিছু এসে যায় না। এরা সবাই সিএএ-র সূত্রে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন, কিন্তু মুসলমান বা ইহুদি পাবে না।
বলা হচ্ছে ঠিকই যে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে কোনও এক্সক্লুশন নেই, সবই ইনক্লুশন; কিন্তু এই আইন তৈরির মূললক্ষ্যই হল ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রারের ভিত্তিতে সন্দেহজনক নাগরিকদের (যা অবধারিত মুসলমান ও ইহুদি) নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ দেওয়া। এবং সেখানে উত্তীর্ণ না হলে ডেনিজেন করা।
মায়ানমারের রোহিঙ্গিয়ারা যেমন জমি কিনতে পারে না, চাকরি করতে পারে না, ভোট দিতে পারে না– ঠিক তেমন হবে অ-নাগরিকদের অবস্থা। শুধু কাজ করো আর ভাত খাও, ব্যাস।
অসমের অর্থ তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘৭৫ লক্ষ মানুষকে তাড়ানোর’ কথা। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সভাপতি বলেছেন, ‘দু’কোটি মুসলমানকে তাড়ানোর’ কথা। সবই ওই সিএএ-র ওপর ভিত্তি করে।
এনপিআর যদি হয়েই যায়, তার ভিত্তিতে যদি মুসলমানদের নোটিশ দেওয়াই হয় নাগরিকত্ব প্রমাণের, তা হলে তাদের করণীয় কী?
অসমের মতো গোটা ভারতের জন্য বিদেশি নির্ধারণের কোনও ভিত্তিবর্ষ অর্থাৎ কাট-অব-ডেট নেই। অসমের পরিস্থিতি আলাদা। যার জন্য ১৯৫১ সালে গোটা দেশের মধ্যে একমাত্র অসমে এনআরসি হয়েছিল সে বছরের সেনসাস রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে। অসমে ১৯৭৯-৮৩ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর হয়েছে অসম চুক্তি। অসমের জন্য নাগরিকত্ব আইনের বিধি আলাদা। যেখানে বিদেশি নির্ধারণের কাট-অব-ডেট ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। ২০০৫ সালে অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও অল আসাম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (আসু) নেতাদের মধ্যে যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছিল, সেটাই অসমে এনআরসি-র মূলসূত্র।
অসম চুক্তিতে এনআরসি শব্দটাই নেই। ওই ত্রিপাক্ষিক বৈঠক এবং প্রথম এনডিএ সরকারের আমলে বানানো দ্য সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন্স অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) রুলস, ২০০৩-এর ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল অসমের একটি সংগঠন এপিডব্লিউ। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ২০১০ সালে অসম সরকার যখন এনআরসি-র কাজ শুরু করে, বরপেটায় প্রবল অসন্তোষ তৈরি হয়, গুলি চলে, তিনজন মারা যান। তারপর এনআরসি-র কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং, অসমকে দেখিয়ে গোটা দেশে এনআরসি দরকার জাস্টিফাই করেন যারা, বলে দিতে হয় না, তারা মিথ্যেই বলেন।
এবং অসমে এনআরসি নবায়ন প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তাই এর প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ছিল অন্যরকম। প্রথমে ধরে নেওয়া হয়েছিল সবাই বিদেশি এবং তারপর ১৬-১৭টা নথি দিয়ে প্রমাণ করতে বলা হয়েছিল সবার নাগরিকত্ব। ১৯৭১ সালের আগের যে কোনও সরকারি নথি হলেই চলবে, এরকম ছিল পদ্ধতি।
গোটা ভারতের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে হবে উলটোটা। সবাইকে স্বদেশি ধরে নিয়ে এনপিআর। আর তারপর বেছে বেছে নোটিশ। অসমে একে বলা হয় ডি-ভোটার নোটিশ। অর্থাৎ ডাউটফুল ভোটার। এনপিআর-পরবর্তী ভারতে এটাই হবে ডি-সিটিজেন নোটিশ।
তা হলে মোকাবিলা করবে কীভাবে? আন্দোলন-প্রতিবাদ-মিছিল-সভা এসব তো চলছেই, সুপ্রিম কোর্টে সিএএ নিয়ে মামলাও চলছে। আমি অন্য একটি মামলার রায় উল্লেখ করতে পারি, যেখানে বলা হয়েছিল, ভোটার মাত্রেই নাগরিক। যা সংবিধানের ৩২৬ ধারায় লেখা আছে। মামলাটি হল লালবাবু হুসেন ও অন্যান্য বনাম ইলেকটোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার অ্যান্ড আদার্স, ১৯৯৫ এআইআর ১১৮৯, ১৯৯৫ এসসিসি (৩) ১০০। সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির রায়ের গুরুত্ব আছে এনপিআর-এনআরসি-সিএএ জর্জরিত ভারতের প্রেক্ষাপটে। আগ্রহীরা পড়তে পারেন।
এবং ১৯৮৭ সালের আগে যারা ভারতে জন্মেছেন, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভারতের নাগরিক। এরপর যাদের জন্ম, তাদের মা-বাবাকে ভারতীয় হতে হবে। এবং সেটি প্রমাণ হবে খুব সহজভাবে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ওই সময়-পূর্ববর্তী ভোটার তালিকায়। যার ব্যবস্থা করা উচিত সব রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের।
সৌজন্য:- Mahanagar desk