প্রতিবেদন:- বাংলাদেশ থেকে এসে যারা এদেশে বসবাস করছেন তাঁদের সংখ্যাটা যাই হোক না কেন তাঁরা সকলেই মূলত হিন্দু। তাঁরা নাগরিক অধিকার ও পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন লড়াই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
বাংলার পরিস্থিতি আসামের বিপরীত। আসামে খেদানোর আন্দোলন হয়েছে, আর বাংলায় হয়েছে গ্রহণ করে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন। ২০০৩ সালে বড়ো আঘাত আসে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। নিঃশব্দে। নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫)-তে দুটি নতুন কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মূল আইনে ২ ধারায় একটি অংশ জুড়ে দিয়ে বৈধ পাসপোর্ট ছাড়া এদেশে আসা বা বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও থেকে যাওয়া সকলকে “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং মূল আইনের ১৪ ধারায় ১৪(ক) ধারা যুক্ত করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও জাতীয় পরিচিতিপত্র চালু করার কথা বলা হয়। তৎকালীন ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট সরকার এই সংশোধন আনে। দেশের সমগ্র গণজন ও বিশেষ করে বাংলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিরুদ্ধে এ এক নিপুন সার্জিকাল স্ট্রাইক।
এখন নতুন করে আবার নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনার কথা বলছে বিজেপি। সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট বিল ২০১৬, সংক্ষেপে ‘ক্যাব’। এই সংশোধনে তিনটি মূল কথা আছে। প্রথমত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দু (এবং আরও পাঁচটি) ধর্মের মানুষকে “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে গণ্য করা থেকে নিস্কৃতি দেওয়া, দ্বিতীয়ত এরকম আশ্রয়প্রার্থী’র ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ভারতের নাগরিকত্ব দাবী করার জন্য ন্যুনতম বসবাসকাল ১১ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করা, এবং তৃতীয় ধারাটি হল ‘প্রবাসী ভারতীয় নাগরিক’ কার্ড প্রাপ্তরা কোনও ভারতীয় আইন ভঙ্গ করলেই তাঁদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দিতে পারবে সরকার।
নতুন এই সংশোধনী প্রস্তাব ভারতের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদের উল্লঙ্ঘন করে, কারণ নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষকে (মুসলমানদের) আইনটি এক চোখে দেখছে আর হিন্দু সহ বাকি ধর্মের মানুষকে অন্য চোখে দেখছে—এরকম সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈষম্য ভারতীয় সংবিধান অনুমোদন করেনা। কিন্তু সে প্রশ্নে বিস্তারিত চর্চা না করে, যদি ধরেই নেওয়া যায় যে এই সংশোধনী শেষ পর্যন্ত পাস করিয়ে নেবে বিজেপি সরকার, তাহলেই বা বাংলার উদ্বাস্তুরা প্রকৃতপক্ষে কী পাবেন?
তাঁদের আর “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে গণ্য করা হবেনা একথা ঠিক কিন্তু তারা কি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়ে যাবেন? না। তাঁরা “ইমিগ্রান্ট” হিসেবেই গণ্য হবেন। ইল্লিগাল না হলেও ইমিগ্রান্ট। এমনকি ‘শরণার্থী’ বা ‘রিফিউজি’-ও নয়। কারণ, ‘শরণার্থী’ শব্দটিই এখনও ভারতের কোনও আইনে বর্ণনা করা নাই এবং শরণার্থী প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সনদেও ভারত এখনও স্বাক্ষর করেনি। ‘ক্যাব’ পাস হলেও তাদের প্রথম ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন।তারপর, ছয় বছর ইমিগ্রান্ট হিসেবে বসবাস করার পর তাঁরা আবেদন করতে পারবেন ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার। ‘ক্যাব’ তাদের এটুকুই এগিয়ে দেবে।
এটা কি এগিয়ে দেওয়া? নাকি উদ্বাস্তু অধিকারের আন্দোলনকে দুর্মুশ করে দেওয়া? নতুন এই সংশোধনী বিল সম্পর্কে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি (জেপিসি) ৮ জানুয়ারি ২০১৯ তাঁদের রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে এই সংশোধনী পাস হলে মোট ৩১,৩১৩ জন, যারা ইতিমধ্যেই আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন এবং লং টার্ম ভিসা গ্রান্ট করা হয়েছে, তাঁরাই উপকৃত হবেন।
জেপিসির প্রশ্নের উত্তরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) স্পষ্ট ভাষায় লিখে জানিয়েছে যে এই ৩১,৩১৩ জন ছাড়া “বাকি সকলকে এই ক্যাটেগরিতে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতে ঢোকার সময় যদি তারা একথা ঘোষণা করে না থাকেন তাহলে এখন সেরকম দাবী করাটা সহজ হবেনা। ভবিষ্যতে এরকম দাবী এলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে অবশ্যই তাকে R&AW (র) সহ বিভিন্ন সংস্থার স্ক্রুটিনির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে”।
আই বি আরও জানায় যে যাঁরা ইতিমধ্যেই ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, ইত্যাদি পেয়ে গেছেন তাঁরা এই ‘ক্যাব’ ক্যাটেগরিতে পড়বেন না এবং তাঁদের ওইসব কার্ড অবৈধভাবে করা কি না তা খতিয়ে দেখা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং তা করার জন্য ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আছে (জেপিসি রিপোর্ট, ২ দাগের ১৭-১৯ পয়েন্ট, পৃষ্ঠা ৩৯)।
পহেলা অক্টোবর অমিত শাহের সভাগৃহে যারা উপস্থিত হয়েছিল তারা কেউই “এনআরসি চাই” বলে গলা মেলাতে পারেনি বিজেপি সভাপতির সাথে। সভাপতি বারবার “জোরসে বোলো, জোরসে বোলো” করছিলেন বটে কিন্তু সাড়া পাননি। কিছুক্ষণের মধ্যে সভায়তন ফাঁকা হয়ে গেছিল। এই হতাশার ধাক্কায় পর দিন ঠাকুরনগরে একটি এনআরসি-বিরোধী ওয়ার্কশপে হামলা চালিয়ে উদ্বাস্তু আন্দোলনের পরিচিত মুখ তথা এনআরসি ও ক্যাবের বিরুদ্ধে মুখর ব্যক্তিত্ব শ্রী সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস এবং মতুয়া মহাসঙ্ঘের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বালা ঠাকুরের ওপর হামলা চালায় সেখানকার বিজেপি নেতৃত্ব। এই ওয়ার্কশপে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি দলিত-মুসলমান ঐক্যের যে বার্তা ছড়াচ্ছিল, তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে।
এই হামলা থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এনআরসি ও ক্যাব নিয়ে বিজেপির অপপ্রচার বাংলার নমশুদ্র সমাজে তেমন গ্রহণযোগ্য হচ্ছেনা। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজ ও পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী ও মাহাতো সমাজকে বিজেপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা তো ভূমিপুত্র, তাদের নাম তো আর বাদ যাবেনা! তবে ধীরে ধীরে সকলেই বিজেপির ধোঁকাবাজী ধরে ফেলছে।