নিউজ ডেস্ক :- এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে দীর্ঘ সাত মাস পরে মথুরা জেল থেকে মুক্তি পাবার পর সম্প্রতি সর্বভারতীয় সংবাদপত্র আউটলুকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় নিজের জেলবন্দী থাকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ডাক্তার কাফিল খান। জেল থেকে বেরিয়েই কাফিল খান বলেছেন তাঁকে টানা পাঁচদিন খাবার তো নয়ই, জল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার তিনি যা বললেন তা সত্যিই ভয়াবহ। কাফিল খানের অভিযোগ জেলে তাঁকে রীতিমত উলঙ্গ করে পিটিয়েছে পুলিশ। এতটাই ভয়াবহ ভাবে তাঁকে মারা হয়েছিল যে তিনি বেশ কয়েকদিন ভালোভাবে বসতে পর্যন্ত পারেননি।
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন তিনি মুসলিম বলেই তাঁর উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালিয়েছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থা তুলে ধরেছিলেন বলেই তাকে ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে বলে জানান কাফিল খান। পাশাপশি তিনি বলেছেন যোগী সরকারের পুলিশ তাঁকে যেকোনো সময় এনকাউন্টার করেও মেরে ফেলতে পারে বা অন্য কোনো কেসে ফাঁসিয়েও দিতে পারে।প্রসঙ্গত, এই ভয়েই গত বুধবার উত্তরপ্রদেশ পরিবার সহ কাফিল খান রাজস্থানের জয়পার এসে আশ্রয় নিয়েছেন। ডাক্তার কফিল খানের স্ত্রী শাবিস্তা খান এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন জে তাঁরা তাঁদের গোরক্ষপুরের বাড়িতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন, কারণ তাঁদের আশঙ্কা উত্তরপ্রদেশে ফিরলে যোগী সরকার কাফিল খানকে অন্য কোনো কেসে ফাঁসিয়ে দিতে পারে বা এনকাউন্টার করে দিতে পারে।
ওই সাক্ষাৎকারে মথুরা জেলে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কাফিল খান বলেন, জেলে পাঠানোর পর প্রথম তিনদিন তাঁকে একটা আলাদা সেলে রাখা হয়। সেখানে কোনও জল বা খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। শুধুমাত্র দুটো রুটি খেতে দেওয়া হয়েছিল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তাঁর পরিস্থিতি এমন চরম জায়গায় পৌঁছেছিল যে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতেন তিনি। দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাও ছিল না তাঁর। সে সময় খিদের জ্বালায় ঘাস বা ইন্ট পর্যন্ত খেতে রাজি ছিলেন তিনি। কোর্ট পরিবারের সদস্যদের দেখা করার অনুমতি দেওয়ার পর জেনারেল ব্যারাকে পাঠানো হয় তাঁকে। ওই ব্যারাকে এমন করুণ পরিস্থিতি ছিল যে তা বর্ণনা করার মতো নয়। ৪০ জন বন্দিকে যেখানে রাখার মত জায়গায় ১৫০ বন্দিকে রাখা হত। তাদের জন্য একটাই মাত্র টয়লেটের ব্যাবস্থা ছিল। চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করে উস্কানিমূলক মন্তব্য করার অভিযোগে ডক্টর কাফিল খানের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। ওই এফআইআরের ভিত্তিতে এই ঘটনার ৪২ দিনের মাথায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাঁকে গ্রেফতার করে। যদিও ডঃ কাফিল খান-এর এই জেলযাত্রা প্রথমবার নয়, এর আগেও ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে বিআরডি হাসপাতালে ৬০ জনেরও বেশি শিশু মৃত্যুর জেরে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। সে সময় ওই হাসপাতালের শিশু বিভাগের দায়িত্বে থাকা কাফিল খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তিনি অন্যান্য হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন। পরে আরো অভিযোগ ওঠে যে বিআরডি হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার চুরি করে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসা চালাচ্ছিলেন কাফিল খান। আর সেই কারণেই হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি তৈরি হয়। যার জেরে মৃত্যু হয় ওই শিশুদের। যদিও পরে এই ঘটনায় ডঃ কাফিল খানকে ক্লিনচিট দেয় উত্তরপ্রদেশ সরকার। এরপর আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি মঞ্চে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করে আপত্তিজনক মন্তব্য করার জন্য গ্রেফতার হন ডঃ কাফিল খান। এই ঘটনার পর তাঁর আইনজীবীর আর্জি শুনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে জেল থেকে মুক্ত করার নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু, উত্তরপ্রদেশ সরকার ডক্টর কাফিল খানকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী দোষী ঘোষণা করে। ঘটনাচক্রে এই মামলায় যেদিন তিনি জামিন পান তার কয়েক ঘণ্টা পরেই তাঁকে জাতীয় সুরক্ষা আইনের অধীনে ফের আটক করা হয়। ওই আইনের অধীনে গ্রেপ্তার কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্র ১২ মাস পর্যন্ত আটক করতে পারে এবং যদি কোন নতুন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তাঁকে আরো বেশি সময় ধরে আটক করে রাখতে পারে প্রশাসন।
এরপর, ২ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার সকালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি গোবিন্দ মাথুরের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ আলীগড় প্রশাসনের তরফ থেকে ডাক্তার কাফিল খান এর ওপর থেকে জাতীয় সুরক্ষা আইন বা এনএসএ চাপিয়ে দেওয়া বেআইনি বলে তা খারিজ করে এবং অবিলম্বে জেল থেকে শর্তসাপেক্ষ জামিনে মুক্ত করার নির্দেশ দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট। যদিও মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আলীগড় প্রশাসনের তরফ থেকে রেহাই করার আদেশ পত্র না পাঠানো হওয়ায় রাত অব্দি জেলেই বন্দি থাকেন ডাক্তার কাফিল খান। এরপর গভীর রাতে মথুরা জেলে আদেশনামা পৌছানোর পরই মুক্তি দেওয়া হয় ডাক্তার কাফিল খানকে।