রাজ্যে সংখ্যালঘু বঞ্চনার ইতিহাস পরিকল্পিত অসচেতনতা বসত নয়
ডঃ মুহাম্মদ ইসমাইল, অধ্যাপক
দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ
সংখ্যালঘুদের বঞ্চনা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নতুন ঘটনা নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অতি সুকৌশলে বৃহত্তর সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজকে বঞ্চিত করা হয়েছে সর্বক্ষেত্রে।তা নিয়ে সুবিধাবাদী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের কোন কালে হেলদোল ছিলনা এবং উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন নিয়ে তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। হতে পারে তাদের ভাবনা চিন্তা থাকলেও হয়তো পরিস্থিতি তাদের নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য করেছিল। দীর্ঘ বঞ্চনার পর সচ্চার কমিটির তথ্য মুসলমানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণ করেছে তাদের বাস্তব পরিস্থিতির কথা। অথচ তার পূর্ববর্তী সময় লক্ষ্য করলে দেখা যায় রাজ্যে দুইটি মাত্র রাজনৈতিক দল শাসন ব্যবস্থা চালিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি দল ভারতীয় কংগ্রেস ও অন্যটি বামফ্রন্ট পরিচালিত সরকার।দুই
সরকারের পরিচালনায় সংখ্যালঘুরা আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। পড়াশোনা করে চাকুরী ও কর্মসংস্থান হবে না এমন বদ্ধমূল ধারণা জন্ম নিয়েছিল সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজে। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বঞ্চনার ফলে সরকারি চাকরি, পড়াশোনা, অর্থনীতি ও সর্বক্ষেত্রে অবস্থা কঙ্কালে পরিণত হয় এবং বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা নিশ্চিত হতে চলেছে।সচ্চার কমিটির তথ্য আসার পর বামচালিত সরকার নড়েচড়ে বসেছিল ও ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার জন্য মুসলমানদের দশ শতাংশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার জন্য আইন প্রনয়ণ করে ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় গুলোকে তালিকাভুক্ত করেন। কিন্তু বর্তমান সরকার অতি সুচতুর ভাবে ঐ দশ শতাংশের আওতাভুক্ত করেন প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলমানদের। প্রাথমিকভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে খুশির জোয়ার দেখা যায় কারণ তাদের অবস্থা ও অনগ্রসরতার কারণে বঞ্চনার কৌশল বুঝতে আবার ব্যর্থ হয় তারা।দশ শতাংশ সংরক্ষণের আওতায় মুসলমান ও কয়েকটি হিন্দু গোষ্ঠীকে বেঁধে দেওয়া হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের নানা সরকারি নিয়োগ তালিকা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সর্বস্তরে বঞ্চনার খতিয়ান।যোগ্যতা ও গুণগত মান সম্পূর্ণ হওয়া সত্বেও বর্তমান সরকারের আমলে বহু মেধাসম্পন্ন প্রার্থীদের নাম অসংরক্ষিত তালিকায় থাকছে না।অথচ সংরক্ষণের নিয়ম অনুযায়ী তাদের নাম অসংরক্ষিত আসনে থাকার কথা। তা নিয়ে মুসলমান সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলে তেমন কোন বড় আন্দোলন ও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।প্রথম কারণ আজও মুসলমানেরা রাজনৈতিক ভাবে অন্ধ ভক্ত এবং দ্বিতীয় কারণ মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ নিরপেক্ষ চরিত্র ধরে রাখার জন্য ও বৃহত্তর সমাজের বাহবা নেওয়ার জন্য আপন স্বার্থে মুসলমানদের বঞ্চনা নিয়ে আলোকপাত করেন না ও কৌশলগত ভাবে সামান্য সুযোগসুবিধার জন্য এড়িয়ে যান। তার অর্থ হলো একদিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক নেতারা যেমন গুরুর আদেশ ও পার্টির নির্দেশনায় কাজ করেন অপর পক্ষে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও নিরব থাকেন।তার ফলে রাজনৈতিক বঞ্চনা নিয়ে মুসলমান সম্প্রদায় অবগত নয়। কিন্তু বর্তমানে নানা ইস্যু নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বঞ্চনার নানা খতিয়ান সামনে আসছে কারণ বরাবর মুল মিডিয়ার আলোকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা তেমন আসেনা। গত ২০১১ সালের পর থেকে উচ্চশিক্ষিত থেকে শুরু করে সাধারণ অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতেন তৃণমূল সরকার মুসলমানদের নানা বঞ্চনার অবসান করবেন এবং করছেন।তথ্যগত ভাবে অসত্য হলেও প্রচার গত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সকল নাগরিক বর্তমান সরকারকে মুসলমান দরদী হিসেবে জানে। তার প্রচার জোরকদমে শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা করছেন অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ বিজেপি মুসলিম তোষণ প্রচারকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতায়নের পথ মসৃন করছেন। তার ফলে ভোটের লড়াইয়ে মেরুকরণ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক বছরে।রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দল গুলো সংকটে যদিও তারা বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ নয়।ধর্মনিরপেক্ষ হলে সংখ্যালঘুদের এমন শোচনীয় পরিনাম হতোনা। মুসলমান তোষনকারী তকমা বহনকারী বর্তমান সরকারের আমলে মুসলমান বঞ্চনা সর্বোচ্চ। সচ্চার কমিটির তথ্য অনুযায়ী যেখানে মুসলমানদের সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণ ছিল ৩.৪ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষায় অংশ গ্রহণ ছিল ২.১৫ শতাংশ বর্তমানে তৃণমূল সরকারের আমলে তা দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশে কাছাকাছি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মুসলমান শিক্ষা বিস্তারের জন্য দশ হাজার মাদ্রাসা অনুমোদনের কথা বলেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য তা দিয়েছেন মাত্র ২৩৪, তবে কোনো আর্থিক দায়ভার গ্রহণ না করে। অথচ তিনি মুসলমান তোষণ কারি নেত্রী হিসেবে প্রচারের আলোকে। মুসলমান বুদ্ধিজীবিদের প্রশ্ন ছিল ও আজও আছে।মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য কেন মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে মাদ্রাসার অনুমোদন নতুন করে? মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে কেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং কলেজ, প্রযুক্তি বিদ্যালয় হবেনা?তবে কি মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার অধিকার নেই?মুসলমানদের প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে তাদের জন্য মাদ্রাসা তৈরি করা যথেষ্ট? মুসলমানদের একাংশ আজও মনে করেন মাদ্রাসা গুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ।তা নিয়ে হিন্দু সমাজের একাংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে।আর লকেট চ্যাটার্জীর মতো বহু নেতা-নেত্রী ও সাধারণ মানুষেরা মাদ্রাসা গুলোকে জঙ্গিখানা মনে করে অথচ এই মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় ৫০ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মরত এবং প্রায় কুড়ি শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করেন। গত বাম জমানায় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তৎকালীন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আবদুস সাত্তারের উদ্যোগে। তার বাস্তবায়ন বর্তমান সরকারের আমলে হলেও শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দানা বেঁধেছে। মাদ্রাসা প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষা সংস্কৃতির পীঠস্থান যেখানে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। তাই শিক্ষকতা করার জন্য ইসলামিক জ্ঞান থাকা আবশ্যিক যোগ্যতা বিচার করা হয়। তাই বরাবর মাদ্রাসার নিয়োগে মুসলমান প্রার্থীদের আধিক্য দেখা যায়। কিন্ত ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসায় নানা বিষয়ের নিয়োগে ইসলাম ধর্মালম্বী কর্ম প্রার্থী থাকলেও অন্য প্রার্থীদের আধিক্য মেধাতালিকায় স্থান পায় এবং ভূগোল বিষয়ে বারোটা শূন্যপদে কোন মুসলিম প্রার্থী মেধা তালিকায় স্থান পায়নি। তা হতবাক করে সকলকে, তা নিয়ে মুসলমান বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে শিক্ষিত মহলে প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠে। তাদের প্রশ্ন বারোজন জন অমুসলিমদের নির্বাচন ঘিরে নয়। প্রশ্নটা হল ৬৪ জন প্রার্থীর মৌখিক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তাদের মধ্যে ১৪ জন মুসলমানকে ডাকা হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেক ছেলেমেয়ে মেধাসম্পন্ন, গবেষণা করছেন ও গবেষনা সম্পন্ন করেছেন। অথচ একজন স্থান করে নিতে পারলোনা? পরবর্তী প্রশ্ন, নিয়ম অনুসারে আসন সংরক্ষিত হওয়ার কথা অথচ সকল পদ অসংরক্ষিত হলো কি করে? মেধার ভিত্তিতে শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ মুসলমান ও অমুসলমান বিচার্য বিষয় নয়। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামিক জ্ঞান সকল অমুসলমান প্রার্থীদের আছে তা নিয়ে সন্দেহের দানা বেঁধেছে? সংরক্ষিত আসন না থাকলে প্রার্থীর নামের পাশে সংরক্ষন উল্লেখ করে সাক্ষাৎকারের জন্য কেন ডাকা হয়েছিল ও ফল প্রকাশ করা হলো কেন?তালিকায় নাম থাকা একজন প্রার্থীর অভিযোগ তিনি কয়েক মাস ই-মেইল না দেখার কারণে তার সাক্ষাৎকারের খবর জানতে পারেনি এবং পিএসসি কোনভাবে তাকে মোবাইলে কল করে ও চিঠি দিয়ে জানাননি। এছাড়া উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী নানা নিয়োগ কমিশনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা আবশ্যিক কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ সংস্থাগুলো পালন করেননা। রাজ্যে নয় কোটি জনসংখ্যার মধ্যে তিন কোটির কাছাকাছি মুসলমান জনসংখ্যা। অথচ রাজ্যজুড়ে স্বাধীনতার ৭৩ বছর অতিবাহিত করার পরও একজন যোগ্য সংখ্যালঘু মুসলমান শিক্ষক পাওয়া গেলনা যাকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা যায়। রাজ্যের নানা উচ্চপদে নমিনেশন দেওয়া হয় যোগ্যতা সম্পন্নদের সেখানে ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব খুজে পাওয়া মুসকিল। সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে দেখা যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ ডান-বাম সকল সরকার সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে ব্যর্থ। শুধু তাই নয় সংখ্যালঘুদের খতিয়ান দেখে সহজে বলা যায় প্রশাসন ও তার অধীনস্থ কর্মকর্তারা পরিকল্পিত ভাবে পিছিয়ে রাখার মসৃণ পথ তৈরি করেছেন।তা না হলে রাজ্যের ২৭ শতাংশ মানুষকে বাদ দিয়ে সকল প্রশাসনিক ও সামাজিক কাজকর্ম সম্পন্ন হওয়া সম্ভবপর নয়।
বঞ্চনার কথা প্রচারের মাধ্যমে নয় তা তথ্য ও বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বিচার করতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলে বঞ্চনার খতিয়ান মারাত্মক। চোখ খুললে দেখা যায় গত নয় বছরে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে কি হয়েছে এবং কি হওয়া উচিত ছিল তা বিচার করলে পরিষ্কার হবে? মনে রাখবেন,রেশনে চাল,ডাল ও স্কুলে জুতো,ব্যাগের মত ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে মানুষের উন্নয়ন সম্ভবপর নয়। উন্নয়নের জন্য দরকার বঞ্চনার অবসান, নিরপেক্ষ কাজের সুযোগ ও পরিবেশ। জাতপাত ও ধর্মের বাছবিচার না করে সামগ্রিক উন্নয়নে সকলকে নিয়ে একসাথে চলা। স্বজনপোষণ মুক্ত পরিবেশ ও দুর্নীতি পরায়ন সরকারের অবসান। সংখালঘু ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্যপরিসেবা, রাস্তাঘাট ও কাজের সুযোগ তৈরি করা এবং সর্বপরী নানা কর্মক্ষেত্রে ও নিয়োগ নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ দূরীকরণে সদিচ্ছার সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। তা না হলে বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘায়িত হবে।