দ্বিতীয় পর্ব :- হিন্দুস্তান থেকে বাগদাদ :ইসলাম ও খলিফাদের কথা :

Spread the love

ইসলাম ও খলিফাদের কথা:

লেখক :- জ্যোতির্ময় মিত্র

প্রতিবেদন :-     মধ্যযুগে বিশ্ব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল হজরত মহম্মদ (৫৭০-৬৩২ খ্রি:) প্রবর্তিত আরবদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। ইসলামের আক্ষরিক অর্থ হল ‘নতিস্বীকার’।” মক্কা ছিল ইসলামের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ও জন্মস্থল। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজরত মহম্মদের মৃত্যুর পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ‘খলিফা’ পদের সৃষ্টি হয়। আরবি ভাষায় ‘খলিফ’ শব্দের অর্থ উত্তরাধিকারী। প্রথম চারজন নির্বাচিত খলিফা ছিলেন যথাক্রমে হজরত আবুবকর (৬৩২-৬৩৪ খ্রি:), হজরত ওমর (৬৩৪-৬৪৪খ্রি:), হজরত ওসমান (৬৪৪-৬৫৬ খ্রি:) ও হজরত আলি (৬৫৬-৬৬১ খ্রি:)। ইসলামের ইতিহাসে মহম্মদের পরবর্তী এই চারজন শাসককে ‘রাশিদুন’ অর্থাৎ যথাযথ ভাবে পরিচালিত খলিফা বলা হয়।

৬৬১ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ খলিফা আলির মৃত্যুর পরে মুয়াবিয়া খলিফা পদ অধিকার করে উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন (৬৬১-৭৫০ খ্রি:)। মুয়াবিয়ার রাজধানী ছিল সিরিয়ার দামাস্কাসে। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া রাজবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে খলিফা পদ দখল করেন আব্বাসীয় রাজবংশের শাসকগণ। তাঁদের রাজধানী ছিল বর্তমান ইরাকের বাগদাদ নগরী। আব্বাসীয় খলিফাদের ৫০০ বছরের শাসনকালে (৭৫০-১২৫৮ খ্রি:) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল,

১) হজরত মহম্মদের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছরের মধ্যেই খলিফাদের নেতৃত্বে আরবরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের এক বিস্তীর্ণ ভূ-খণ্ড দখল করেছিল। আব্বাসীয়রা তাকে একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইসলামীয়

সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।

২) আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। ৩) সর্বোপরি সমকালীন সময়ে বাগদাদ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমৃদ্ধশালী নগরে পরিণত হয়েছিল।

আব্বাসীয় আমলে (৭৫০-১২৫৮) ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চা:

৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খলিফা আবু আল-আব্বাস। তবে এই বংশের শ্রেষ্ঠতম শাসক ছিলেন খলিফা হারুন আল রশীদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি:)। ইতিপূর্বে খলিফা আল মনসুরের (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি:) শাসনামলে টাইগ্রিস নদীর পশ্চিমতীরে গড়ে ওঠা বাগদাদ শহর (যার সরকারি নাম ছিল ‘মাদীনাৎ-আল-সালাম’ বা শাস্তির শহর) তাঁর রাজত্বকালে আন্তর্জাতিক গুরুত্বের দিক থেকে সমকালীন বিশ্বের এক অদ্বিতীয় নগরে পরিণত হয়। খলিফা হারুণ আল রশীদের সময়ে ইসলামের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। বাগদাদকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ‘বুদ্ধিজীবী জাগরণ”। আরবজাতির ইতিহাস রচয়িতা ফিলিপ-কে হিট্টি এইপ্রসঙ্গে লিখেছেন—‘এই জাগরণ বিশ্ব সংস্কৃতি এবং চিন্তা ভাবনার ইতিহাসে প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত বিদেশী প্রভাবে কিছুটা ভারত-পারস্য এবং সিরীয় প্রভাবে এই জাগরণ ঘটে। বিদেশী প্রভাব বলতে গ্রিক প্রভাবই ছিল বেশি। ১

নবম শতাকের এই বুদ্ধিজীবী জাগরণের নেপথ্যে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল ‘অনুবাদ আন্দোলন। বার্নাড লুইসের মতে, অনুবাদ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে উমাইয়া বংশের শাসনকালে এবং এই আন্দোলনের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছিল আব্বাসীর খলিফাদের সময়ে। এখন প্রশ্ন হল কেন অনুবাদ আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছিল? সুমিতা দাসের মতে, আরবি ভাষায় লিখিত জ্ঞানচর্চার বিশেষ কোনো উপকরণ ছিল না।** অন্যদিকে হজরত মহম্মদ জ্ঞানচর্চার উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত উক্তি—‘জানের জন্য দরকার হলে চিনেও যাবে।’ তাঁর ভাষায় ‘পণ্ডিতদের লেখার কালি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’।” স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় দিক থেকেও আরবি সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

দ্বিতীয়ত, আরবী সভ্যতার অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল বাণিজ্য। এক্ষেত্রে মরুভূমি বা সমুদ্রযাত্রায়

সঠিক পথের দিশা পেতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান ছিল অপরিহার্য। সর্বোপরি ইসলামধর্মে, দিন ও রাত্রের নির্দিষ্ট

 

সময়ে প্রার্থনার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিল গণিত। এই সমস্ত কারণে গ্রিস, পারস্য ও ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের অসামান্য প্রাচীন গ্রন্থগুলি আরবিভাষায় অনুবাদ করা শুরু হল।”

মনে রাখা দরকার, খলিফা হারুন আল রশীদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি:) এবং খলিফা আল-মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি:) উভয়েই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু এবং অনুবাদ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক। ৮৩২ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মামুদ জ্ঞানচর্চার জন্য বাগদাদে ‘বায়াত আল-হিকমা’ বা House of Wisdom প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে সমকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, দার্শনিক ও অনুবাদকবৃন্দের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানটি। কে ছিলেন না এখানে? আলকিন্দি, হুনায়ন ইবন ইসহাক, আল-খোয়ারিজমী, আল জাহিজ প্রমুখ বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব House of Wisdomকে আলোকিত করেছিলেন। গবেষক আল-খলিলির মতে, উল্লিখিত বিদ্বজ্জনরা শুধুমাত্র মহান দার্শনিক অ্যারিস্টটল (খ্রি:পু: ৩৮৪-৩২২)ও গ্যালেনের (১৩০-২১৬ খ্রি:) রচনাসম্ভারকে অনুবাদ করেই (আরবীভাষায়) দায়িত্ব শেষ করেননি; তাঁরা মূল রচনার পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুনর্ব্যাখ্যাসহ তার পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছিলেন। ২৯

এবার আমরা আলোচনার প্রবেশ করবো যে, আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনকালে (৭৫০-১২৫৮) কীভাবে ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা আরব দুনিয়ায় অনুপ্রবেশ করেছিল। এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রথমত, আলোচ্য সময়ে প্রাচীন গ্রিসের দর্শন ও বিজ্ঞানের গ্রন্থ সর্বাধিক আরবী ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। সে তুলনায় ভারতীয় গ্রন্থের অনুবাদ ছিল অনেক কম। দ্বিতীয়ত, ৭১২ সালে মহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে আরবদের সিন্ধুজয়ের পরোক্ষ ফলেই ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার অনুপ্রবেশ ঘটে আরব দুনিয়ায়।

‘A History of Mathematics’ গ্রন্থে ফ্লোরিয়ান ক্যাজোরি এই মর্মে লিখেছেন যে, ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মনসুরের রাজদরবারে এক হিন্দু জ্যোতির্বিদ এসেছিলেন। তিনি হিন্দুদের জ্যোতির্বিদ্যা গণনা পদ্ধতি এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত একটি তালিকা খলিফার নিকটে পেশ করেন।” খলিফা আল মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুদের এই শাস্ত্রের আরবী ভাষায় অনুবাদ হয়। অন্যদিকে ফিলিপ কে হিটির বক্তব্য একটু আলাদা। তিনি লিখেছেন যে, হিজরী সন ১৫৪ অব্দে (৭৭১ খ্রি:) এক ভারতীয় পর্যটক বাগদাদে জ্যোতির্বিদ্যার এক তত্ত্ব ‘সিদ্ধান্ত’ (আরবী ভাষায় সিন্দহিন্দ) চালু করেন। খলিফা আল মনসুরের নির্দেশে ওই তত্ত্ব আরবীতে তর্জমা করেন মুহাম্মাদ ইবন ইব্রাহিম আল-ফাজারী।” এই ভারতীয় জ্যোতির্বিদের নাম ছিল ‘মঙ্ক’ (মতান্তরে ‘কঙ্ক’)।

আবার সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত ‘Lost History” গ্রন্থে মাইকেল হ্যামিলটন মর্গান উপরোক্ত বিষয়টিকে অন্যভাবে আলোকিত করেছেন। বিখ্যাত পণ্ডিত আল খোয়ারিজমী (৭৮০-৮৫০ খ্রি:) প্রাচীন ভারতীয়দের গণিতবিদ্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ইতিমধ্যে খলিফা আল-মনসুরের রাজদরবারে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ কঙ্ক কর্তৃক আনা ব্রহ্মগুপ্তের জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত পুঁথির কথা জ্ঞাত হলেও, তিনি মূল সংস্কৃত পুথিটি খুঁজে পাননি। শেষ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম ও বহু অনুসন্ধান করে তিনি প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’ (৬২৮ খ্রি:) নামে একটি সংস্কৃত পুথি হাতে পেয়েছিলেন এবং আরবী ভাষায় তাকে যথার্থ অনুবাদ করেন।”

ব্রহ্মাণ্ডপ্তের গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’ (‘Opening of the Univese)-এর আরবী ভাষায় শিরোনাম হয় ‘সিন্দহিন্দ’। বর্তমানে ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’-এর আদি পাণ্ডুলিপি ও আল-খোয়ারিজমীকৃত আরবী অনুবাদ কোনটিই নেই। শুধুমাত্র একটি ল্যাটিন অনুবাদ বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে। এছাড়া ব্রহ্মাণ্ডপ্তের অপর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘খণ্ডখাদ্যক’ (৬৬৫ খ্রি:) আরবী ভাষায় অনুদিত হয় ‘অকন্দ’ শিরোনামে।

৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশেমের সিন্ধু জয়ের মাধ্যমেই ভারত-আরব সংস্কৃতির সেতু প্রথম স্থাপিত হয়নি। স্মরণাতীত কাল থেকেই ভারতের পশ্চিমে মালাবার উপকূলের সঙ্গে, আরব বণিকদের যোগাযোগ ছিল। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে সিরিয়ার পণ্ডিত সেরেভাস সেবকত (৫৭৫-৬৬৭ খ্রি:) ভারতীয় গণনা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন—’সিরীয়দের হইতে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জাতি হিন্দুদের বিজ্ঞান সম্বন্ধে

কোন আলোচনাই আমি করিব না, এমনকি তাহাদের জ্যোতিষ সম্বন্ধেও না, যে শাস্ত্রে অতি সূক্ষ্ম আবিষ্কারসমূহের জন্য তাহারা (ভারতীয়রা) গ্রীক ও ব্যাবিলনীয়দেরও হার মানাইয়াছে। কিন্তু তাহাদের গণনা পদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু না বলিয়া পারিতেছি না। মাত্র নয়টি চিহ্নের দ্বারা এই গণনা সম্পাদিত হয়। যেসব গ্রীকদের বিশ্বাস তাহারাই কেবল বিজ্ঞানের প্রান্তদেশে আসিয়া পৌঁছিয়াছে এই তথ্য (হিন্দু সংখ্যা) সম্বন্ধে তাহারা অবহিত হইবার চেষ্টা করুক। তবেই তাহারা বুঝিতে পারিবে, জ্ঞানবিজ্ঞানে কিছু কিছু অধিকার রাখে এরূপ আরও অনেক জাতি পৃথিবীতে আছে।**

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, শূন্য এবং দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি খ্রিস্টিয় যুগের প্রথমদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভাবিত হয়। তবে গণনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল অনেক পরে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পরবর্তীকালে। মোটামুটিভাবে অষ্টম শতাব্দী নাগাদ সেরেভাস সেবকৃতের বিভিন্ন রচনা এবং ব্রহ্মাণ্ডপ্তের ‘ব্রহ্মাস্ফুট সিদ্ধান্ত’ ও ‘খণ্ডখাদ্যক’ আরবী ভাষায় অনুবাদের ফলে আরবরা দশমিকস্থানিক অঙ্কপাতন ও শূন্যের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হয়। ভারতীয় গণিতের এই পদ্ধতি আরবদের মধ্যে প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন আল-খোয়ারিজমী। এই অসামান্য প্রতিভাধর পণ্ডিতের তিন শতাব্দী পরে ভারতীয় সংখ্যা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন ‘আল-বিরুণী (৯৭০-১০৫০ খ্রি:)। খ্রিস্টিয় দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে আরব অধিকৃত স্পেনের মাধ্যমে শূন্যের ব্যবহার ও দর্শমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতির কথা সমগ্র ইউরোপ অবগত হয়।

সম্প্রতি প্রকাশিত জিম আল-খলিলির “Pathfinders The Golden Age of Arabic Sciencē নামক গবেষণা গ্রন্থে এ প্রসংগে একটু ভিন্ন বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটেছে। লেখকের অনুমান, সমকালীন যুগে সিরিয়ার বিশপ সেরেভাস সেবকত ‘নয়টি চিহ্ন’- এর জন্য ভারতীয় বা হিন্দু উদ্ভাবকদের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন— একথা সত্য। তবে শূন্য সম্পর্কে বিশপের কোনো ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনাধীন বাগদাদের সারস্বত সমাজে ভারতীয় সংখ্যাগুলি কখন সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল, সেটাও পরিস্কার নয়। তবে খলিফা আল – মনসুরের রাজত্বকালের প্রথমদিকে অর্থাৎ যখন ব্রহ্মাণ্ডপ্তের ‘সিদ্ধান্ত’ সরাসরি সংস্কৃত থেকে !

 

 

বা ফার্সি ভাষায় আরবীতে অনুবাদ হয়েছিল, তখনই এই সাংস্কৃতিক ঘটনাটি সুসম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে বাগদাদের দুই মহান পণ্ডিত, দার্শনিক ЗДОЧТА СО СССРО আল-কিন্দি এবং গণিতজ্ঞ আল খোয়ারিজমী মুসলিম বিশ্বে হিন্দু সংখ্যার প্রসার ও জনপ্রিয়করণে প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। উভয়েই খলিফা আল মামুনের শাসনকালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়ে মধ্যযুগে ‘আরবী সংখ্যা’ হিসাবে আরব অধিকৃত স্পেনে অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপে পৌঁছে যায়। তবে সমগ্র ইউরোপের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এটি রাতারাতি গৃহীত হয়নি। কয়েক শতাব্দী পরে অর্থাৎ খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকে আরবী গণিতজ্ঞদের অধীনে অধ্যয়ন করার জন্য ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করছিলেন পিসার 1200 (বর্তমানে ইতালির শহর) বিখ্যাত গণিতবিদ লিওনার্দো (১১৭০-১২৫০ খ্রি.)। অবশেষে তাঁর লাতিন ভাষায় লিখিত “Liber Abbaci” (The Book of Abacus or The Book of Calculation) নামক এক ধ্রুপদী গ্রন্থে হিন্দু আরবী সংখ্যা পদ্ধতিটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।

аль-Хорезми

পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার ডাকটিকিটে বিখ্যাত পণ্ডিত আল-খোয়ারিজমীর কাল্পনিক ছবি (১৯৮৩ খ্রি:)

সুতরাং মোটাদাগে বলতে হয়, শূন্যের ব্যবহার দশমিক প্রথা এবং সংখ্যাতত্ব (১-৯) ভারতবর্ষ থেকে আরব দুনিয়ায় পদার্পণ করার পর, তা পরিমার্জিত হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল। বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি— গণিতের এই দুটি শাখার উৎপত্তির অন্যতম দাবিদারও ভারতবর্ষ। বীজগণিত প্রসঙ্গে জে. ডি. বার্নাল লিখেছেন, ‘আরবরা আরও একটা কাজ করল: অজ্ঞাত রাশি নিয়ে গণনা করার পদ্ধতি নিয়ে একাধিক হিন্দুগণিতজ্ঞদের রচনা তারা সংগ্রন্থিত করল। এই আমরা বলি algebra বীজগণিত। ইংরেজি শব্দটি এসেছে ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আল-খোয়ারিজমী রচিত ‘আলজেবর’ ও ‘আলমুকাবালা’–এই দ্বৈত পদ্ধতির নামানুসারে। যদিও দুই শতাব্দী আগেই ব্রহ্মগুপ্ত এই বিদ্যার নামকরণ করেছিলেন ‘কুট্টক গণিত’।

ত্রিকোণমিতির সাইন, কোসাইন, ভার্স-সাইন ইত্যাদি কোণানুপাতগুলি ভারতীয়দের মস্তিষ্কপ্রসূত এক অভাবনীয় আবিষ্কার। ‘বিজ্ঞানের রচয়িতা সমরেন্দ্রনাথ সেন এই মর্মে দেখিয়েছেন যে, সাইন, কোসাইন ইত্যাদি শব্দগুলি সংস্কৃত থেকে উৎপত্তি। তাঁর ‘সংস্কৃততে সাইন কোণানুপাতের নাম ‘জ্যা’ বা ‘জীবা’। প্রথম যুগের আরব গণিতজ্ঞরা ইহাকে বলিত এবং ক্রমশঃ ব্যবহারজনিত অপভ্রংশের ফলে ‘জীব’ শেষ পর্যন্ত ‘জাইব’-এ পর্যবসিত হয়। জেরার্ড অব ক্রেমোনা (১১১৪-১১৮৭ খ্রি:) আরবী গাণিতিক গ্রন্থরাজির ল্যাটিন তর্জমা প্রণয়নকালে জাহবের ল্যাটিন করেন ‘Sinus’ এবং তাহা হইতে অধুনা ব্যবহৃত ‘সাইন’ শব্দের উৎপত্তি। ঠিক সেইভাবে সংস্কৃত ‘কোটি-জ্যা’ বা সংক্ষেপে ‘কো-জ্যা’ ভাষাস্তরের ফলে ল্যাটিন ‘Co-Sinus’ ও পরে ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.