অয়ন বাংলা,আর্ন্তজাতিক নিউজ ডেস্ক:-
বিশেষ প্রতিবেদন: সপ্তাহ তিনেক হতে চলল, ভয়াবহ আগুনে জ্বলে চলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অরণ্য আমাজন। হিসেব বলছে প্রতি মিনিটে প্রায় তিনটে ফুটবল মাঠের সমান আকারের অরণ্য আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। আমাজনের অঞ্চল ছাড়িয়ে সেই আগুনের ধোঁয়ায় দিনের বেলাতেই অন্ধকার নেমেছে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোতে। আর ভয়াবহ বিষয় আমাজন অরন্য থেকে সাও পাওলোর দূরত্ব প্রায় ২০০০ মাইল (প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার)। এমনকি সেই আগুনের ধোঁয়া মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান।
তবে ব্রাজিলের আমাজন অরণ্যের এই আগুন এই প্রথম নয়। সেদেশের ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ এক রিপোর্টে জানিয়েছে, শুধু মাত্র ২০১৯ সালেই এখনও পর্যন্ত ৭৪, ৮৪৩ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে আমাজনে। গত বার এই সংখ্যাটা ছিল মোটামুটি ৪০,০০০। অর্থাৎ এবার দাবানলের ঘটনা প্রায় ৮৩ শতাংশ বেড়েছে।
আমাজনের এই দাবানল প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চললেও শেষ কয়েকদিন ধরে বাকি পৃথিবীর মানুষ এই সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। এখন আপনি হয়তো ভাবছেন আগুন লেগেছে সেই আমাজনে, আর আমি পশ্চিমবঙ্গে বসে এত চিন্তা করব কেন? তাহলে জেনে রাখুন আপনারও চিন্তা করার বিষয় এটি। প্রসঙ্গত, বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক আশ্চর্য এই আমাজন। আমাদের এই বিশ্বের মোট অক্সিজেনের প্রায় ২০ শতাংশের যোগান আসে এই অরণ্য থেকেই। সেই কারণেই এই আমাজনকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলে অভিহিত করা হয়। অক্সিজেনের যোগান দেওয়া ছাড়াও গ্রিনহাউজ গ্যাসও নিয়ন্ত্রণে রাখে এই অরণ্য। এই দাবানলের ফলে এবার কিন্তু এই অরণ্য থেকেই বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ছে সেখানকার বাস্তুতন্ত্র।
কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল কীভাবে এই ভয়াবহ আগুন লাগলো? ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী টুইটারে জানিয়েছেন এই দাবানলের জন্য দায়ী নাকি প্রকৃতি অর্থাৎ বৃষ্টির অভাব, উষ্ণতা, হাওয়া বা বজ্রপাত। কিন্তু রয়টার্সের রিপোর্ট বলছে এবছর আমাজনের আবহাওয়া মোটের ওপর স্বাভাবিকই রয়েছে। অন্যদিকে, আমাজনের অরণ্য নিয়ে কাজ করা একাধিক এনজিও কিন্তু এই আগুনের পেছনে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষদেরই দায়ী করছেন। অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণে নয়, মানুষের নির্বুদ্ধিতার জন্যই এই ভয়াবহ আগুন আমাজনে।
আমাজন মূল অরণ্য লাগোয়া অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ একেবারেই আমাজনের ওপর নির্ভরশীল। মৎস্যশিকার, কাঠের ব্যবসা, চাষবাস আর গবাদিপশু প্রতিপালন করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করে, ঠিক যেমন আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলে। এখন মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অরণ্য অধিগ্রহণ। হেক্টরের পর হেক্টর অরণ্য পুড়িয়ে বেআইনি ভাবে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। আর সেই কারণেই প্রতিবছর দাবানলের সংখ্যা বাড়ছে। আর এবার ওই ধরনের কোনও মনুষ্যসৃষ্ট আগুন এতটা ভয়াবহ আকার নিয়ে নেয়।
এই সকল বেআইনি কাজকর্ম আরও বেলাগাম হয়েছে বর্তমান ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারো ক্ষমতায় আসার পর। এই আগুন লাগার কারণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট কিন্তু অদ্ভুত এক যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর দাবি, যেহেতু তাঁর সরকার স্থানীয় বেশ কিছু এনজিওর সরকারী অনুদান বন্ধ করে দিয়েছেন, তাই ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিবেশবিদরাই এই আগুন লাগিয়েছেন তাঁর সরকারকে কালিমালিপ্ত করার জন্য। কিন্তু আসল তথ্য বলছে অন্য কথা। জুলাইয়ের নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাজনে বেআইনি অরণ্যধ্বংস আরও গতি পেয়েছে খোদ প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর জন্যই। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কিছু শিল্পগোষ্ঠীকে তোষণ করার উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত অরণ্য ধ্বংস করলে যে শাস্তির নিদান আছে, তা অনেকটাই লাঘব করে দেন তিনি। আর সেই কারণেই লাগামহীন ব্রাজিলের বেআইনি কাঠ ব্যবসায়ীরা। এমনকি ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ এই দাবানলের ভয়াবহ ছবি গোটা বিশ্বের সামনে আনায় সেখানকার বেশকিছু বিজ্ঞানীকে ছাঁটাই পর্যন্ত করেছেন!
আমাজন অঞ্চল আবার পৃথিবীর সবচেয়ে বায়ো-ডাইভার্সড (জীব বৈচিত্র্য) অরণ্য। একটা হিসেব বলছে পৃথিবীর পরিচিত দশটি প্রাণীর মধ্যে একটির বাস এই আমাজনে। তাও আবার এই অরণ্যের সিংহভাগ এখনও বিজ্ঞানীরা ঠিক করে পরীক্ষাও করতে পারেননি। এতদিন পর্যন্ত যা জানা যায়, এখানে ২৫ লক্ষের বেশি পতঙ্গের প্রজাতি, ৪০ হাজারের বেশি গাছের প্রজাতি, ২ হাজার পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রজাতি এবং ২,২০০ প্রজাতির মাছের বাস এই আমাজনে। ভয়াবহ এই আগুনে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু হয়েছে কয়েক হাজারের বেশি প্রাণীর। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই মিলবে এই অগ্নিকুণ্ডের গ্রাসে মৃত অগুনতি পশুপাখির ঝলসে যাওয়া দেহের। কিন্তু ছবি সত্যি, কিছু ফেক।
ব্রাজিল সরকার ইতিমধ্যেই এই আগুন নেভাতে সক্রিয়। বিমানে করে জল নিয়ে আগুনের ওপর ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও অবশ্য লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। দেশের সরকার ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে এই মুহূর্তে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁরা পারবে না। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এম্যানুয়েল ম্যাক্রোঁ জি৭ বৈঠকে সারা পৃথিবীর নেতাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন ব্রাজিলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তবে স্বস্তির বিষয় একটাই, জ্বলন্ত আমাজনের কিছু অংশে বৃষ্টি হয়েছে। তবে লোভের বশে মানুষ যেভাবে অরণ্য ধ্বংস করছে, তাতে এই আগুনের লেলিহান শিখা সেই মনুষ্য সভ্যতাকেই ধ্বংস করে দেবে, তা বলাই যায়।
[জ্বলছে আমাজন।
জ্বলছে এই বসুন্ধরার ফুসফুস।
ভরদুপুরেই নেমেছে ঘন অন্ধকার। ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছে শহর সাও পাওলোর আকাশ। পেরুর আকাশেও হানা দিয়েছে সেই ধোঁয়া।
এই বনাঞ্চলই এই গ্রহকে দেয় পাঁচভাগের একভাগ অক্সিজেন।
দশমাসও হয়নি। ব্রাজিলে উগ্র দক্ষিণপন্থী জাইর বোলসোনারোর সরকার।
‘ব্রাজিলের ট্রাম্প’ আমাজনে চান শিল্পায়ন। নয়া উদার অর্থনীতির আগ্রাসী রূপ। এই অরণ্যকে উন্মুক্ত করে দিতে চান অ্যানিমেল এগ্রিকালচার এবং মাইনিংয়ের জন্য। এই অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়েই নির্মাণ করতে চান জাতীয় সড়ক। এই পৃথিবীকে ধ্বংসের পথ।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচনে। তারপর ভোটের একমাস পরেই জঙ্গল সাফ করার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪০০ শতাংশ।
প্রতি মিনিটে কাটা হচ্ছে তিন-তিনটি ফুলবল মাঠের মাপের জঙ্গল।
চলতি বছরের জুলাই। তার আগের বছরের চেয়ে জঙ্গল সাফ করার হার বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। একবছর আগের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
প্রতিদিন ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হচ্ছেন আদি জনগোষ্ঠীর মানুষ।
বিনিয়োগের জন্য বার্তা দিয়ে বোলসোনারো বলেছেন, ‘অতিরিক্ত এক সেন্টিমিার জমিও আর ওরা পাবেন।’ চলছে বেপরোয়া বেআইনি খনন। দূষিত হচ্ছে নদী। ঝর্না। এই নির্বিচার খননের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে চলেছেন বোলসোনারো। তাঁর দাবি, অর্থনীতির জন্য ভীষণ জরুরি।
পরিবেশমন্ত্রকের ২০ জন শীর্ষ কর্তাকে বদলি করে তার জায়গায় বসানো হয়েছে সেনা ও পুলিশ অফিসার।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে উত্তর সম্পাদকীয়তে অসহায় আর্তনাদ: সেভ দি আমাজন ফর্ম বোলসোনারো।
বোলসোনারো আর তার পরিবেশমন্ত্রী রিকার্দো মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন ‘গৌণ বিষয়’।
আটজন প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বিচারে জঙ্গল সাফ সত্যিকারের ঝুঁকি।
শুধু ব্রাজিলের জন্য নয়। বোলসোনারে মানে এই গ্রহের জন্য সর্বনাশ।]