বুদ্ধিজীবীদের খুন করতে ২২ জনকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ হিন্দুত্ববাদীদের, চাঞ্চল্যকর তথ্য গৌরী লঙ্কেশ হত্যার তদন্তে

Spread the love

অয়ন বাংলা ,নিউজ ডেস্ক:- গত শুক্রবার মহারাষ্ট্র থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিন ব্যক্তিকে। যাদের মধ্যে দুজন সনাতন সংস্থা এবং হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলার যড়যন্ত্র করছিল এরা।

সারা দেশের মোট ৩৪ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা মিলেছে গৌরী লঙ্কেশ খুনের চক্রান্তের অভিযোগে ধৃত অমোল কালের কাছ থেকে (ফাইল ফোটো)
গত কয়েক বছরে নয় নয় করে ২২ জনকে আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের খুন করার জন্য। গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে বিশেষ তদন্ত দল প্রায় এক বছর ধরে তদন্তের পর এ কথা জানতে পেরেছে।

গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরুতে গৌরী লঙ্কেশের বাড়ির সামনে তাঁর উপর গুলি চালিয়েছিল যে আততায়ী, সেও এই ২২ জনেরই একজন।

গোটা কর্নাটক জুড়ে প্রথমে বেছে নেওয়া হয় প্রায় ৬০ জনকে। উদ্দেশ্য অন্তর্ঘাতমূলক কাজ চালানো। তার মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানি দেওয়া থেকে শুরু করে বিস্ফোরক ব্যবহার সব কিছুই। তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয় এই ২২ জনকে। সম্প্রতি চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর গোটা নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতিই সামনে এসেছে

যে চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে গ্রেফতারির পর এসব তথ্য সামনে এসেছে, তারা হল, ৩৮ বছরের অমোল কালে, ৩৮ বছরের সুজিত কুমার, ৫০ বছরের রাজেশ বাঙ্গেরা এবং ৩৭ বছরের ভারত কুরনে। এদের মধ্যে অমোল কালে সনাতন সংস্থার অধীন হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির পুণের প্রাক্তন আহ্বায়ক। কর্নাটকের গোপন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর অপারেশনস চিফ এই অমোল কালেই, এমনটাই অভিযোগ। সুজিত কুমার হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির প্রাক্তন কর্মী। রাজেশ বাঙ্গেরা সরকারি চাকুরে এবং সনাতন সংস্থার সমর্থক। অভিযোগ, নিজস্ব লাইসেন্সড পিস্তল ব্যবহার করে সে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এই যুবকদের। ভারত কুরনে মহারাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবপ্রতিষ্ঠান হিন্দুস্থান-এর সঙ্গে যুক্ত, যার খানাপুরের ৩ একর জমির উপর তৈরি ফার্ম হাউসেই এই অস্ত্রপ্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ।

আরও পড়ুন, Gauri Lankesh: প্রসঙ্গ গৌরী লঙ্কেশ, একটি খোলা চিঠি

বিশেষ তদন্ত দলের কাছে উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত শুক্রবার মহারাষ্ট্র থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিন ব্যক্তিকে। যাদের মধ্যে দুজন সনাতন সংস্থা এবং হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলার যড়যন্ত্র করছিল এরা। তদন্তে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর আড়ালে চলা এক উগ্রপন্থী সংগঠনের অস্তিত্বের কথাও জানা গেছে।

গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডে এখনও পর্যন্ত যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে গৌরীর ঘাতক বলে অভিযুক্ত পরশুরাম ওয়াগমারে, গণেশ মিসকিন এবং অমিত বাড্ডিকে আগ্নেয়াস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে একটি সব্জি খামারে। (ফাইল ফোটো)
ওই খামারটি চালাত ভারত কুরনে ওরফে টোমাটর, জানিয়েছে বিশেষ তদন্ত দলের এক সূত্র।

অস্ত্রপ্রশিক্ষণে যোগসাজশ রয়েছে সন্দেহে সঞ্জয় শেট্টি ও যুবরাজ কাচিন্ডাকাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে বিশেষ তদন্ত দল সূত্রে জানা গেছে। এরা দুজনেই কর্নাটকের মেঙ্গালুরু এলাকায় হিন্দু জাগরণ ভেদিকে নামক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।

‘‘অস্ত্রপ্রশিক্ষক রাজেশ বাঙ্গেরার সঙ্গে এদের যোগাযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য ওই দুজনকে ডাকা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের পর দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’’ জানিয়েছে বিশেষ তদন্তদলের ওই সূত্রটি।

খানাপুর ফার্মে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিজয়পুরা অঞ্চলের কিছু যুবককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যারা যারা ওই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিল, তাদের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তাদের নামে মথিও তৈরি করা হবে, যাতে নিরাপত্তাবাহিনী তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারে।

কীভাবে এই যুবকদের নিয়োগ করা হত তার একটা মোটামুটি চিত্র সামনে এসেছে সুজিত কুনারের দেওয়া বয়ানের উপর নির্ভর করে। ধৃত সুজিত কুমারই ছিল মূল নিয়োগকারী। তার সঙ্গে ছিল অমোল কালেও।

গৌরী লঙ্কেশ
সুজিত কুমারের দেওয়া বয়ান থেকে জানা গেছে, গোপন হিন্দুত্ববাদী এই গোষ্ঠীটি কাজ করে প্রচণ্ড গোপনীয়তা অবলম্বন করে। পুলিশের চোখে ধুলে দিতে তারা ভুয়ো পরিচয় দেয়, এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ব্যাপক সতর্কতা নিয়ে থাকে।

সুজিত কুমার তার বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘আমরা যথেষ্ট ধূর্ত কৌশল ব্যবহার করি, যাতে দলের একজন ধরা পড়লে শুধু সেই ফাঁসে, দল যাতে গোপন থাকে।’’

হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি, শ্রীরাম সেনা ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর মিটিংয়ে প্রাথমিকভাবে নাশকতামূলক কাজকর্মের জন্য লোক নিয়োগ করা হত। এরপর ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের ব্যাপারে তারা কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ তার পরীক্ষা নিত সুজিত কুমার।

যারা সবচেয়ে ভালোভাবে উতরে যেত তাদের হাজির করা হত অমোল কালে এবং পলাতক আরেক ব্যক্তি নিহাল ওরফে দাদার সামনে। তারাই স্থির করত ওই ব্যক্তি দলের পক্ষে কার্যকর হবে কি না, এবং গোপন দলের কোন ধরনের কাদে তাদের নিযুক্ত করা যেতে পারে। এসব কাজের মধ্যে থাকত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নাশকতার কাজ এবং বোমা বিস্ফোরণ।

বিশেষ তদন্তদলের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে কর্নাটকে গোপন দলে মোট ষাটজনকে নিয়োগ করেছে এই সুজিত কুমার। মহারাষ্ট্রেও এই একই ধরনের কাজ চলছে সেখানকার স্থানীয় নেতাদের অধীনে।

সুজিত কুমার তার বয়ানে জানিয়েছে, ‘‘গোপনীয়তা আমাদের দলের প্রধান ফোকাস। আমরা যখন কাউকে নিয়োগ করি তাদের কখনওই আমাদের মোবাইল নম্বর দিই না। শুরুর দিকে আমরা পাবলিক ফোন ব্যবহার করি। পরে যখন আমরা নিশ্চিত হই যে এ আমাদের কাজের পক্ষে উপযুক্ত, তখন আমরা তাদের একটা মোবাইল ফোন দিই শুধুমাত্র আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। তাদের একটা কোড নেমও দেওয়া হয়।’’

আরও পড়ুন, হিট লিস্টের দু নম্বরে গৌরী লঙ্কেশ, এক নম্বরে কে?

এ বছর মে মাসে সুজিত কুমারের গ্রেফতারের পর, কর্নাটকের উপকূলে উদুপীতে তার বাড়ির রান্নাঘর থেকে ২২ টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে বিশেষ তদন্ত দল। অমোল কালে গ্রেফতারের সময়ে তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় ২১টি মোবাইল ফোন। ‘‘বিশেষ তদন্তকারী দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘‘এই ফোনগুলি যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, কেবলমাত্র তাদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান ব্যবহারের জন্য। যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের কাছেও এরকম একটি ফোন থাকত, যার মাধ্যমে সে এদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। এই ফোনগুলি অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নয়।

গৌরী লঙ্কেশ হত্যার তদন্তে নেমে জানা গেছে, এই দলে নিযুক্তরাই পদ্মাবৎ ছবির প্রদর্শনের সময়ে গণ্ডগোল পাকিয়েছিল এবং গত নভেম্বরে বেলাগাভিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। অমোল কালের কাছ থেকে সারা দেশের ৩৪ জন লেখক ও যুক্তবাদীর নামের তালিকা উদ্ধার করেছে বিশেষ তদন্ত দল, যাদের হত্যা করার সম্ভাব্য় টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।

কর্নাটকের স্টেট ফরেনসিক ল্যাবরেটরি জানিয়েছে গৌরী লঙ্কেশ ও এম এম কালবুর্গীকে একই ৭.৬৭ এমএম পিস্তল থেকে গুলি করে খুন করা হয়েছিল। কালবুর্গীকে ২০১৫ সালের ৩০ অগাস্ট হত্যা করা হয়। ব্যালিস্টিক তথ্যাদি থেকে মনে করা হচ্ছে গবিন্দ পানসারেকেও খুন করা হয়েছিল দেশি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল দিয়ে। ৮১ বছর বয়সী গোবিন্দ পানসারেকে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে গত ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি খুন করা হয়। ২০১৩ সালের ১০ অগাস্ট পুনেতে খুন হয়েছিলেন যুক্তিবাদী নরেন্দ্র দাভোলকর। ব্যালিস্টিক প্রমাণ থেকে মনে করা হচ্ছে, গোবিন্দ পানসারেকে হত্যার জন্য যে দুটি বন্দুক ব্যবহৃত হয়, তারই একটি দিয়ে খুন করা হয় নরেন্দ্র দাভোলকরকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.