স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও বিভিন্ন ধর্মে রোযা; একটি পর্যালোচনা
জান্নাতুল ফেরদৌস
প্রতিবেদন :- রোযা বা ‘রোজা’ একটি ফারসি শব্দ, আরবি প্রতিশব্দ হল ‘সাওম’, এর অর্থ সংযম। রোজা পালন বা সিয়াম হল ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম একটি। সুবহে সাদিক বা ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা। ইসলামি বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।
পবিত্র কোরআন-এর মধ্যে বলা হয়েছে-
“হে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পার”। (সূরা বাকারা: ১৮৩)
হযরত আদম যখন নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাওবাহ করেছিলেন তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তার তাওবাহ কবুল হয়নি। ৩০ দিন পর তার তাওবাহ কবুল হয়। তারপর তার সন্তানদের উপরে ৩০টি রোযা ফরয করে দেওয়া হয়।
রমজান মাসের ২৯ বা ৩০ দিন (চাঁদের গণনা এমনই হয়) রোজা রাখেন মুসলিমরা৷ এছাড়াও পবিত্র শবেবরাত বা রমজানের পূর্ববর্তী মাসের ১৫ তারিখ শবে মেরাজ সহ প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৪ /১৫/১৬ যেকোনো দুই দিন রোজা রাখার বিধান আছে৷ রোজার সময় মুসলিমরা ঊষাকাল বা ফজর থেকে সূর্যাস্ত বা মাগরিব পর্যন্ত পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে নিজেদের বিরত রাখেন৷ বলা হয় আত্মশুদ্ধির জন্য রোজা।
তবে জল মৃগীরোগ ও আলসারের চিকিত্সা করা যায়। এছাড়াও পেটের অসুখ, অজীর্ণ, বদহজম, গ্যাস্ট্রিকের চিকিত্সাও করা যায়। রোজার মাধ্যমে কালাজ্বর ও শরীরের অন্যান্য পুরাতন রোগ সারে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যারা রোজার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবী ডাক্তার গবেষকরা ভালো করেই জানেন মহান স্রষ্টা অকারণে রোজাকে ফরজ করেননি। কারণ তারা কুরআন ও ইসলামের নিয়ম কানুন নিয়ে রীতিমত পড়াশুনা ও গবেষণা করেন। এখন জেনে নেওয়া যাক স্বাস্থ্য ও মনের উপকারিতায় রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে।
রোজার দিনে ক্যালরি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আলাদা একটা নিষেধাজ্ঞা কাজ করে। তাই রোজা রাখলে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বার্ধক্য শরীর-মন দুটোকেই ভারাক্রান্ত আর অসহায় করে তোলে। রোজা রাখলে আয়ু বাড়ে এবং এটি বার্ধক্য সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোকে দূরে রাখে। রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে দেহ ও মনে নিঃসন্দেহে একধরণের ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। দুই দিন রোজা রাখলেই শরীরে হরমোন বাড়ার হার পাঁচ গুণ বাড়ে। রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়। ফলে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়।
রক্তচাপ কমানোর এক আশ্চর্য পদ্ধতি রোজা। রোজা রাখলে প্রথমে গ্লুকোজ, পরে চর্বি কণাগুলি ক্ষয় হয়ে শক্তি উত্পাদন করে। মেটাবলিক রেটও কমে। এড্রিনালীন ও নর এড্রিনালীনের মত স্ট্রেস হরমোন উত্পাদন কমে। আর এতে করে মেটাবলিক হার একটা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। ফলে ব্লাড প্রেসার কমে। যায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ধমনীতে চর্বি জমার প্রক্রিয়ার উপর যা হার্ট এটাক্টের ঝুঁকি কমায়।
ইহুদি ধর্মঃ-
ইয়োম কিপ্পুর বা প্রায়শ্চিত্তের দিন হল ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দিন৷ ইহুদি ক্যালেন্ডারের তেশরেই মাসের ১০ তারিখ এই রোজা রাখেন তারা। এদিন ২৫ ঘন্টা ধরে উপবাস ও প্রার্থনার মাধ্যমে দিনটি পালন করে থাকেন ইহুদি ধর্মের অনুসারীরা৷ এছাড়া আরো অন্যান্য ছয়দিন রোজা রাখার বিধান আছে ইহুদি ধর্মে৷
বৌদ্ধ ধর্মঃ-
অন্যান্য ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও উপবাসের বিধান আছে৷ প্রসঙ্গত তারা পূর্ণিমার দিনগুলোতে ও অন্য ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে উপবাস করে থাকেন।
খ্রিস্টান ধর্মঃ-
ইসলাম ইহুদি ও খ্রীষ্টান ধর্মের মিল আছে। তারা সকলেই সিমেটিক ধর্মের অন্তর্গত। খ্রীষ্টানরা অ্যাশ ওয়েনেসডে ও গুড ফ্রাইডে’র দিন রোজা বা উপবাস পালন করে৷ এছাড়াও ইস্টার সানডে’র আগের প্রায় ৪০ দিন তাঁরা শুক্রবারগুলোতে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন৷
হিন্দু ধর্মঃ-
হিন্দু ধর্মেও রোজা বা উপবাসের বিধান আছে। বেদের বিধান যে, চন্দ্রমাসের একাদশীর দিন পুরোটাই উপবাস করতে হবে৷ শুধু জলপান করা যাবে৷ আহার করা নিষিদ্ধ। সে হিসাবে মাসে দু’বার এই উপবাসের রেওয়াজ আছে৷ সাধারণত মেয়েরা উপবাস পালন করেন সন্তান সহ অন্যান্যদের মঙ্গল কামনা করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান:-
মেডিক্যাল সাইন্সে উপবাস করলে তাকে বলা হয় ‘অটোফেজি’। খুব বেশি দিন হয়নি, মেডিক্যাল সাইন্স অটোফেজি’র সাথে পরিচিত হয়েছে। ২০১৬ সালে নোবেল কমিটি জাপানের ডাক্তার ওশিনরি ওসুমি-কে অটোফেজি আবিষ্কারের জন্যে পুরষ্কার দেন। এরপর থেকে আধুনিক মানুষেরা ব্যাপকভাবে উপবাস করতে শুরু করেন।
Autophagy কি?
Autophagy শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে নিজে, এবং Phagy অর্থ খাওয়া ।সুতরাং , অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খাওয়া । না, মেডিক্যাল সাইন্স নিজের মাংস নিজে খেতে বলে না । শরীরের কোষগুলো বাইরে থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিক্যাল সাইন্সের ভাষায় তাকেই অটোফেজি বলা হয়।
আরেকটু সহজভাবে-
আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন থাকে, অথবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে । সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে, ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে, কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায় । শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে , তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে । ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতন অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মত অলস হয়ে বসে থাকে না , তাই প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয় ।কোষগুলোর আমাদের মতন আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে।মেডিক্যাল সাইন্সে এই পদ্ধতিকে বলা হয় অটোফেজি ।
শুধুমাত্র এই জিনিসটা আবিষ্কার করেই জাপানের ওশিনরি ওসুমি (Yoshinori Ohsumi) ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কারটা নিয়ে গেলেন । তিনি আবিষ্কার করেন যে ১২-২৪ ঘন্টা রোজা রাখলে মানুষের দেহে অটোফেযি চালু হয়। তিনি প্রমান করেন যে, রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের নিম্ন লিখিত উপকারগুলো হয়-
১| দেহের সেল পরিস্কার হয়। ২| ক্যান্সার সেল ধ্বংস হয়। ৩| পাকস্থলীর প্রদাহ সেরে যায়। ৪| ব্রেইনের কার্যকরীতা বাড়ে। ৫| শরীর নিজে নিজেই সেরে যায়। ৬| ডায়াবেটিস ভালো হয়। ৭| বার্ধক্য রোধ করা যায়। ৮| স্থূলতা দূর হয়। ৯| দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়।