হিন্দু মাদ্রাসাছাত্রীর ফেসবুকে স্ট্যাটাস নিয়ে তোলপাড়

Spread the love

অয়ন বাংলা,খোলা চিঠি:- ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এক অসাধারণ লেখা সম্প্রতি ফেসবুকে পোস্ট করেছে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের ওই কিশোরী। পড়ুন সেই লেখা—

“আমার প্রিয় দেশবাসী…
আমি প্রশমা শাসমল, আপনারা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার ধূলাগড় এর নাম অনেক শুনেছেন… আমি সেই জেলারই উদয়নারায়নপুর ব্লকের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে…. বাবা মা ও ছোটো ভাই কে নিয়ে আমাদের পরিবার। এতটুকু পড়ার পর আপনারা নিশ্চয় বিরক্ত হয়ে ভাবছেন এইসব অপ্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য এত ঘটা করে দেশবাসীকে চিঠি লেখার কী প্রয়োজন… এরকম সাধারণ মেয়ে কয়েক কোটি এদেশে আছে…. একদম ঠিক ভেবেছেন, আমি খুব সাধারণ মেয়ে আর তাই নিজের কিছু অনুভুতি, ভালো লাগা, ভাবনা, জিজ্ঞাসা,কৌতূহল আপনাদের সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাঁই… আপনাদের কিছুটা মুল্যবান সময় আমাকে দেবেন এই আশা রাখি…

আমি প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে এলাকার আর পাঁচটা সাধারণ ছাত্রীর মতন পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিলাম স্থানীয় গড়ভবানীপুর উষারানী করাতি বালিকা বিদ্যালয়ে… ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনো আমার ভীষন প্রিয়,দিনের অনেকটা সময় আমি কাটিয়ে দিতাম বই খাতা নিয়েই… বাবা মাও আমাকে উৎসাহ দিতেন…. স্কুলের রোজকার পড়াশোনর বাইরে বাবাকে ব্যাস্ত করতাম নানা জাগতিক বিষয়ে প্রশ্ন করে….ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করার পর একদিন বাবা হঠাৎ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আমায় বললেন…” মা তুই খলতপুর মাদ্রাসায় ভর্তি হবি…? শুনেছি ওখানে খুব ভালো পড়াশুনো হয়, তুই এত ভালো রেজাল্ট করেছিস…ওখানে মাস্টার মশাইরা খুব যত্ন নিয়ে পড়ায়, আমি শুনেছি”… প্রথমে আমি একটু অরাজি ছিলাম কারন পুরোনো স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হবে, তারপর আমি একজন হিন্দু ঘরের মেয়ে… মাদ্রাসার সম্পূর্ণ অজানা অচেনা পরিবেশ,মাদ্রাসা মানেই একটা অজানা আশঙ্কা… আমি কী মানিয়ে নিতে পারবো… কিন্তু, সব আশঙ্কা ছাপিয়ে খলতপুর মাদ্রাসায় ভালো পড়াশুনো হয়, মাস্টার মশাইরা খুব যত্ন নিয়ে পড়ায়… বাবার এইসব কথাগুলি আমায় বেশি আকৃষ্ট করেছিলো… ভর্তি হয়ে গেলাম খলতপুর মাদ্রাসায়….

খুব অল্প দিনেই অনেক নতুন বন্ধু পেয়ে গেলাম…আনোয়ারা , ফতেমা, শামিমা, রেশমা, পূর্নিমা…. খলতপুর মাদ্রাসা আমার কাছে মন্দির হয়ে উঠলো… নুরুল স্যার,আরিফুল স্যার, কলিম স্যারেদের সস্নেহ প্রশ্রয়ে আমরা মাদ্রাসা দাপিয়ে বেড়াতাম, খেলা ধুলো সহ সবেতেই আমরা মেয়েরা এগিয়ে থাকতাম… তবে মন দিয়ে পড়াশুনোটাও করতাম…. এক মুহুর্তের জন্য কখনো মনে হয় নিই আমি কোনো অপরিচিত পরিবেশে পড়াশুনো করছি… আমি যেমন স্বছন্দে ঈদের দিন আনোয়ারা, ফতেমা , শামিমার বাড়িতে ওদের সাথে উৎসবে মিশে যাই তেমন ভাবে ওরাও সরস্বতী পূজোর দিন আমাদের বাড়িতে সারাদিন আমার সাথে মিলে পূজোয় আনন্দ করে প্রতি বছর… সামান্যতম সময়ের জন্য কোনোদিন মনে হয় নিই ওরা মুসলিম আমি হিন্দু। মাদ্রাসায় আমার পড়াশুনো , ভালো রেজাল্ট আর স্যারেদের আমার প্রতি যত্ন নেওয়া দেখে বাবা -মা আমার ছোটো ভাই কেও আমার মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন তিন বছর আগে…..
এবছর আমি হাই মাদ্রাসার দশম শ্রেনীর মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষায় ৭২৯ নম্বর পেয়ে রাজ্যের মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় ও রাজ্যের মদহ্যে অষ্টম স্থান পেয়েছি। বাবা মা, স্যারেরা সবাই খুব খুশী… আজকে আমার মাদ্রাসার সব ছাত্র ছাত্রী ও স্যারেরা মিলে আমায় সংবর্ধনা দিলো… আমি এই মাদ্রাসার ছাত্রী হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। শুধু আমি নই, এবছর হাই মাদ্রাসায় মোট ৫২,১১৫ জন ছাত্র ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছিলো পশ্চিম বঙ্গে এবং তার মধ্যে ২,২৮৭ জন হিন্দু ছাত্র ছাত্রী।

চারিদিকে অসহিষ্ণুতার বিষাক্ত ছোবল, আমি শুনতে পাই হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, অশান্তি…কত কিছু… কিন্তু বিশ্বাস করুণ, কখনো একটি হিন্দু মেয়ে হিসেবে মাদ্রাসার ছাত্রী হয়ে নিজেকে বিপন্ন মনে হয় নিই…. কখনো আমার কোনো বন্ধুর চোখে আমি এক মুহুর্তের জন্য আমার প্রতি অবিশ্বাস দেখি নিই… বিশ্বাস করুণ, পাশের এলাকা ধুলাগর নিয়ে কত কথা শুনেছি, কিন্তু সেই মুহূর্তেও আমি আনোয়ারার বাড়িতে বসে একসাথে পড়াশুনো করেছি… পড়ার শেষে আনোয়ারার বাবা রহিম কাকু আমাকে বাড়ি পৌছে দিয়েছে… বাবা মা নিশ্চিন্তে আমার অপেক্ষায় থাকতেন… আমি আমার মতন করে এই পরিবেশে নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করেছি… হ্যা, এই বাংলার মাটিতেই এটা সম্ভব হয়েছে… আমি কৃতজ্ঞ এই বাংলার পবিত্র মাটির প্রতি…. আজ আমার এই সাফল্য তাই আমি এই বাংলার অখ্যাত খলতপুর গ্রামের হাই মাদ্রাসা কেই উৎসর্গ করতে চাঁই… ও আর একটি কথা জানাতে ভুলে গেছি… আমি এই মাদ্রাসাতেই একাদশ শ্রেনীতে পড়াশুনো করবো…. আপনাদের সবার আশির্বাদ চাঁই…. সবাই খুব ভালো থাকবেন। ।

ইতি বাংলার এক সাধারণ মেয়ে ,
প্রশমা শাসমল।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.