পঙ্গপালের ভয়াবহতা :- লিখেছেন ডাঃ মহসিন বৈদ্য

Spread the love

পঙ্গপালের ভয়াবহতা :-
লিখেছেন ডাঃ মহসিন বৈদ্য

প্রতিবেদন :- “এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ ক’রে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে।” রবিঠাকুরের সহজপাঠের এই পঙ্গপালের দল যে মোটেই সহজ-সরল না তা যেমন অক্ষয় বাবু,ক্ষিতি বাবুরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন,এবার বোধ হয় আমাদের পালা।

গ্রামবাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, হিসেব ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব। প্রকৃতি যেন ঠিক তেমনি মানুষের থেকে সব হিসেব ইঞ্চি কেন, তার চেয়েও আরো ক্ষুদ্র পরিমাপের জিনিস দিয়ে বুঝে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। বিষময় ২০বিশ সাল শুরু হয়েছে ১২৫ ন্যানোমিটারের এক ভাইরাসের আতঙ্ক আর হত্যাযজ্ঞ দিয়ে,তার পর সমুদ্র থেকে এলো আমফান নামের এক ঘূর্ণি-দানব,উত্তরাখণ্ডের দাবানল আর এখন আরেক চিন্তা ২ ইঞ্চির মরু-পঙ্গপালের ঝাঁকের তাণ্ডবলীলা!

সবুজ রঙের আপাত নিরীহ ঘাসফড়িং আমরা প্রায় সবাই দেখেছি। ঠিক একই গোত্রের এই মরু পঙ্গপালের বিজ্ঞানসম্মত নাম Schistocerca gregaria. উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি,মধ্যপ্রাচ্যের মরু এলাকা এদের মূল বাসস্থান। স্ত্রী পঙ্গপাল শক্ত,শুষ্ক ভূমিতে একত্রে প্রায় ৫০ টি ডিম পাড়ে,এগুলিকে ‘pod’ বলে। একটি স্ত্রী পঙ্গপাল এরকম এক থেকে তিনটি ডিমের pod পাড়ে, আর সেগুলো মাটির নিচে চার ইঞ্চি অব্দি চাপা থাকতে পারে। সপ্তাদুই পর সেগুলো ফুটে নিম্ফ বা শিশু পঙ্গপাল বের হয়। পরের এক থেকে দুই মাসে এরা পাঁচটি দশা বা instar অতিক্রম করে,যার শেষ instar এ ডানা গজায় এবং পূর্ণাঙ্গ পঙ্গপালে পরিণত হয়। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় এরা সাধারণত দশ সপ্তাহ বাঁচে।

Acrididae গোত্রের এই পতঙ্গেরা solitary বা বিচ্ছিন্নভাবেই থাকে,কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে এরা gregarious বা দলবদ্ধ/সমাজবদ্ধ হয়ে ওঠে, আর ক্ষুদ্র প্রাণীটির এই দশাই মানুষের জন্যে ভ্রূকুটির কারণ। প্রচন্ড গরমে এরা একজায়গায় অল্প খাদ্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়। আর এইসময়েই ঘটে এক ম্যাজিক। তার নাম সেরোটোনিন,যা আদতে একপ্রকার নিউরোট্রান্সমিটার। সেরোটোনিন এদের মস্তিষ্কে আশ্চর্যজনক কিছু প্রভাব ফেলে,যার ফলস্বরূপ তাদের আচার-ব্যবহার,বাহ্যিক গঠন,খাদ্যাভ্যাস সবকিছুতেই অকল্পনীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সেরোটোনিন এমন এক ম্যাজিক যা এদের প্রজনন ক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে, যা নিরীহ এক প্রাণীকে রাক্ষুসে খাদক বানিয়ে তোলে। এরা হয়ে ওঠে আরো পেশীবহুল, সুঠাম;এমনকি এদের রং ও পরিবর্তিত হয়ে ঈষৎ হলদে-বাদামি হয়ে যায়। এরপর যখন বৃষ্টি হয়,সবুজের সমারোহ বাড়ে,ঠিক তখনই এরা সংখ্যায় বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে,তারা দলবদ্ধ হতে শুরু করে। solitary দশা থেকে gregarious দশায় জীবন কাটাতে শুরু করে। ডিম থেকে নিম্ফ,তারপর পূর্ণাঙ্গ ফড়িং,জীবনের যেকোনো পর্যায়ে এরা solitary ফেজ থেকে gregarious ফেজে জীবনধারা পরিবর্তন করতে পারে,কিন্তু শর্ত একটাই প্রাকৃতিক পরিবেশ তার অনুকূল হতে হবে।

যখন অল্প স্থানে এদের সংখ্যা কয়েক হাজার গুন বেড়ে যায় তখন দলে দলে বেরিয়ে পড়তে থাকে পরিযানে আর সেই দলে যেমন উড়ান-অক্ষম নিম্ফ থাকে,তেমনি উড়ানক্ষম পূর্ণাঙ্গ ফড়িং থাকে।
এদের উড়ান ক্ষমতা? তাজ্জব বানিয়ে দেওয়ার মতো। এদের একেকটা দল দিনে গড়ে ৮১ মাইল আর ২০০০ ফুট উচ্চতা অব্দি উড়তে পারে,এমনকি মাইলের পর মাইল সমুদ্রের ওপর দিয়ে দেশ-মহাদেশ ও পার করে ফেলতে পারে। ১৯৫৪ তে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এরকম একটা দল(swarm) আটলান্টিক সাগর পেরিয়ে গ্রেট ব্রিটেনে পাড়ি দিয়েছিল। ১৯৮৮ তে আরেকটা swarm মাত্র ১০ দিনে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে ৩১০০ মাইল পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিল!

তা বাপু লকডাউনে যখন লোকের এমনিই নাভিশ্বাস তখন ঘাসফড়িং নিয়ে এত কথা কেন? সেই যে রবিঠাকুর লিখে গেছেন,”তাড়াতে না পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে”! এরা একদিনে ৩৫০০০ লোকের খাবার খেয়ে সাবাড় করে দিতে পারে! পুঞ্জাক্ষীর সামনে যা পায় তাই খায়।মানে? ধান,গম,যব, জোয়ার,ভুট্টা,আখ,তুলো, কলা,কড়াই, ডাল,শাক-সব্জী,পাতা …সবই! ইতিমধ্যেই কয়েক কোটি টাকার ফসল,সব্জী নষ্ট হয়ে গেছে। এদের আটকানো না গেলে আরো কয়েক হাজার কোটি মূল্যের শস্য,সবজি,ফসল নষ্ট করে দেবে। ফলে শুরু হবে খাদ্যসংকট,অনাহার,দুর্ভিক্ষ। এদের swarm গঠনে মূল ভূমিকা থাকে ফেরোমন নামক হরমোনের। এই ফেরোমনের আবার মূল উপাদান guaiacol নামক এক রাসায়নিক,যা এদের পাচনতন্ত্রে একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া ভক্ষিত উদ্ভিজ্জ উপাদান থেকে তৈরি করে। এর গন্ধ শুঁকেই এরা দলবদ্ধ হয়ে পরিযানে বের হয়। এদের একেকটা swarm কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে,যাতে কোটি কোটি পঙ্গপাল থাকে! দূর থেকে দেখে মনে হয় ঘন কালো মেঘ ধেয়ে আসছে। ইতিমধ্যে হর্ন অফ আফ্রিকার সোমালিয়া,কেনিয়া,উগান্ডা, ইথিওপিয়া কে লণ্ডভণ্ড করে,মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেন,সৌদি ইরান হয়ে পাকিস্তান পেরিয়ে পশ্চিম ভারতে কয়েকমাস আগেই ঢুকে পড়েছে। আরেকটা swarm পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে সোজা দক্ষিণ ভারতে ঢুকতে চলেছে। যুগে যুগে পঙ্গপালের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। শেষবার 2003-05 সালে উত্তর আফ্রিকায় বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। আর 2019-20 সালের চলতি প্রাদুর্ভাব তার চাইতে কয়েক গুণ বিধ্বংসী! ইতিমধ্যে ইউনাইটেড নেশন্স আগামী বছরে খাদ্যসংকট ঘটার ইঙ্গিত দিয়েছে। সোমালিয়া, পাকিস্তান জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করেছে।

কোরোনা সংকটের মাঝেই হয়তো কেউ কেউ লক্ষ্য করেছেন মাঝে মাঝে এদেরকে নিয়ে খবর বেরিয়েছে,পাঞ্জাব হরিয়ানা রাজস্থানের কৃষকদের মাথায় হাত! পঙ্গপালের দল উজাড় করে দিয়েছে বিঘের পর বিঘে শস্য-সবজি। থালা-বাসন বা বাতি-মশাল জ্বালিয়ে কিন্তু পঙ্গপাল তাড়ানো যায় না। কীটনাশকের ব্যবহার ও সীমিত। গতসপ্তাহে তাদের একটা দল মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে ঢুকে পড়েছে। তাদের গতির ছেদ নেই,বিরামহীন তাদের ধ্বংসযজ্ঞ। আরো পূবে এগোচ্ছে,কয়েকমাসের মধ্যে তারা বিহার হয়ে বাংলায় ঢুকবে,সীমানা পেরিয়ে পাড়ি দেবে বাংলাদেশ!

পঙ্গপালের ইতিহাস অনেক পুরোনো। হোমারের ইলিয়াড থেকে বাইবেল,কোরানেও এর উল্লেখ আছে। অত্যাচারী ফ্যারাও কে আল্লাহ/ঈশ্বর তাঁর প্রেরিত দূত মোজেস ও আ‍্যরনের মাধ্যমে (কোরানে মুসা ও হারুন নবী-তাঁদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) পরপর কয়েকটি শাস্তি পাঠিয়ে সতর্ক করেছিলেন,তার একটি হলো এই পঙ্গপালের দল।
১.তখন ঈশ্বর মোজেস কে বললেন, “তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, কারণ আমি তাঁর ও সভাসদদের হৃদয়কে শক্ত করে দিয়েছি যাতে আমি তাদের মধ্যে আমার এই চিহ্নগুলি প্রদর্শন করতে পারি,২.যাতে তুমি তোমার পরবর্তী প্রজন্মকে বলতে পারো যে আমি কীভাবে তাদের সাথে কঠোর আচরণ করেছি,মিশরীয়দেরকে কিভাবে আমার চিহ্নগুলি দেখিয়েছি এবং জানতে পারবে যে আমিই ঈশ্বর। ৩.সুতরাং মোজেস এবং আ‍্যরন ফেরাউনের কাছে গিয়ে বলল “হিব্রুদের ঈশ্বর বলেছেন:‘ তুমি আর কতক্ষণ আমার সামনে নিজেকে বিনীত করতে অস্বীকার করবে? আমার লোকদের(মিসর ছেড়ে) যেতে দাও যাতে তারা আমার উপাসনা করে। ৪.যদি আপনি তাদের যেতে না দেন তবে আমি আগামীকাল আপনার দেশে পঙ্গপাল আনব। ৫.তারা মাটির মুখ ঢেকে দেবে।জমিতে জন্মানো প্রতিটি গাছ তারা গ্রাস করবে। ৬. তারা তোমাদের ঘর ভরাট করবে — যা এই দেশে থিতু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আপনার বাবা-মা বা পূর্বপুরুষ কখনও দেখেনি ’'(বাইবেল এক্সডাস ১০:১-৬)
“অতঃপর আমি তাদের উপরে বন্যা, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ এবং রক্ত ​​প্রেরণ করেছি স্বতন্ত্র নিদর্শন হিসাবে, তবে তারা (ফেরাউন ও মিসরবাসী) অহংকার করেছিল এবং অপরাধী সম্প্রদায় ছিল।” (কোরআন ৭:১৩৩)

কোরানে আরেক জায়গায় এদের কথা এসেছে,সেটা বিচার দিবসে সমস্ত মনুষ্যকূলের পুনরুত্থানের ব্যাপারে।
“অবনমিত নেত্রে সেই দিন তারা কবর হতে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায়।”(৫৪:৭)
অবাক করা কিছু মিল পেলেন?
পঙ্গপালের জন্ম এবং মানুষের পুনরুত্থানের মধ্যে মিল রয়েছে।
পঙ্গপালের মতো সেদিন মানুষ ও কবর থেকে
-একটা নির্দিষ্ট সময় পর
– মাটির নিচ থেকে
– একসাথে দলে দলে
-পৃথিবী পৃষ্ঠে উঠে আসবে!
(এগুলো উল্লেখ করলাম যেহেতু আমি এই আশ্চর্যজনক উপমাটি পঙ্গপাল নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি।)

করোনার গুঁতোয় এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কর্মহীন,উপার্জনহীন। দুমাসের লকডাউনে যেটুকু সঞ্চয় ছিল তাও প্রায় নিঃশেষ! ব্যর্থ প্রশাসন করোনার জাত ধর্ম খুঁজে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চেয়েছিল। তার ওপর সদ্য আমফানের তান্ডবে দক্ষিণ বঙ্গের বড় অংশের মানুষের চাল-চুলো উড়ে গেছে,ক্ষেতের শস্য,সব্জী নষ্ট হয়েছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যারপরনাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর উপরে পঙ্গপালের তান্ডব মানে খাদ্যসংকট, দুর্ভিক্ষ,অনাহার,মৃত্যুমিছিল অনিবার্য!

২৬/০৫/২০২০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.