নিউজ ডেস্ক : -ক্রমশ চাপ বাড়ছে মতুয়াদের নিঃশর্ত নাগরিক দিতে হবে । “প্রয়োজনে জীবন দেব। সারা ভারতবর্ষের মানুষকে নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে আন্দোলন করব।” CAA ইস্যুতে বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের পর এবার সরব প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ তথা মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতাবালা ঠাকুর । মতুয়াদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিলেন তিনি।
উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে ঠাকুরবাড়িতে এদিন মতুয়াদের এক জনসভা ছিল। সেখানেই মমতাবালা ঠাকুর এদিন বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার বলছে CAA-র মাধ্যমে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেব। বিভিন্ন সময়ে বিজেপির (BJP) বিভিন্ন নেতারা এসে একই কথা বলছেন। কিন্তু নাগরিকত্বের যে আইন পাস হয়েছে, তাতে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সি ধর্মের নাম থাকলেও, কোথাও মতুয়াদের (Matua) নাম উল্লেখ নেই। তোপ দাগেন, “বিজেপি সরকার ও বিজেপির নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলছেন CAA-র মাধ্যমে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তাঁরা মতুয়াদের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করছেন। কোথাও লেখা নেই মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি অবিলম্বে মতুয়াদের মতুয়াদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব না দেয় তাহলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাব। আমরা প্রথমে বিধানসভাভিত্তিক আন্দোলন করব। তার মধ্যেও যদি নাগরিকত্ব না দেয়, তাহলে সারা ভারতবর্ষের লোক নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে আন্দোলন করব। সংসদ ঘেরাও করব।”
এখন তৃণমূল যেখানে CAA-র বিরোধী, সেখানেই সেই দলেরই এক প্রাক্তন সাংসদ CAA নিয়ে সরব। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। এপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় স্পষ্ট বলেন, “মমতাবালা ঠাকুরের মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে চাই না। মতুয়াদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন-ই নেই। ওঁরা নাগরিক ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তাঁরা ভোট দিচ্ছেন। রেশন কার্ড আছে। সুতরাং এটার কোনও দরকার নেই। আমরা দেখেছি, অসমে NRC করতে গিয়ে ১৯ লাখ বাঙালি হিন্দুর নাম বাদ গিয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে। ব্যক্তিগত কে কী বলছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
অবশ্যই পড়বেন যারা CAA কে সমর্থন করেন
নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছি বলে যারা আনন্দে লাফাচ্ছেন, তারা হাড়িকাঠে গলা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন—:
গত 11 ডিসেম্বর 2019 লোকসভার পর রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গেল “নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন 2019” এবং দেশের আইনে পরিণত হলো এই বিলটি। বিলটি পাস হওয়ার পর মতুয়া সমাজ সহ অনেক হিন্দুরাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন মূলত দুটি কারণে, প্রথমতঃ হিন্দু শরণার্থীরা নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছেন বলে তারা মনে করছেন। দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের এই বিল থেকে বাদ রেখে “তাদের খুব টাইট দেওয়া গেল” বলে তারা মনে করছেন। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই সকল হিন্দুরা কি এই নতুন অ্যাক্ট বা আইনটি ভালো করে পড়েছেন ? নাকি কিছু না বুঝি শুধু শোনা কথায় আনন্দে লাফাচ্ছেন। এবার দেখুন এই বিলটি বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের (বাঙাল), ভারতে স্থায়ী বসবাসকারী হিন্দুদের (ঘটি) ও আদিবাসী সমেত গোটা বাঙালি জাতির পক্ষে কতটা ভয়ঙ্কর ও গভীর ষড়যন্ত্র মূলক আইন।
এই আইনে বলা হয়েছে –“পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর যারা 2014 সালের 31 ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রবেশ করেছেন তারা শরণার্থীর মর্যাদা পাবে এবং CAA-র মাধ্যমে তারা শরণার্থী ফর্ম পূরণ করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন।” অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু সহ আরো পাঁচটি জনগোষ্ঠীর মানুষ বৈধ শরণার্থীর মর্যাদা পেলেন বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। এবার এই শরণার্থী থেকে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে এই সকল মানুষকে CAA- তে (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) অংশগ্রহণ করতে হবে। CAB এখন আইনে পরিনত হয়ে CAA হয়েছে। অর্থাৎ সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল (CAB) এখন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্টমেন্ট অ্যাক্টে (CAA) পরিনত হয়েছে। CAA- তে গিয়ে শরণার্থী ফর্ম পূরণ করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। এই ফর্ম পূরণ করার সময় মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করলে ভারতীয় দণ্ডবিধি ধারায় তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। এই ফর্মে 32 টি তথ্য আপনার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে। যদি CAA তে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে এর পরের স্টেজ NRC (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন) -তে নাম তুলতে পারবেন। অর্থাৎ CAA ও NRC দুটি আলাদা বিষয়।
এই নাগরিকত্ব আইন থেকে একথা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসকল শরণার্থীরা এ দেশে এসেছেন তারা CAA -তে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল যে, বাংলাদেশ থেকে যে সকল হিন্দুরা ভারতে এসেছেন, তারা এদেশে আসার পরেই নিজেদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বা টিকে থাকার প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাবে জন্ম সার্টিফিকেট, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট বানিয়েছেন, জমি জায়গা কিনে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন এবং অসংখ্য মানুষ সরকারি চাকরিও করছেন। এখন এরা কিভাবে CAA-তে গিয়ে শরণার্থীর ফর্ম পূরণ করবে ? কারণ এরা তো ইতিমধ্যেই জন্ম সার্টিফিকেট, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট, আধার কার্ড, জমি-জায়গা, ঘর বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। 1955 সালের নাগরিক সংশোধনী আইন অনুযায়ী কোনো শরণার্থীর এদেশে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট বানানোর কোন অধিকার নেই, ঘরবাড়ি, সরকারি চাকরি করার অধিকার নেই। তাই এই সকল মানুষগুলি যখনই শরণার্থীর ফর্ম পূরণ করবেন তখনই প্রশ্ন আসবে যে, “এরা শরণার্থী হয়ে কিভাবে এই ডকুমেন্টস গুলি বানিয়েছেন”। অর্থাৎ এটা প্রমাণ হয়ে যাবে যে, এরা বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে অবৈধভাবে এইসব প্রমান পত্র গুলি জোগাড় করেছেন। যারা ভারতে প্রবেশ করে ইতিমধ্যেই বিভিন্নভাবে জন্ম সার্টিফিকেট বানিয়েছেন, তারা কিভাবে বাংলাদেশী শরণার্থী হিসেবে ফর্ম পূরণ করবেন ? যারা জন্ম সার্টিফিকেট বানিয়ে সেই জন্ম সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরি করছে বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করছে, তারা কিভাবে এই শরণার্থীর ফর্ম পূরণ করবেন ?একটা মানুষের বাংলাদেশ জন্ম আবার ভারতেও জন্ম –এটা হতে পারে ? কেউ বগুলা, বনগাঁ, বারাসাত বা অন্য কোথাও জন্মস্থান দেখিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, ভোটার কার্ড বানিয়েছে, চাকরি করছে, আবার তারা শরণার্থী ফর্মও পূরণ করবে –এটা কখন সম্ভব ? আবার কেউ যদি এইসব প্রমাণপত্র গোপন রেখে CAA-তে গিয়ে শরণার্থী ফর্ম পূরন করে তখন তার বিপদ আরো বেশি। কারণ এখন সবকিছুর সঙ্গে আধার লিঙ্ক বা ইন্টারনেট লিংক হয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে। দশ আঙুলের ছাপ, চোখের রেটিনা, ছবি ইত্যাদি দিয়ে আধার কার্ড করা হয়েছে। তাই কম্পিউটারে এক চাপ দিলেই সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। তখন মিথ্যা বা ভুল নথি দেওয়ার দায়ে তাকে জেল খাটতে হবে। এবার বাংলাদেশ থেকে আসা এই সব মানুষগুলির কেউ যদি মনে করে যে আমি CAA-র ঝামেলায় যাব না, সরাসরি NRC-তে নাম নথিভুক্ত করবো, তখন তার ক্ষেত্রেও নাগরিকত্ব পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ এই আইনে CAA-এর ভিত্তি বছর ধরা হয়েছে 2014 সালের 31 ডিসেম্বর। কিন্তু NRC ক্ষেত্রে এই ভিত্তি বছর কত হবে তা এই আইনে দেওয়া নেই। তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে, পুরনো নাগরিকত্ব আইনে অর্থাৎ 2003 সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে NRC ভিত্তি বছর হিসাবে যে তারিখ দেওয়া রয়েছে সেটাই NRC-র ভিত্তি বছর। পুরনো আইন অর্থাৎ 2003 সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে NRC-র ভিত্তি বছর ধরা হয়েছে 1948 সালের 19 জুলাই। এবার আপনারা বলুন, বাংলাদেশ থেকে আগত কতজন মানুষ 1948 সালের 19 জুলাই এর আগের প্রমাণপত্র দেখাতে পারবেন। এই নতুন নাগরিক বিল পাস হওয়ার পর যারা আনন্দে লাফাচ্ছেন তারা এবার বলুন যে, এই আইনের জটিলতায় আপনারা কখনো ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন ? আবার যারা বাংলাদেশ থেকে এসে এখনো কোনো প্রমাণ পত্র, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, জমি-বাড়ি ক্রয় করেননি, তারা অবশ্যই শরণার্থী ফর্ম পূরণ করতে পারবেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বড় বাধা হল, সেই ব্যক্তি কি করে প্রমাণ করবেন যে, 2014 সালের 31 ডিসেম্বরের আগে ভারতে এসেছেন। কারণ তার কাছে কোনো ডকুমেন্টস নেই এবং ভারতে ঢুকার সময় সে তো ভারত সরকারের কাছে অনুমতি নিয়ে বা নাম নথিভুক্ত করে ভারতে প্রবেশ করেননি। তাই যারা নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবি করেছিলেন, আন্দোলন করেছিলেন, তারা কি নিঃশর্ত নাগরিকত্ব পেলেন ? বরং এদের কোন ভাবে একবার যদি শরণার্থীর তালিকায় ফেলে দিতে পারা যায়, তাহলে শরণার্থী থেকে ভারতীয় নাগরিক হতে কমপক্ষে এদের 200 বছর লাগবে। তার কারণ CAA-তে গিয়ে শরণার্থী ফর্ম পূরণ করে ট্রাইবুনাল কোর্টে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে ট্রাইবুনাল কোর্টে কয়েক লাখ কেস পড়ে (পেন্ডিং) রয়েছে। এরপর যদি আরও কয়েক কোটি মানুষ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন তাহলে নাগরিকত্ব পেতে অন্তত দুইশ বছর লেগে যাবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, এই নতুন আইনে শরণার্থী থেকে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠিন কতগুলি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এই বিলের 3(2) ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, “1955 সালের নাগরিকত্ব আইনের 5 নং ধারায় যে শর্ত গুলি রয়েছে সেই শর্ত গুলি পূরণ করলে তবেই সেই শরণার্থী থেকে নাগরিকত্ব পাবে। এই শর্ত গুলি পূরণ করা কোনো শরণার্থীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এর থেকে পরিষ্কার যে, একবার শরণার্থীর তালিকায় ঢুকে গেলে সেখান থেকে নাগরিকত্ব পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। শরণার্থী হয়ে তাকে বংশপরম্পরায় এদেশে কাটাতে হবে। আর এটাই বিজেপির আসল ষড়যন্ত্র। আসলে এই নতুন বিলটি 2016 সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের এপিঠ আর ওপিঠ। শুধু কায়দা করে কিছু শব্দ বাদ দিয়ে, কিছু শব্দ যোগ করে একটু ঘুরিয়ে দিয়েছে। এতদিন যারা এদেশে নাগরিকত্বের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, এই বিল তাদের নাগরিকত্ব থেকে টেনে নামিয়ে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়ার কথা বলছে। বিজেপি যদি এতোই হিন্দু প্রেমী হয়, তাহলে তারা এরকম আইন পাস করাতে পারতো যে –“2014 সালের ভোটার তালিকায় যেসকল হিন্দুদের নাম আছে তারাই ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন”। এভাবে নাগরিকত্ব বিল পাস করালে এতে কোনো শর্তও থাকতো না, আর হিন্দুদের নাগরিকত্ব পেতে কোনো রকম সমস্যাও হতো না। আসল কথা হলো অমিত শাহ-মোদি- বিজেপির মনে রয়েছে ষড়যন্ত্র। তাই তারা নাগরিকত্ব দেবে না — এই সহজ কথাটি মতুয়ারা সহ অনেক হিন্দুরাই বুঝতে পারছেন না। মতুয়ারা বারবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে, অথচ তারা ইতিহাস থেকে কেনো শিক্ষা নেয়নি।এরা দেশভাগের বলি হয়ে এদেশে এলে আন্দামান, নৈনিতাল, মানাক্যাম্প, বিহারের বেতিয়া ইত্যাদি দুর্গম জায়গায় এদের পাঠিয়ে দিয়ে একদিকে যেমন এদের ঐক্যশক্তিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, অপরদিকে এদের দুর্গম বিপদসংকুল পরিবেশে পাঠিয়ে জীবনকে দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল— যেখানে বেঁচে থাকাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বিজেপি-RSS একেবারে আসামের কায়দায় চলছে। অসমের মত বাংলায়ও বিজেপি একবার ক্ষমতায় এসে গেলে এদের আসল রূপ প্রকাশ পাবে। তার আগে এমন একটা ভাব দেখাবে যেন হিন্দু শরনার্থীরা নাগরিকত্ব পেয়েই গেল। কিন্তু আসল কথা হলো নাগরিকত্বের নামে এরা মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে, বেনাগরিক করার, ভিটেমাটি উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করছে। 2014 সালে লোকসভা ভোটের আগে অসমের এক জনসভায় নরেন্দ্র মোদি বলেন –“বিজেপি ক্ষমতায় এলে অসমের সব ডিটেনশন ক্যাম্প ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হবে।”
এবার আসি এদেশীয়দের (ঘটি) প্রসঙ্গে। যারা এদেশীয় মানুষ, তারা তো আর শরণার্থী হয়ে CAA -তে নাম নথিভুক্ত করবেন না। তারা NRC-তে নাম নথিভুক্ত করবেন। কিন্তু NRC-র ভিত্তি বছর হলো 1948 সালের 19 জুলাই। এবার বলুনতো কতজন মানুষ 1948 সালের 19 জুলাই এর আগের নাগরিকত্বের প্রমাণ পত্র দেখাতে পারবেন ? তাহলে যারা দেখাতে পারবে না তাদের উপায় কী হবে। এই নতুন আইন অনুসারে তারা একধাক্কায় এদেশের বেনাগরিক হয়ে পড়বেন। সবচেয়ে বড় অসুবিধায় পড়বেন এদেশের আদিবাসী সমাজের মানুষেরা। তাঁদের প্রায় 90% মানুষই 1948 সালের 19 জুলাই এর আগের নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখাতে পারবেন না। কারণ কোনো সরকারই “অরণ্যের অধিকার” আইন মেনে ভূমিপুত্রদের জমির পাট্টা দেননি।বরং গত 13 ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুন মিশ্রের এক অন্যায় অবৈধ রায়ে 23 লাখ 75 হাজার আদিবাসী পাট্টার অধিকার হারিয়ে ভিটেহারা হয়েছেন। তাই এই নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন এদেশের আদিবাসী-মূলনিবাসী- ভূমিপুত্ররা। অসম তার বড় প্রমান। সেখানে প্রায় আড়াই লাখ আদিবাসীর NRC-তে নাম ওঠেনি।
ফলে এই নতুন আইনে মুসলমানদের “আচ্ছা টাইট দেওয়া যাবে” বলে যে সকল হিন্দুরা আনন্দে লাফাচ্ছেন, তারা নিজেদের কথাটি কি একবার ভেবে দেখেছেন ? বরং এই আইনে নাগরিকত্ব থেকে সবচেয়ে মুসলমানদের নাম কম বাদ যাবে। কারণ এদেশে তাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটে-মাটি রয়েছে। তাই মুসলমানেরা এই আইনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ আন্দোলন করছেন, এই প্রতিবাদ আন্দোলন হিন্দুদেরই করা উচিত–তবে তা অবশ্যই সংবিধান মেনে।
সবচেয়ে লজ্জার কথা হলো, দুজন গুজরাটি আজ সমগ্র বাঙালি সমাজকে বিপদের মুখে, বিভাজনের মুখে ফেলে দিয়েছেন। এই আইনের ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে বাঙ্গালীদের। কারণ দেশভাগের বলি তারাই। অথচ বাঙালি সমাজ আজ নীরব দর্শক হয়ে আছে। অপর দিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি, শিল্পে ধস, চূড়ান্ত আর্থিক মন্দা ইত্যাদি থেকে মানুষ যাতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাগরিকত্বের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এটা তারও একটা কৌশল। এরপর তো নাগরিকত্ব প্রমাণে দেশবাসীকে রুটি-রুজি ছেড়ে ছুটে বেড়াতে হবে, লাইনে দাঁড়াতে হবে। অসমে NRC আতঙ্কে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে — এবার গোটা দেশে মৃত্যু মিছিল শুরু হবে। বিজেপি-RSS-এর আরেকটি কৌশল হলো, বর্তমানে রাম মন্দির ইস্যু প্রায় শেষ, ভোটের আগে বারবার সার্জিক্যাল অ্যাটাক ইস্যু মানুষ আর খাচ্ছে না। ফলে CAA এবং NRC ইস্যু দিয়ে সরাসরি হিন্দু মুসলমান বিভাজন ও দাঙ্গা করিয়ে দিয়ে আরো অন্তত দুবার ক্ষমতায় থাকা যাবে — এটাই বিজেপি-RSS এর মূল লক্ষ্য। তাই ক্ষমতার লোভে আজ তারা সমগ্র দেশটাকে অস্থির করে তুলেছে, ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।।