উত্তরের দুই নক্ষত্র কৃষ্ণকান্ত রায় ও অতুল রায় স্মরণে-
পাশারুল আলম:- উত্তরবঙ্গের কামতপুরী ভাষা আন্দোলন ও উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্রদের অধিকার আদায়কল্পে যারা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে করোনা কালে আমরা দুই মহান ব্যক্তিত্বকে হারালাম। সাতের ও আটের দশকে ‘উত্তরবঙ্গ তপশিলি জাতি ও আদিবাসী’ সংগঠন(উতজাআস) সমগ্র রাজ্যে সাড়া ফেলেছিল। উত্তরবঙ্গের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সঙ্গে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন, তাদের অন্যতম নায়ক ছিলেন কৃষ্ণকান্ত রায়। তিনি পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি একজন মুক্ত মনা মানুষ ছিলেন। সামাজিক এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা সদস্য হিসেবে তার অবদান স্বর্ণাক্ষরে চিরকাল মানুষ মনে রাখবেন।
তিনি রাজনৈতিক ভাবে সমাজবাদী ছিলেন। দেশের বহুত্ববাদকে তিনি শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন। উতজাআসের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সমাজবাদী জন পরিষদ দলের প্রতিষ্ঠা সদস্য। কামতাপুরী ভাষা আন্দোলনের পুরোধা। কামতাপুরী ভাষা সম্পর্কে ছিল তার অগাধ জ্ঞান। যৌবন কাল থেকে সস্ত্রীক কামতাপুরী ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাদের আন্দোলন উত্তরবঙ্গের মানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাদের দেখানো পথে উত্তরবঙ্গে গড়ে উঠে বিভিন্ন গন আন্দোলন ও রাজনৈতিক দল। এমন এক সময় ছিল যখন কৃষ্ণকান্ত রায়ের ডাকে লক্ষ মানুষের সমাবেশ হত। যেখানে অন্যায় সেখানে প্রতিবাদ, সেখানেই ছিলো তার আবির্ভাব। ইসলামপুরকে জেলা করার দাবি হোক কিংবা নস্যশেখ সমাজকে অনগ্রসর ঘোষণা করার দাবিকে তিনি দৃঢ়তার সাথে রাখতেন। ট্রান্সফার্ড এরিয়া সূর্যাপুর অর্গানাইজেশন বা টাসোর আন্দোলনে তিনি সর্বদা স্বশরীরে হাজির থাকতেন। এন,এ,পি,এম, এর নেত্রী তথা নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের পুরোধা মেধা পাটকরের তিনি ছিলেন ভক্ত। এন,এ,পি,এমের একজন হিতাকাঙ্খী। জাতি সত্বা বিষয়ে তার ভালবাসা ও মননশীলতা ছিল অপরিসীম। সেই মহান পুরুষকে আমরা হারালাম করোনা আবহে। সাত জুন তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তার এই মৃত্যু দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
একই ভাবে করোনা আক্রান্ত হয়ে চির নিদ্রায় চলে গেলেন উত্তরবঙ্গের আর এক বীর সন্তান অতুল রায়। তিনি উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্র আন্দোলনের প্রাণ পুরুষও বটে। তারই প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠে কামতাপুর পিপলস পার্টি। দল ভাগ হলে তিনি কামতাপুর প্রোগ্রেসিভ পার্টি গঠন করেন। তার জীবন এক সংগ্রামী জীবন। উত্তরবঙ্গের ভাষা সংস্কৃতি সহ উত্তরবঙ্গের আলাদা রাজ্য আদায় করায় ছিল তার স্বপ্ন। মন খোলা মানুষ ছিলেন তিনি। বাম জমানায় তার দলকে পদে পদে হেনস্থা হতে হয়েছিল কিন্তু কোনোভাবে তিনি মাথা নত করেননি। পরবর্তীকালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারই প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠে কামতাপুরী ভাষা একাডেমী। তিনি মনে প্রাণে চাইতেন এবং বিশ্বাস করতেন উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ও ধর্মান্তরিত নস্যশেখ সমাজ মিলিতভাবে সংগ্রামে সামিল না হলে উত্তরবঙ্গের বিকাশ সম্ভব নয়। তিনিই ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে আদায় করেন নস্যশেখ উন্নয়ন বোর্ড। সত্যি কথা তার আন্দোলন উত্তরবঙ্গের মানুষের দাবিকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়ে গেছে। তার মধ্যে যে সম্প্রীতির ভাবনা ও তাকে বাস্তবে রূপায়ন করার মহৎ গুন উত্তরবঙ্গের মানুষ দেখেছে তা ভোলার নয়। সেই মহান ব্যক্তি মাত্র ৫৯ বছরের মাথায় ৯ই জুনআমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরনিদ্রায়। অতুল রায়ের মৃত্যু উত্তরবঙ্গের রাজনীতি অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। যা পূরণ হবার নয়।