“জয় শ্রীরাম” প্রসঙ্গে দু-এক কথা – তুহিন গাজী
প্রতিবেদন ,অয়ন বাংলাঃ- এই ধ্বনিটি হচ্ছে হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী সপ্তমতম অবতার শ্রীরামচন্দ্রের নামের জয় ধ্বনি।
এখন এ বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্নমূলক কথা:
প্রথমত, এই ধ্বনিটি কি কোন হিন্দুধর্ম গ্রন্থে পাবেন ? না, এ ধরনের কোন জয় ধ্বনি কিন্তু হিন্দুধর্মের কোন শাস্ত্রে উল্লেখ নাই!! তাহলে কেনো এই ‘জয় শ্রীরাম’ ??
দ্বিতীয়ত, হিন্দুধর্মে কি শ্রীরামচন্দ্র ছাড়া আর কোন অবতার নাই ?
গরুড়পুরাণ ১:৮৬:১০-১১ শ্লোকে দশ (মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, কল্কি) অবতারের কথা বলা হয়েছে।
আবার শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের প্রথম কন্দে সংখ্যাক্রম অনুসারে বিষ্ণুর ২২জন অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে নিম্নরূপ:
১. চতুর্সন (ভাগবতপুরাণ ১:৩:৬)
২. বরাহ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:৭)
৩. নারদ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:৮)
৪. নর-নারায়ণ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:৯)
৫. কপিল (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১০)
৬. দত্তাত্রেয় (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১১)
৭. যজ্ঞ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১২)
৮. ঋষভ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৩)
৯. পৃথু (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৪)
১০. মৎস্য (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৫)
১১. কূর্ম (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৬)
১২. ধম্বন্তরী (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৭)
১৩. মোহিনী (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৭)
১৪. নৃসিংহ (ভাগবতপুরাণ ১:৩: ১৮)
১৫. বামন (ভাগবতপুরাণ ১:৩:১৯)
১৬. পরশুরাম (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২০)
১৭. ব্যাসবেদ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২১)
১৮. রাম (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২২)
১৯. বলরাম (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২৩)
২০. কৃষ্ণ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২৩)
২১. বুদ্ধ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২৪)
২২. কল্কি (ভাগবতপুরাণ ১:৩:২৫)
.
.
এই ২২ অবতার ছাড়াও উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী অংশে আরও তিনজন অবতারের কথা উল্লেখ আছে :
১. প্রশ্নিগর্ভ (ভাগবতপুরাণ ১:৩:৪১)
২. হয়গীব (ভাগবতপুরাণ ২:৭:১১)
৩. হংস (ভাগবতপুরাণ ১১:১৩:১৯)
কল্কি অবতারের বর্ণনা দেওয়ার পর ভাগবতপুরাণ ১:৩:২৬ শ্লোকে ঘোষিত হয়েছে যে, এ সকল অবতার ছাড়াও বিষ্ণুর আরও অসংখ্য অবতার আছে।
তাহলে এগুলি অবতার থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র শ্রীরাম-কে নিয়ে এতো মাতামাতি কেনো ?
অথচ দ্বৈত দর্শনের প্রবক্তা মাধবাচার্যের মতে, “বিষ্ণুর সকল অবতার শক্তি ও অন্যান্য গুণে একে অপরের সমান। তাঁদের উচ্চনিচ ক্রম নেই। তাঁদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি করা মহাপাপ।” তাহলে কেনো শুধু ‘জয় শ্রীরাম’ ??
তৃতীয়ত, কথিত এই হিন্দুধর্মের অনুসারীগণ প্রধানত পাঁচটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত : বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, গাণপত্য ও স্মার্ত। এ ছাড়াও বর্তমান হিন্দুরা বহু দল-উপদল, শাখাউপশাখায় বিভক্ত। এর মধ্য হতে শ্রীরাম মূলত বৈষ্ণব দর্শনগত বিষ্ণুর অবতার কিন্তু কথা হল যে সকল হিন্দুরা অবৈষ্ণব তাঁরা কেনো ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য হবেন ? বিশেষ করে যেসমস্ত হিন্দুরা ‘অবতার’বাদে বিশ্বাসী নয় বরং নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী (যেমন, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা প্রবর্তিত আর্যসমাজ হিন্দুরা, রাজা রামমোহন রায় দ্বারা প্রবর্তিত ব্রহ্মসমাজ হিন্দুরা, শঙ্করাচার্যের দশনামী সমাজ হিন্দুরা) কেনো ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য হবেন? আর স্বয়ং অবতারবাদী গৌড়ীয় বৈষ্ণব (যেমন ISKCON) ইসলামধর্মের শেষ প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সা:) সাহেব-কেও একজন সাক্ষাৎ অবতার বলে বিশ্বাস করেন, তাহলে কেনো শুধু শ্রীরাম-কে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি ??
চতুর্থতম, গীতার ৪ অধ্যায়ের ৭-৮ শ্লোক অনুযায়ী যুগোপযোগী অবতার এসেছেন আর হিন্দুধর্ম অনুযায়ী যুগ হল চারটি এবং শ্রীরাম হল দ্বাপরযুগ অবতার আর এখন কলিযুগ চলছে।
তাহলে কোন স্বার্থে দ্বাপরযুগ অবতার শ্রীরামের নিয়ে এতো মাতামাতি ??
কলিযুগের অবতার শ্রীশ্রী গৌতম বুদ্ধ-কে নিয়ে নয় কেনো ? হয়ত এজন্যই যে এই নবমতম অবতার গৌতম বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যবাদী এই মেকি গেরুয়াবাদীদের বিরোধীতা করেছিলেন তাই। কিন্তু যে শাস্ত্রীয় বচন শ্রীরাম-কে অবতার বলেছে সেই শাস্ত্রকার’ই কিন্তু গৌতম বুদ্ধ-কে অবতার বলেছেন। আর যতগুলি হিন্দু শাস্ত্র গৌতম বুদ্ধ-কে অবতার বলেছে হয়ত ততগুলি শাস্ত্র কিন্তু শ্রীরাম সম্পর্কে বলেনি !! যেমন, হরিবংশ-পুরাণ ১:১৪, বিষ্ণু-পুরাণ ৩:১৮, ভাগবতপুরাণ ১:৩:২৪, ২:৭:৩৭, ১১:৪:২৩, গরুড়পুরাণ ১:১, ২:৩০:৩৭, ৩:১৫:২৬, নারদপুরাণ ২:৭২, লিঙ্গপুরাণ ২:৭১, পদ্মপুরাণ ৩:২৫২, ব্রহ্মান্ডপুরাণ ১:৩:২৮, কল্কিপুরাণ ১০:২৯, বরাহপুরাণ ও ভবিষ্যপুরাণ ইত্যাদি বলা হয়েছে যে শ্রীগৌতম বুদ্ধ একজন অবতার।
কল্কি অবতার’কে নিয়ে এতো মাতামাতি নয় কেনো ? হয়ত এজন্যই যে বহু হিন্দু ও মুসলিম পন্ডিতগণ তাঁকে ‘মুহাম্মদ’ বলে সনাক্ত করেছেন তাই, যেমন শ্রীবেদ প্রকাশক মহাশয়, সুকান্ত ভট্রাচার্য, প্রমুখ মহর্ষিগণ।
পঞ্চমতম, যারা মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে মাতাচ্ছে তাদের জানা উচিৎ যে, শ্রীরাম কিন্তু কোন মুসলিমজাতির সাথে যুদ্ধ করেননি বরং শ্রীরাম কিন্তু রাবণের সাথে লড়াই করেছেন আর আপনারা শুনলে অবাক হবেন যে শ্রীরাবণ একজন শৈব হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন !! যে স্বর্ণ হরিণ মোহে রাম তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন, সেই বৃহত্তম স্বর্ণ লঙ্ক প্রসাদ ত্যাগ করেছিলেন রাবণ শিবভক্তিতে !! যে দেবরাজ ইন্দ্রের ভয়ে দেবতাগণ কম্পিত হতো সেই ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাস্ত করে রাবণপুত্র মেঘনাদ ব্রহ্মা হতে ‘ইন্দ্রজিৎ” উপাধি প্রাপ্ত হন!!
৯৮% হিন্দুগণ তো এটাই জানে না যে শ্রীরাবণ স্বয়ং বিষ্ণুলোকের ভগবতধামের শ্রীবিষ্ণুর রুপময়ী (স্বয়ং বিষ্ণুময়ী) দারোয়ান ছিলেন, যে ভগবৎধাম প্রাপ্তকে বলা হয় মোক্ষ লাভ !!
বৈষ্ণব শ্রীরাম ও শৈব শ্রীরাবণের যুদ্ধটা কিন্তু হিন্দু সাথে হিন্দুর লড়াই ছিলো, যেমনটা মহাভারতের যুগে কৌরব হিন্দুর সাথে পান্ডব হিন্দুর যুদ্ধ ছিলো !! কিন্তু আজ শ্রীরাম-কে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেনো রামের সাথে সংখ্যালঘু সমাজের যুদ্ধ ছিলো !!
কেনো তাহলে এই অযথা ‘জয় শ্রীরাম’ ??
পরিশেষে বলতে হয় সম্পূর্ণ ‘রাজনীতি’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। কারণ ২০১৪ সালে লোকসভার একটু গেরুয়া নীতি ছিলো যে সংখ্যালঘু সমাজ’কে ‘বন্দেমাতরম’ বলতে বাধ্য করার নীতি দ্বারা গেরুয়াকরণ ভোটব্যাঙ্ক বৃদ্ধিকরণ…. কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কিন্তু এই ‘বন্দেমাতরম’ কোন প্রকার ফলদায়ক হচ্ছে না, তাই এখন নতুন নীতি ‘জয় শ্রীরাম’ !! আর এটাই প্রমাণ করেছে ২০১৯, ৬ মে পশ্চিমবাংলায় প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন ভাষণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী’কে ব্যঙ্গ করত বলেন, তাঁর পক্ষ হতে মমতা দিদি’কে জয় শ্রীরাম !!
এই একই দিনে পশ্চিমবঙ্গের ধনেখালিতে বিজেপি প্রার্থী লকেট চ্যাটার্জী জনতা’কে শাসিয়ে বলেন :
‘বলা যাবেনা বন্দেমাতরম,
বলতে হবে জয় শ্রীরাম !!”
– তুহিন গাজী