ইন্দ্রানী গুহ, কোলকাতা : ১৬ই নভেম্বর ২০২২-এ তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে কোলকাতা রঙ্গশীর্ষ আয়োজিত একটি নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। “ভাসান” – মনোজিৎ মিত্র পরিচালিত একটি শ্রমসাধ্য কারুকাজ করা নাটক। নাটকটি লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য এবং ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল বার্কলে বেকেটের বিভিন্ন রচনাগুলির একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যপূর্ণ সংকলন যার নাট্যরূপ দিয়েছেন অর্পিতা দাশগুপ্ত। আবহ ও পোশাক ভাবনা পৃথা ভট্টাচার্য। সহযোগিতায় ঈশান, চিরঞ্জিত ও কৃষ্ণা ভট্টাচার্য।
কথায় আছে “বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন”। সেই কথা সত্য ধরে নিয়ে অনায়াসে বলা যায়, বাংলা থিয়েটার নামক সিন্ধুর গভীরতা ঠিক কতটা তা “ভাসান” নামক বিন্দু দর্শন করলেই অনুমান করা যায়। ছোট্ট নাটক, কিন্তু কি বিশাল ব্যপ্তি তার। না প্রয়োজন মঞ্চের, না প্রয়োজন আলোর, না প্রয়োজন অপ্রয়োজনীয় জিমন্যাস্টিকের, শুধু মনন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু সংলাপ আর অভিনয়। এই দুটি নিয়েই “ভাসান” ভাবতে বাধ্য করবে আপনাকে।
প্রাথমিকভাবে, আমার কাছে মনে হয়েছিল যে আমি কমেডির আভাস দিয়ে একটি হালকা-হৃদয় অভিনয় দেখতে চলেছি। ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল আজকের পৃথিবীর প্রকৃত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবির একটি অংশ। “ভাসান” আমাদের মূল্যবোধের ‘বিসর্জনের’ বিষণ্ণ সত্যকে প্রতিফলিত করে; আমরা ছোটবেলা থেকেই যে মূল্যবোধগুলি বুঝতে এবং আত্মস্থ করতে শুরু করি এবং সেগুলির নাম রাখি নৈতিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, দয়া, সহানুভূতি, দানশীলতা ইত্যাদি। অত্যাশ্চর্যভাবে সমাজ এখন বিবর্তিত হয়ে এমন লোকেদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে যাদের কাছে এসবের কোনো মানে নেই। পুরুষের অতৃপ্ত লোভ, একে অপরের প্রতি শত্রুতার কলেবরে পরিণত করেছে। আমরা এমন একটি জায়গায় বাস করি যেখানে একটি নবজাতক, যদি সে একটি মেয়ে হয়, তবে তার ভাগ্য আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়।
মনোজিৎ এবং পৃথা উভয়ের অসাধারন পারফরম্যান্স ও অর্পিতা দ্বারা লিখিত যত্ন সহকারে নির্মিত স্ক্রিপ্টের অস্ত্রাগারে সজ্জিত এই নাটক মানবজাতির একটি কুৎসিত চেহারা এবং নৃশংসতায় পূর্ণ সমাজকে দেখানোর জন্য একটি জোরালো প্রচেষ্টা করেছে। পৃথা এবং মনোজিৎ-এর অসামান্য অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাকে বললে ভুল হবে, সেখানে উপস্থিত সকল দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে তাদের অভিনয় মঞ্চে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিকের অবক্ষয় কি ভাবে চারিদিক ছেয়ে যাচ্ছে, আর তার শিকার আমরা আমাদের মত সাধারণ কিছু মানুষ। এই ভাবেই আমাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আর চোখের সামনে এই ভাসান হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নিষ্পাপ জীবন ও সরলতা। নাটকের অন্যতম প্রধান কাজ, দর্শককে বিবেক নামক আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, মাত্র ত্রিশ মিনিটের “ভাসান” অবলীলায় সে কার্য সম্পন্ন করে। বলিষ্ঠ নাটক। সুযোগ পেলে অবশ্যই দেখে নেবার আবেদন রইল।