প্রতিবেদন, অয়ন বাংলা,:- জন্মেছি সত্তরের মাঝামাঝি। কংগ্রেস শাসন আমার দেখা হয়নি। দেখেছি বামফ্রন্ট। আমার দারিদ্রপীড়িত শৈশব, না-পাওয়ার কৈশোর আর রুটিরুজির ধান্দায় ঘুরে বেড়ানো যৌবনতরী ধাক্কা খেয়েছে বামফ্রন্টের প্রতিটি ঘাটে। সুক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতার সরলীকরন আমি দেখেছি আমার জীবন দিয়ে।
আমার সাংসদ ছিলেন হান্নান মোল্লা। বামপন্থী পরিবারে জন্মেছি। ছোটবেলাতেই লালঝাণ্ডা হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন বাবা। অবোধ বালক মিছিলে হাঁটে। মিছিলের শ্লোগানে গলা মিলিয়ে বলে, ‘উপরে আল্লাহ্, নিচে হান্নান মোল্লা’। ভোটের দিন দায়িত্ব ছিল দাদিকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার। দাদি চোখে আবছা দেখে। অফিসারের করুণায় দাদির ভোট দিতাম আমি। দাদি হাতে কালি লাগানোর সময় সবার সামনে আমাকে নির্দেশ করত, ‘ভাই, মুই কিন্তু কেস্তেয় ভোট দোব’। দাদি, বাম আদর্শ নিয়েই আশ্রয় নিয়েছে কবরে।
আমার প্রথম ধাক্কা কলেজ পেরিয়ে। ছোটবেলার অবোধ আর ছিলাম না। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার মত বোধ হয়েছিল। তাই, কলেজে কোনো দলের মিছিলে আর পা রাখা হয়নি। ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু নেতাদের সামনে নতমুখে দাঁড়ানোর দায় দেখাইনি। অতএব আমার কিছু হয়নি। হবার ছিলও না। ততদিনে বুঝে গেছি আমি নিজেকে যতই মানুষ বলেছি, মানবতাকেই আমার ধর্ম বলেছি আমার পিঠের মাঝ বরাবর সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুসলমানী তকমা। তাই, চাকরি প্যানেলে এক নম্বরে থাকা সুবিদ আবদুল্লাহ্ নামের স্থানে দশ নম্বরে থাকা গৌতমের নাম বসে যায়। কাজটি সম্পন্ন করেন আমার প্রিয় সাংসদ হান্নান মোল্লা। পরে পেশা সূত্রে আরও জানলাম, এই প্রবণতা রাজ্যজুড়ে। কংগ্রেস আমলের সাড়ে ৬ শতাংশ মুসলিম চাকরি নেমে এসেছে আড়াই শতাংশে। ব্লক স্তর থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত কোনো মুসলিম নেতা নেই। ৯০ শতাংশ মুসলিম প্রধান ব্লকেরও পার্টির নেতা হিন্দু।
২০০৮ সাল। পঞ্চায়েত ভোটে প্রথম ভরাডুবি সিপিএমের। সেই প্রথম জেলাপরিষদ সভাধিপতি পেল মুসলিম। সেই সঙ্গে অনেকগুলো পৌরসভার চেয়ারম্যান হল মুসলিম। ২০১১ সাল। সাড়ে তিন দশকের সুক্ষ্ম ও সুপ্ত সাম্প্রদায়িক দল সিপিএমের সমাপ্তি। তৃণমূলী নমনীয়তায় ব্লক থেকে জেলাস্তরের পার্টি সভাপতি হলেন মুসলিম। সেই প্রথম মুসলমানরা আইডেনটিটি ক্রাইসিস থেকে বেরনোর সুযোগ পেল। কিন্তু ততদিনে দলবদল শুরু হয়েছে। রাম মনোভাবের বাম ঢুকে পড়েছে তেরঙ্গা পতাকার তলে। দিদিকে কব্জা করে নতুন কৌশলে মুসলিম শোষণের নয়া কৌশল তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের উৎসব অনুষ্ঠানে নেতার উপস্থিতি ঘটিয়ে তাদের কাছের মানুষ করে তুলে সমস্যার মূল কেন্দ্র বামফ্রন্টীয় ঘেরাটোপে আবারও বেঁধে ফেলা হয়। নেত্রী তা বুঝতে পারেননি।
২০১৯ সাল। আবারও পালাবদল। এই প্রথম বাংলার মুসলমানরা এবার সবকটি আইডেনটিটি হারানোর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। দিদি হয়তো আর বাঁচাতে পারবেন না। খেলা হাতের বাইরে চলে গেছে। এখন উপায় কি?