প্রতিবেদন ,ডাক্তার ইয়ার আলী ,অয়ন বাংলা :- সবার লিখালিখি দেখে আমারও কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে!
১০ ই জুন সন্ধ্যা থেকে যে আন্দোলন ও প্রতিবাদ দাবী দাওয়ার হিড়িক চলছে রাজ্যজুড়ে, সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে, পেরিফেরাল কিছু কিছু হাসপাতালে— তাতে রোগীদের ক্ষতি হচ্ছে তো বটেই, বরং ডাক্তার-রোগীর যে সহানুভূতি,ভালবাসা,শ্রদ্ধা-ভক্তির সম্পর্ক সেটাও অনেকাংশে তলানিতে ঠেকছে!
আজকে আপনারা যে সমস্যা দেখছেন, যে বিপ্লবের অগ্নুস্ফূরন দেখছেন তা কিন্তূ হঠাৎ করে হয়নি! এর সূত্রপাত অত্যন্ত সূক্ষ ও গভীর৷
সমস্ত সরকারী হাসপাতালে স্বাস্থ্য সম্পর্কীয় সমস্ত পরিষেবা যখন সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেওয়া হল, তখন জনসাধারণ খুবই খুশী ও আপ্লুত হল৷ হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ ডাক্তারগণও খুশী ৷ গরীব দুঃস্থ রোগীদের জানভরে প্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে চিকিৎসাটা দিতে পারা যাবে! দুরমুড় করে অনেক মেডিক্যাল কলেজ হল, সুপারস্পেসালিটি হাসপাতাল হল, SNCU,ICU প্রভৃতি অনেককিছু হল৷ জনসাধারনের মন জয় করা গেল৷ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ও উন্নতি হল৷ খুবই ভাল৷ কিন্তূ, সমস্যাটা শুরু হল বেশ কিছুদিন পর!
কীভাবে?
হাসপাতালে এমনিতেই দু দশক আগের পরিসংখ্যান ও জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রাইমারী, ব্লক, রুরাল, মহকুমা হাসপাতালের বেড সংখ্যা, ডাক্তার সংখ্যা,নার্স সংখ্যা জিডিএ সংখ্যা ও অন্যান্য রিসোর্স এর স্টান্ডার্ড নির্ধারিত মান অনুযায়ী ম্যান পাওয়ার লাগানো হয়৷ কিন্তূ, অত ডাক্তার কয়? তাই ৮ এর জায়গায় ৩—৫ জন মিলে অতিরিক্ত ডিউটি করে হাসপাতাল সামলাচ্ছিলেন মানব সেবা ও মানবিকতার সৌজন্যে৷ এদিকে, বছর বছর জনসংখ্যা বাড়ছে, অথচ স্টান্ডার্ড ম্যানপাওয়ারের সংখ্যা বাড়ছেনা৷ আবার, ১৯৮০ সালের পর থেকে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, চাষাবাদে অজৈব সার ও রাসায়নিকের ব্যবহার, পোষাক থেকে জুতো প্রত্যেকটিতেই বিভিন্ন ক্যামিক্যালের ব্যবহার, ইউভি রেডিয়েশনের প্রকোপ,বিভিন্ন ভাইরাল এক্সপোজার প্রভৃতি নানা কারণে মানুষের মধ্যে নানাধরণের জটিল ও ক্রনিক রোগের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে! জানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত অটোমোবাইলের ব্যবহার ও সামাজিক মানবতাবোধের অভাবে সড়ক দূর্ঘটনা ও মানুষে মানুষে মারমিটের সংখ্যাটাও বহুগুণ বেড়ে যায়৷ ফলে, সর্বদিক থেকে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তেই থাকে৷ অপর্যাপ্ত ডাক্তাররাই অত্যন্ত সহনশীলতার সাথে, ছেলে বউ বাড়ী ছেড়ে দিনরাত মানব সেবাই নিজের সময়গুলি ব্যয় করে দেয়— অন্যের অসুস্থতাকে দূর করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে৷ এটা চলতে থাকল৷ নতুনকরে ডাক্তার নিয়োগ করে চাপ কমানোর চেষ্টা করা হল৷ কিন্তূ, সরকারী চাকরীর তুলনাই বেসরকারী হাসপাতালে বা প্রাইভেটে কম পরিশ্রম ও টেনশনে ঢের ইনকাম—বিধায় অনেকেই সরকারী হাসপাতালে জয়েনই করেন না৷ ফলতঃ যে গুটিকয়েক অপর্যাপ্ত ডাক্তার সরকারী হাসপাতালে থাকল—তাদের তো নাকানি চুবানী অবস্থা!
স্বভাবতই মনের মত সকলকে দেখে শুনে, টিপে টুপে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়না৷ টানা মেন্টাল প্রেসার এ অধিকাংশ সময় অনেক ডাক্তারই বিনম্রতা ও ভদ্র ব্যবহারে অপারগ হয়ে উঠেন রোগী বা রোগীর লোকজনের সাথে৷
ফলে, ক্রমশঃ ডাক্তারগণ রোগীর পরিজনদের কাছে হয়ে উঠেন খারাপ , বদমেজাজী৷
ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে সবরকম স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে— সরকারি ঘোষনা ও প্রচারে গরীব বড়লোক সকল রোগীর হুড়মুড়িয়ে ভিড় জমে যায়৷ কার্যতঃ ডাক্তারদের পক্ষে পরিষেবাটা ১০০% দেওয়া দূর্গম ও অসম্ভব হয়ে উঠে৷ তথাপি, হাসপাতালের সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বা নিরাপত্তা কোনটাই সঠিকভাবে করা হয়ে উঠেনি৷ এদিকে, সবজান্তা গামছাওয়ালা—গোছের কিছু দুষ্ট লোকের উপদ্রব বেড়ে যায়৷ তখন— চিকিৎসা বা রোগীর কিছু হলেই —মার সালা ডাক্তারকে! ভাংচুর কর সব!
সরকার বলছে, সব ফ্রি! আর এরা পরিষেবা দিচ্ছেনা! সালারা কাটমানি করছে বা শয়তানি করছে!
ব্যস! শুধু এইটুকু মানসিক পরিবর্তনে শুরু হয়ে গেল— ডাক্তার রোগীর পরিজনদের ঝুঝুধান খেলা৷
ডাক্তারের অবস্থা শাঁখের করাতের মত! চাইলেও ভাল পরিষেবা দিতে পারছেনা৷ আবার খামতি হলেই পাবলিকের গণপিটুনি!!
এরকমই এক স্লো মেন্টাল ওয়াশিং এর একটা পর্ব ছিল— NRSMCH.
আমি নিজেই নীলরতনের ছাত্র আবার ইমার্জেন্সিতে এক বছর হাউসস্টাফ ছিলাম৷ সেই হিসাবে, ওখানে কী প্রেসার যায়— তা আমার খুবই ভালভাবে জানা৷
তাহলে, যে সূক্ষ ও গভীর সমস্যা থেকে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কে চিড় ধরল—
১) অপর্যাপ্ত ম্যান পাওয়ার বা ডাক্তার
২) অপরিমিত ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা গঠণগত গুণ
৩) নিরাপত্তার বলয়ের অনুপস্থিতি বা অপর্যাপ্ততা
৪)অতিরিক্ত ডিউটি
৫)মানুষের মানবীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের ঘাটতি
৬) সরকারীভাবে সম্পূর্ণ ফ্রি চিকিৎসা
৭)পাবলিক হেলথ্ এর জন্য থ্রেটনিং — অজৈব সার বা কীটনাশক এর ব্যবহারে অবহেলা বা অবজ্ঞা৷
৮)নেশাদার দ্রব্যের অবাধ বিক্রি সরকারি মদদে
৯) জনগণের বেসিক চাহিদাকে রাজনীতিকরণ৷
১০)জনগণকে মিডিয়া বা সরকার— ডাক্তারের অন্তর্নিহিত ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে ডাক্তারের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া৷
এই আন্দোলন যেমন যৌক্তিক, তেমনি রোগীর পরিষেবা দেওয়াটাও মানবিক৷ তাই, আন্দোলন চলবে কাঙ্খিত দাবী আদায়ের জন্য৷ কিন্তূ, রোগীর পরিষেবাও চলবে মানবিক মূল্যবোধের জন্য৷কিন্তূ, সমস্যাটা অন্য জায়গায়— ডাক্তারদের সমস্যাগুলিকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেরকম কোন আমলই দিচ্ছেন না— বহুদিন থেকে৷ ফলতঃ আল্টিমেটাম পথ হিসাবে, জরুরী পরিষেবা ছাড়া অন্যসকল স্বাস্থ্য পরিষেবা না দেওয়ার মাধ্যমে যে দাবী দাওয়া চাওয়া হচ্ছে — তা দ্রুত নিষ্পত্তি করা আবশ্যিক! নতুবা, এর জল অনেকদূর গড়াবে৷ আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে এই ব্যাপারে দ্রুততার সাথে সমাধান করার জন্য করজোড়ে নিবেদন ও অনুরোধ করছি৷ তাতে, সকলেরই মঙ্গল হবে৷
জয় হিন্দ! জয় বাংলা!
জয় NRSMCH!