মুর্শিদাবাদ: মুসলমানদের জন্য ডোবেনি অধীর-সেলিম জুটি

Spread the love

 

*মুর্শিদাবাদ: মুসলমানদের জন্য ডোবেনি অধীর-সেলিম জুটি*

– ভাস্কর গুপ্ত

বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে ইউসুফ পাঠানের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বহরমপুরের পাড়ার রক বা চায়ের দোকান বা রাস্তার মোড়, সব জায়গায় একটা কথাই ভাসতে শুরু করে – এবারে সব মুসলমান ভোটার অধীরকে ছেড়ে পাঠানকে ভোট দেবেন আর অধীর হেরে যাবেন। অবশ্যই এ আলোচনা হিন্দুদের মধ্যে, কারণ বহরমপুর হিন্দুপ্রধান শহর, যদিও মুর্শিদাবাদের প্রায় ৭০% মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এখন যখন অধীর সত্যিই হেরে গেছেন, তখন সবার মুখে একই কথা – ‘যা ভেবেছিলাম তাই। মোল্লাগুলো টুপি দাড়ি দেখে সব ভুলে গিয়ে অধীরের সাথে বেইমানি করল।’ কিন্তু সত্যিই কি তাই? না, একদমই নয়। বরং যারা এই কথাগুলো বলছে, সম্ভবত তারাই অনেকে অধীরের হাত ছেড়ে দিয়েছে।
২০১৯ সালে বহরমপুর লোকসভায় মোট ভোট পড়েছিল ১২,৯৯,৯৯৭ আর ২০২৪ সালে মোট ভোট পড়ে ১৩,৭৭,২৮৫। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার ৭৭,২৮৮টি বেশি ভোট পড়েছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভাজন একইরকম থাকলে সকলেই কিছু ভোট বেশি পেত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তৃণমূলের ভোট সামান্যই বাড়ল – মাত্র ১৪,১০৬। বিজেপির ভোট বাড়ল অনেকখানি – ২,২৮,৮৪৭। আর কংগ্রেস প্রার্থী অধীরের ভোট অনেকখানি কমে গেল – ১,৫১,৬১২। শতাংশের হিসাবে দেখলে তৃণমূলের ভোট সামান্য হলেও কমেছে – ৩৯.২৬% থেকে হয়েছে ৩৮.০৮%। অধীরের ভোট ৪৫.৪৭% থেকে কমে হয়েছে ৩১.৯১%। অর্থাৎ কমেছে প্রায় ১৩.৫৬% বিন্দু। অন্যদিকে বিজেপির ভোট ১১% থেকে ২৭% হয়ে গেছে। অর্থাৎ ১৬% বিন্দুর বৃদ্ধি। এর থেকে একটা সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে অধীরের ভোট অনেকটাই চলে গিযেছে বিজেপির দিকে, তৃণমূলের দিকে নয়। এরা যে কেউ মুসলমান ছিল না, একথা আর বলে দিতে হয় না। অর্থাৎ হিন্দু ভোটাররাই অধীরকে ডুবিয়েছে। এমনকি তৃণমূলেরও কিছু ভোট চলে গিয়েছে বিজেপির দিকে।
মোদ্দাকথা, হিন্দু ভোট বিজেপির পক্ষে সংহত হওয়ার ফলেই অধীরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যার প্রায় ৩৭% হিন্দু। সেই হিসাবে যা ভোট পড়েছে তার মধ্যে প্রায় ৫,১০,০০০ হিন্দু ভোট। এই হিন্দু ভোটের প্রায় ৭৩% পেয়েছে বিজেপি। তবে হিন্দু ভোটের বিজেপির দিকে একজোট হওয়ার ঘটনা শুধু বহরমপুরেই নয়, জেলার অন্য দুই লোকসভা কেন্দ্র – জঙ্গিপুর আর মুর্শিদাবাদেও হয়েছে। জঙ্গিপুরে বিজেপি পেয়েছে ৩,৪০,৮১৪ ভোট। জঙ্গিপুরে জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% হিন্দু, সেই হিসাবে এই নির্বাচনে হিন্দু ভোট পড়েছে প্রায় ৪,৮০,০০০ মত। অর্থাৎ বলা যায়, হিন্দু ভোটের প্রায় ৭১% বিজেপির দিকে সংহত হয়েছে। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি পেয়েছে ২,৯২,০৩১ ভোট। এই লোকসভা কেন্দ্রে জনসংখ্যার প্রায় ২৯% হিন্দু। সেই অর্থে এই নির্বাচনে হিন্দু ভোট পড়েছে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ। অর্থাৎ হিন্দু ভোটের প্রায় ৬৫% বিজেপির দিকে গেছে।


এখানে বলে রাখা ভাল, জনসংখ্যায় হিন্দুদের সংখ্যা হিসাবে যা বলা হচ্ছে তা আনুমানিক, কারণ ২০১১ সালের পরে আর জনগণনা হয়নি। তাছাড়া লোকসভা ও বিধানসভার এলাকা অনুযায়ী জনবিন্যাসের হিসাব পাওয়া যায় না। সমস্ত গ্রামের তথ্য দিয়ে তা নির্মাণ করা অনেক সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। তাই ব্লকের জনসংখ্যার ভিত্তিতেই এই হিসাব। লোকসভার এলাকায় এ কাজ করা খুব কঠিন না হলেও বিধানসভা এলাকায় করা আরও মুশকিল। কারণ ব্লকের সীমানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিধাসভার সীমানার সঙ্গে মেলে না। যা-ই হোক, বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের সমস্ত বিধানসভা এলাকায় হিন্দু জনসংখ্যার অংশ ও সেখানে হিন্দু ভোটের অংশ হিসাবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটেরও হিসাব করা হয়েছে। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বহরমপুর ও বড়ঞা ছাড়া সমস্ত বিধানসভা ক্ষেত্রেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু। যদিও বড়ঞাতে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যা সামান্যই বেশি। নওদা বিধানসভায় হিন্দুদের সংখ্যা মাত্র ২৫%, অন্যান্য বিধানসভায় তা ৩১%-৩৭% এবং বহরমপুরে প্রায় ৬৭% (সারণি দ্রষ্টব্য)।
হিন্দু ভোটে বিজেপির অংশ দেখলে দেখা যাচ্ছে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৭৩% হিন্দু ভোট বিজেপির পক্ষে সংহত হয়েছে (ধরা হয়েছে অহিন্দু ভোট বিজেপিতে যাওয়ার সংখ্যা নগণ্য)। তবে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে অনেক বেশি হিন্দু ভোট বিজেপির পক্ষে সংহত হয়েছিল, তবুও বহরমপুর ছাড়া আর কোথাও বিজেপি জিততে পারেনি। মজার ব্যাপার হল, এই বহরমপুরে কিন্তু সংহত হওয়ার মাত্রা ছিল সব থেকে কম – ৬৭%। সামগ্রিকভাবে বহরমপুর লোকসভা এলাকায় সংহত হওয়ার মাত্রা ছিল ৮৫%। সব থেকে বেশি ছিল ভরতপুরে – ৯১%। রেজিনগর ছাড়া সব জায়গায় ছিল ৮০ শতাংশের বেশি, রেজিনগরে ছিল ৭৭%। অথচ ২০২৪ নির্বাচনে এই রেজিনগরেই হিন্দু ভোট সংহত হওয়ার মাত্রা পৌঁছল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে – ৮১%। সর্বোচ্চ ছিল নওদায় – ৮২%। ২০২৪ সালে একজোট হওয়ার সর্বনিম্ন মাত্রা বহরমপুরে – ৫৫%। অন্যান্য সব জায়গাতেই হয়েছে ৭০ শতাংশের বেশি।
প্রায় ৭৩% হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে যাওয়ার পর যে ২৭% পড়ে রইল, তা কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে কীভাবে ভাগ হল তা বলা সহজ নয়। ঠিক তেমনি মুসলমান ভোট কীভাবে তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যে ভাগ হল, তা বলাও বেশ কঠিন। কারণ এই ভোটগুলি কোন দলে নগণ্য পরিমাণে গিয়েছে তা বলা যাবে না। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে যখন বিজেপির পক্ষে হিন্দু ভোটের ঢল নেমেছে তখন সেই প্রবণতাকে অগ্রাহ্য করে অন্য দলে কেউ ভোট দিলে নিশ্চয়ই কিছু জোরালো কারণ থাকবে। সেরকম জোরালো কারণ সৃষ্টি করা কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তৃণমূলে থাকার সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সুযোগসুবিধা পাওয়ার ব্যাপার জড়িয়ে আছে, আবার পঞ্চায়েতগুলির বেশিরভাগই তৃণমূলের দখলে। হিন্দুপ্রধান এলাকায় তৃণমূল একদমই ভোট না পেলে তৃণমূলের প্রধান, উপপ্রধান, সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষরা তাঁদের পদ হারাতে পারেন, তাই তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই ওই অবশিষ্ট হিন্দু ভোটের সিংহভাগই যে তৃণমূলে গিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম।
অধীর হেরেছেন প্রায় ৮৫,০০০ ভোটে। প্রাপ্ত হিন্দু ভোটের ব্যবধান ১৫%-১৬% বিন্দু হলেই এই ব্যবধান তৈরি হতে পারে। বড় অংশের বুথে হিন্দু, মুসলমান দুই ধরনের ভোটারই আছে। কোনো কোনো বুথে শুধুই হিন্দু বা শুধুই মুসলিম ভোটার আছে। এরকম কিছু ‘হিন্দু’ বুথের ফলাফল দেখলে অনুমান করা যায় যে এই অবশিষ্ট ২৭% হিন্দু ভোটের মধ্যে মাত্র ৫%-৭% ভোটই কংগ্রেস পেয়েছে, তৃণমূল পেয়েছে প্রায় ২০%-২২%। অন্যদিকে কিছু ‘মুসলমান’ বুথের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে মুসলমান ভোট প্রায় সমানভাবে তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। সব মিলিয়ে বড়জোর ৫,০০০-১০,০০০ ভোট এদিক ওদিক হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ হিন্দু ভোটের বিজেপির পক্ষে সংহত হওয়া এবং অবশিষ্ট হিন্দু ভোটের সিংহভাগই তৃণমূলের দিকে চলে যাওয়াই অধীরের পরাজয়ের কারণ।
এবার আসা যাক ২০২১ ও ২০২৪ নির্বাচনে কোন দল বিভিন্ন বিধানসভা এলাকায় শতাংশের হিসাবে কেমন ভোট পেয়েছে তার তুলনায়। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বহরমপুর লোকসভা এলাকার সবকটিতেই কংগ্রেস বেশ ভালভাবেই জিতেছিল। তবে বহরমপুর বিধানসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল প্রায় ৬৯% ভোট আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের ছিল মাত্র ১৯%, অর্থাৎ ৫০ শতাংশের ব্যবধান। ২০২১ সালে কংগ্রেস সব জায়গায় তৃতীয় স্থানে চলে যায় এবং বহরমপুর ছাড়া সব জায়গায় জেতে তৃণমূল। বহরমপুরে জেতে বিজেপি। কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট নেমে আসে ৬৯% থেকে মাত্র ২০ শতাংশে। বহরমপুর ছাড়া আর কোথাও কংগ্রেস ২০ শতাংশের পৌঁছতে পারেনি। বড়ঞাতে তা নেমে আসে মাত্র সাত শতাংশে। সব মিলিয়ে অধীরের জন্য চরম বিপদ তৈরি হয়। তবুও অধীরের হয়ত বিশ্বাস ছিল, তিনি নিজে মাঠে নামলে অনেককিছু বদলে যাবে এবং মানুষ ওঁকে খালি হাতে ফেরাবে না। ২০২৪ সালে অধীর হেরে গেলেও, একথা প্রমাণিত হয়েছে যে ওই বিশ্বাস অমূলক ছিল না।
২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে বহরমপুর লোকসভা এলাকায় কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল মাত্র ১৫%, ২০২৪ সালে অধীর টেনে তুলেছেন ৩২ শতাংশে। বিজেপির ভোট নেমে গেছে ৩২% থেকে ২৭ শতাংশে, আর তৃণমূলের ভোট নেমে ৫০% থেকে ৩৮ শতাংশে। কিন্তু লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হল, বিজেপির ভোট কমল মাত্র ৫% আর তৃণমূলের ভোট কমল ১২%। অর্থাৎ একথা একেবারে স্পষ্ট, যে হিন্দু ভোট কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে চলে গিয়েছিল তার খুব বেশি ফেরেনি, অধীর নিজে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও। আর এও স্পষ্ট, যে একজন মুসলমানকে প্রার্থী করেও তৃণমূলের ভোট অধীরের দিকে যাওয়া আটকাতে মমতা ব্যানার্জি খুব সফল হননি। স্বাভাবিকভাবেই, শতাংশ বিন্দুর হিসাবে সব থেকে বেশি ভোট বাড়ে বহরমপুরে – ২০% থেকে ৪০%। তবে শতাংশের হিসাবে প্রায় সব জায়গাতেই বাড়ে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে ব্যতিক্রম কিন্তু আবার সেই রেজিনগর। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, তৃণমূলের ভোট শতাংশ সব জায়গায় কমলেও বিজেপির ভোট কমার ক্ষেত্রে একটি বিধানসভা এলাকা ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়াল – সেই রেজিনগর – এখানে বিজেপির ভোট শতাংশ বাড়ল!
কেন রেজিনগর এমন ব্যতিক্রম হয়ে দাড়াঁল? কারণ এই বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যেই পড়ে শক্তিপুর, যেখানে নির্বাচনের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রামনবমীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এর প্রভাব অবশ্যই সব থেকে বেশি পড়ে রেজিনগরে, কিন্তু এর প্রভাবেই হয়ত হিন্দু ভোট খুব বেশি অধীরের কাছে ফেরেনি, তৃণমূলের ভোট অনেকটাই অধীরের কাছে ফিরে গেছে। তাহলে কি একজন মুসলমানকে প্রার্থী করে তৃণমূলের কোনো লাভই হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। এর ফলেই হিন্দু ভোট অধীরের দিকে ফিরে যাওয়া অনেকখানি আটকানো গেছে। অধীর- মহম্মদ সেলিমরা কি একথা বুঝতে পেরেছিলেন? মনে হয় না। তাঁরা প্রচার করে গেলেন – তৃণমূলকে ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকেই ভোট দেওয়া, কারণ রাজ্যসভায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল সোজাসুজি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে ভোটদানে বিরত থেকে পরোক্ষভাবে বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে। বিজেপিবিরোধী মানুষ একথা কতখানি বিশ্বাস করেছেন তা বলা মুশকিল। কিন্তু মুর্শিদাবাদের মাটির বাস্তবতা তথা নির্বাচনী পাটিগণিত বলছে, বিজেপিকে ভোট দেওয়ার অর্থই হল পরোক্ষভাবে তৃণমূলকে ভোট দেওয়া (যা ‘তৃণমূলকে ভোট দেওয়া মানেই বিজেপিকে ভোট দেওয়া’ সিদ্ধান্তের সমার্থক নয়)। কিন্তু বাম-কংগ্রেস এই ব্যাপারটিকে গুরুত্বই দেয়নি, আর তৃণমূল চেয়েছে বিজেপির দিকে ভোট সংহত হওয়া অক্ষুণ্ণ রেখে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে।
বহরমপুর, জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে অধীর, মুর্তজা ও সেলিম হেরেছেন যথাক্রমে ৮৫,০২২; ১,১৬,৬৩৭ ও ১,৬৪,২১৫ ভোটে। এই ব্যবধানগুলি বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের থেকে অনেক কম। অর্থাৎ বিজেপির পক্ষে হিন্দু ভোট সংহত না হলে এঁরা তিনজনেই জিততে পারতেন। মুর্শিদাবাদ জেলার হিন্দুরা, বিশেষত যাঁরা বিজেপিকে ভোট দেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মনে করেন যে তৃণমূল তথা মমতা মাত্রাতিরিক্ত মুসলিমপ্রেমী এবং কংগ্রেস ও তৃণমূল, অথবা সিপিএম ও তৃণমূল – এর মধ্যে বাছতে বললে এঁরা কংগ্রেস বা সিপিএমকেই বাছবেন। তাই এঁরা কৌশলগতভাবে ভোট দিলে বিজেপিকে ঢেলে ভোট না দিয়ে কংগ্রেস বা সিপিএমকে ভোট দিতেন এবং তিনটি কেন্দ্রেই তৃণমূলের হার নিশ্চিত হত। কিন্তু এঁরা মুসলমানবিদ্বেষে অন্ধ হয়ে এককাট্টা হয়ে বিজেপিকে ভোট দিলেন। ফলে তৃণমূলের জয় নিশ্চিত হল।
এঁরা হয়ত মনে করেছিলেন যে যেভাবে তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেসের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে বিজেপি জিতে গিয়েছিল, সেভাবেই এবারও বিজেপি জিতে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, ওই দুই বিধানসভা কেন্দ্রে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৬৭% ও ৫৫%। অর্থাৎ হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু বহরমপুর, জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে হিন্দুদের সংখ্যা ৩৭%, ৩৫% ও ২৯ শতাংশের মত। ফলে একই ঘটনা মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে ঘটা কোনোমতেই সম্ভব নয়। বহরমপুর আরে জঙ্গিপুরে হতে গেলে বিজেপিকে প্রায় ৯৫% হিন্দু ভোট সুনিশ্চিত করতে হবে, একইসঙ্গে মুসলমান ভোটও সমানভাবে তৃণমূল ও কংগ্রেস বা সিপিএমের মধ্যে ভাগ হতে হবে। একসঙ্গে এই দুই ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। তাছাড়া ৯৫% হিন্দু বিজেপিকে ভোট দেবেন আর মুসলমানরা অন্য দুই দলকে তাঁদের ভোট সমানভাবে ভাগ করে দেবেন – তাঁদের এমন বোকা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তাই ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে বহরমপুরে জয় পাওয়া সহজ হবে না আর মুর্শিদাবাদে জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ মুর্শিদাবাদে বিজেপি জিতেছিল মাত্র দু হাজার ভোটে এবং ওখানে হিন্দুদের গরিষ্ঠতা সামান্যই বেশি। পরবর্তী নির্বাচনে মুসলমানরা তাঁদের ভোট ভাগ হতেও দেবেন না।
যা-ই হোক, অধীর ও সেলিম শুধুমাত্র কংগ্রেস ও সিপিএমের প্রার্থীই ছিলেন না, তাঁরা নিজ নিজ দলের কাণ্ডারীও বটে। তাই তাঁদের পরাজয়ও রাজ্য রাজনীতির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে রাজ্যে বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলই একমাত্র শক্তি বলে প্রতিপন্ন হল। তাই আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে ঠেকাতে মুসলমান তথা বিজেপিবিরোধী ভোটাররা তৃণমূলের উপরেই ভরসা রাখার সম্ভাবনা প্রবল হল। তৃণমূল নির্বাচনে নামার আগেই মুসলমান ভোটারদের সমর্থনের দৌলতে ২৫%-২৬% ভোট ঝুলিতে ভরে ফেলবে। কংগ্রেস, বিজেপি ৮%-১০% ভোট নিশ্চয়ই ধরে রাখবে। সেক্ষেত্রে বিজেপির পক্ষে তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে হিন্দু ভোটের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ নিজেদের দিকে টানতে হবে, যা কার্যত অসম্ভব। সেরকম মুর্শিদাবাদে ঘটলেও অন্যান্য জেলায় হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ মুর্শিদাবাদ জেলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। অন্যান্য জেলায় তা ঘটার বিশেষ কারণ নেই।
যে কোনো জায়গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হলে সংখ্যালঘুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। তাই ২০২১ ও ২০২৪ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় যা হয়ে গেল তাতে ক্ষতি হবে হিন্দুদেরই বেশি। তাঁরা মুর্শিদাবাদ তথা বৃহত্তর রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। সর্বোপরি, হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে সংহত হওয়া অবশ্যই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে খুশি করছে না, ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা পারস্পরিক বোঝাপড়া ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে কংগ্রেস বা বামপন্থীদের পুনরুত্থান, কিন্তু তা খুব সহজ হবে না। অধীরের বয়স হয়েছে এবং তিনি কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমর্থন কতখানি পাবেন তারও নিশ্চয়তা নেই। বামপন্থীরা নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে, তৃণমূলের প্রতিও হিন্দুদের আস্থা নেই। হিন্দুরা যদি নিজেদের পথ পরিবর্তন করেন এবং মুসলমানরা যদি এই পরিস্থিতিতেও অধীরের প্রতি ভালবাসা অক্ষুণ্ণ রাখেন, তাহলে অধীরই পারবেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। অথবা যদি কোনো নতুন শক্তির উত্থান হয়, যার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং অধীর না পারলে মুর্শিদাবাদ জেলার ভবিষ্যৎ হয়ত সুখকর নয়।

*চিত্র: ২০২১ বিধানসভা ও ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন বিধানসভা ক্ষেত্রে দলগুলির প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাগত বিশ্লেষণ*

(নাগরিক. নেট)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.