।। “নেহেরুর বৌ” এক অচেনা মেয়ের গল্প ।।
ওয়েব ডেস্ক :- যাবজ্জীবনও আগে ১২ বছরের হত। তারপর অপরাধীকে ক্ষমা করা হত। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতেন অপরাধী। তবে তাঁকে দীর্ঘ ৬০ বছর পরেও কেউ ক্ষমা করে নি। অপরাধ, সাঁওতাল মেয়ে হয়ে ‘বাইরের একটা লোকে’র গলায় মালা দেওয়া। আর সেই ‘বাইরের লোকটা’ হলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। আর সেই অপরাধে, আজও জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দিয়ে ৬ দশক পরেও একঘরে ‘নেহেরুর বউ’। তবে এখন তিনি বেঁচে আছেন কিনা সেখবর কেউ রাখেনি।১৯৫৯-এর ৬ ডিসেম্বর সুইচ টিপে তিনি উদ্বোধন করেন দামোদর নদীর উপর পা়ঞ্চেত বাঁধ। যা ছিল স্বাধীন ভারতের নবজাগরণের একটা ঐতিহাসিক অধ্যায়। ৬০ বছর আগে তাঁর হাতেই উদ্বোধন হয়েছিল পাঞ্চেত বাঁধের। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সে দিন পা়ঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করেন সাঁওতালি রমণী বুধনী মেঝান ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।
বাঁধের কাজ শুরু হতে কাজের সুযোগ পেয়েছিল পুরুলিয়া ঝাড়খন্ড সীমান্তে চারপাশের গ্রামের বেশ কিছু আদিবাসী নারী-পুরুষ। উদ্বোধনের দিন নেহরুকে দেখার জন্য তারাও হাজির ছিল সে দিন। কিন্তু, নেহরুর গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানাবে কে? দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের কর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দায়িত্ব পড়ল রাবণ মাঝির পনের বছরের সাঁওতাল মেয়ে ‘সুন্দরী’ বুধনির উপরl
পাঞ্চেত ড্যামের উপর নেহেরুর গলায় মালা পরিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন বুধনি। নেহরু খুব খুশি। নিজে নন, বাঁধ উদ্বোধন করালেন বুধনিকে দিয়ে। বুধনির হাতেই উদ্বোধন হল পা়ঞ্চেত বাঁধের। উদ্বোধনী বক্তৃতায় নেহরু বললেন, “এই বাঁধই হল টেম্পল অব ডেভেলপিং ইন্ডিয়া”।
খুলে গেল দেশের উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত। আর সেই সঙ্গে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল বুধনীর জীবনের সব দিগন্তই। সাঁওতালি কুমারী মেয়ে কিনা মালা পরাল সমাজের বাইরের এক সাদা চামড়ার লোকের গলায়! এত বড় অপরাধ! বুধনীর আদিবাসী সমাজ তাঁকে ত্যাগ করল। একঘরে করা হল তাঁকে। অপরাধ, ‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর গলায় মালা দেওয়া’।
এক ঐতিহাসিক দিনে চিরতরে পালটে গেল বুধনির জীবন। উদ্বোধনের অনুষ্ঠান শেষে বুধনি বাড়ি ফিরছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার রেশ নিয়ে। যে প্রাপ্তি তার কাছে আশাতীত ছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। বাড়ি ঢোকার আগেই গ্রামের মোড়লরা তাকে ‘তলব’ করল।
কেন? তার বিচার হবে। বুধনি বুঝে উঠতে পারছিল না সে কী অপরাধ করেছে! মোড়লদের মতে তার অপরাধ সে পরপুরুষের গলায় মালা পরিয়েছে! সে অবিবাহিতা। তাদের আদিবাসী সমাজের নিয়ম অনুযায়ী অবিবাহিতা মেয়ে কোনও পুরুষের গলায় মালা পরালে ধরে নেওয়া হয় তারা বিয়ে করল। সে দিক থেকে দেখলে বুধনি তখন নেহরুর স্ত্রী!
কিন্তু নেহরু তো আর সাঁওতাল নন। তাছাড়া তিনি ঘরেও তুলবেন না বুধনিকে। তাই ‘বেজাতে’ বিয়ে করার অপরাধে একঘরে করে দেওয়া হয় বুধনিকে। বহিষ্কৃত করা হয় সমাজ থেকে। তার মুখ দেখবে না সমাজের কেউই। বুধনির নামই হয়ে গেল ‘নেহেরুর বউ’।
১৯৫৯ থেকে ২০২১। সেই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ৬২টা বছর। দামোদর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভারতের ৬০ বছরের ইতিহাস। ২০১৯ এ তাঁর শেষবারের জন্য খবর নেওয়া হয়েছিল। পাঞ্চেত বাঁধ পেরিয়ে, তাঁর বাড়ির পথের সন্ধান করতে গিয়ে অবাক হতে হয়। অটোচালক, দোকানদার, রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষ প্রায় সকলেই বুধনির বাড়ির পথ চেনেন। বুধনির কথা উঠতেই তাঁদের মধ্যে অনেকেরই প্রশ্ন “আপনি কি খবরের লোক; না সিনেমার লোক”?
হঠাৎ এই প্রশ্ন? তারাই জানালেন “খবরের লোকেরা আগে আসত মাঝে মাঝে। চার বছর আগে মুম্বই থেকে একজন সিনেমার পরিচালক বুধনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর বায়োপিক করতে চান। অনেক টাকা অফার করা হয়েছিল বুধনিকে। কিন্তু টাকার অঙ্ক মোটা হলেও বুধনি রাজি হয়নি”। কেন? সে উত্তর অবশ্য তাঁদের জানা নেই।
পরপুরুষের গলায় মালা পরালে বিয়ে হয়ে যায় সে কথা জানতেন না? বুধনি বললেন “সাহেব সুবারা বলেছিল। আমি কী করব! তখন তো আমি ছোট; আমার মাথায় কি বুদ্ধি ছিল? বুদ্ধি থাকলে কি এমন কাজ করতাম? যাদের ছিল তারা তো সব পিছিয়ে গেল”। নেহরু কিছু বলেননি আপনাকে? “কী বলবে ও! শুধু বলেছিল বেটি, তোমার জীবনভর চাকরি রইল”। অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আর দিতে চান না বুধনি। আর পিছন ফিরে তাকাতেও চান না।
বুধনি দামোদর ভ্যালি করপোরেশনের কর্মী ছিলেন। যদিও জীবনভর চাকরি থাকার আশ্বাস পাওয়ার পরও কর্মক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাঁকে। শোনা যায়, বুধনিকে সমাজ ত্যাগ করার পর তিনি সুধীর দত্ত নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় পান। বুধনির একটি মেয়েও হয়। মায়ের সঙ্গে মেয়েরও সাঁওতাল সমাজে ঠাঁই পায়নি।
১৯৬২ সালে ডিভিসির চাকরিটিও চলে যায় বুধনির। কুড়ি বছরেরও পর; ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর হস্তক্ষেপে আবার ডিভিসিতে চাকরি পান তিনি। বাড়িও করে দিয়েছে ডিভিসি। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা গেল তাঁর নাতিকে নাকি সরকার চাকরি দিয়েছে।
রান্না করা থেকে কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার করা নিজের হাতেই সব করতেন ‘নেহেরুর বউ’। কালের নিয়মে সমাজ আজ বদলেছে অনেকটাই। একঘরে হয়ে থাকার নিয়ম শিথিল হয়েছে। কিন্তু যে সমাজ তাঁকে বিতাড়িত করেছিল সেখানে আর তিনি ফিরে যাননি। অভিমানে চাননি তাঁর জীবন নিয়ে সিনেমা হোক।
আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, উৎসব-আনন্দ-সামাজিকতা; সমস্ত কিছু থেকে তিনি নিজেকে ব্রাত্য করে রেখেছিলেন অনেকদিন আগেই। নিজেকে স্বেচ্ছায় ব্রাত্যই করে রেখেছিলেন শহুরে মানুষদের কাছ থেকেও। ঝাড়খণ্ডের গ্রামে সেই ক্ষত নিয়ে কি আজও বেঁচে আছেন ‘বাইরের একটা লোকে’র গলায় মালা দেওয়া সাঁওতালি মেয়ে? যে প্রশ্নের জবাব নেই এখন।
জওহরলাল নেহেরুর পর ইন্দিরা গান্ধী রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন দেশের ক্ষমতা পাবার জন্য লড়ছেন রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। কিন্তু, দীর্ঘ ৬০ বছর লড়াই করার পর এখন ফিরে আসার লড়াই ছেড়ে না ফেরার লড়াই করছেন ‘নেহেরুর বউ’ বুধনি। একদিন এই সমাজ তাঁকে ত্যাগ করেছিল আর আজ এই সমাজকেই পরিত্যাগ করেছে অভিমানী সাঁওতালি মেয়ে।
(এই নিউজ ২০১৯ সালে করা হয়েছিল; বুধনির সঙ্গে; দেখা করার পরে)
Collected
ছবি :- সৌজন্য Google