NPR ই কি NRC এর প্রথম ধাপ?! যাঁকে সন্দেহ হবে শুধু তাঁকেই ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে বলা হবে?

Spread the love

বাসব রায়: নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-র পর ১৯৮৭ এবং ২০০৩ সালে পরিমার্জিত হয়। এর পরেরটা এই লেখায় দরকার নেই। ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব আইনে ১৪(এ) ধারা যুক্ত করে। যেখানে বলা হয়েছে, গোটা ভারতে (এখন কাশ্মীরও) নাগরিকপঞ্জি নবায়ন হবে। এবং, মনে রাখতে হবে, সেটা লোকসভা-রাজ্যসভায় পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। ওই আইনের বলেই তারপর এনআরসি-নিয়ম তৈরি করে সরকার। ২০০৯ সালে মনমোহন সিংহ সরকার এনআরসি-নিয়মে যুক্ত করে ৪(এ) ধারা। যেখানে বলা হয়, অসমের জন্য এনআরসি-র কাট-অব-ডেট ২৪ মার্চ ১৯৭১। এদিকে, অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারাতেও ওই একই তারিখ আগে থেকেই রয়েছে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে। তো অসমে এনআরসি-র একটা পর্যায় শেষ হয়েছে। আরও পড়ুন… এটাই কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যক্তিমানুষের ভবিতব্য!


নাগরিকত্ব আইনে ২০০৩ সালে সংযোজিত অধ্যায়ের ভিত্তিতে যে এনআরসি-নিয়ম তৈরি হয় তাতে বলা হয়েছে, প্রথমে গোটা দেশে হবে পপুলেশন রেজিস্টার। এখন যাকে বলা হচ্ছে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর)। আইনে ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি নেই। ২০১০ সালে এর ভিত্তিতে ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবারের সবার নাম-লিঙ্গ-বয়স প্রভৃতি তথ্য গ্রহণ করা হয়েছিল সরকারের তরফে, তবে মাঝপথে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
ঘটনা হল, ওই এনপিআর নোটিফিকেশন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কয়েকমাস আগেই জারি করেছে। অর্থাৎ এনআরসি-র প্রথম ধাপ গোটা দেশেই শুরু হচ্ছে। ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে এনপিআর-এর কাজ শুরু হবে, থামবে গিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, এটা জনগণনার কাজ নয়, এনআরসি-র প্রথম ধাপ। জনগণনা বা সেনসাস অন্য ব্যাপার। সঙ্গের ছবিটি একটু খুঁটিয়ে দেখলেই টের পাবেন, এনপিআর-এ বাদ দেওয়া হয়েছে অসমকে, এবং একমাত্র অসমকে। আরও পড়ুন… বাঙালি হিন্দুদের বিদেশি সাজাবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি
প্রাথমিকভাবে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য নেওয়া হবে। এবং কারও স্বদেশিয়ানা নিয়ে সন্দেহ থাকলে স্ক্রুটিনির পর নোটিশ দিয়ে তাঁকে বা তাঁর পরিবারের সবাইকে বলা হবে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে। অসমে সবাইকে ধরে নেওয়া হয়েছিল বিদেশি, তারপর সবাইকে প্রমাণ করতে হয়েছে নাগরিকত্ব। এজন্য খরচ হয়েছে মোটামুটি ১৬০০ কোটি টাকা। এখান থেকে সম্ভবত কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা নেবে যে, অসমের মতো অন্যান্য রাজ্যে এনআরসি প্রক্রিয়া হবে না। যাঁকে সন্দেহ হবে শুধু তাঁকেই ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে বলা হবে।
আর তাই টিভিতে আধঘণ্টা ধরে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমোর নানা কথাবার্তা যে মস্ত গোঁজামিলে ভরা, তাতে আর কারও না থাকুক, আমার কোনও সন্দেহ নেই। আবার বলছি, এনপিআর-এর সঙ্গে সেনসাসের কোনও সম্পর্ক নেই। এনপিআর হচ্ছে এনআরসি-র প্রথম ধাপ।
এখানে একটি তথ্য স্মরণযোগ্য যে, গোটা ভারতের ক্ষেত্রে বিদেশি নির্ধারণের কোনও নির্দিষ্ট তারিখ নেই। এর ভিত্তি হবে নাগরিকত্ব আইন।
কথা হল, পপুলেশন রেজিস্টার প্রস্তুতের পর এনআরসি হবে এমনটা আইনে আছে। কিন্তু কাউকে সন্দেহের ভিত্তি কী হবে, সেটা বলা হয়নি কোথাও। এখানেই সরকারের অলিখিত নির্দেশ কিংবা মনোভাব কাজ করে। ভারতের মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে কোন দল সরকারে আছে সবাই জানেন। এবং নাগরিকত্বের ব্যাপারে তাদের কার প্রতি সন্দেহ হতে পারে সেটা মনে হয় ওই দলই এতদিনে সবাইকে বুঝিয়ে ছেড়েছে।
অসমে এনআরসি হয়েছে ‘দ্য সিটিজেনশিপ (রেজিস্ট্রশন অব সিটিজেনস অ্যান্ড ইস্যু অব ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডস) রুলস, ২০০৩’ অনুসারে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে ওই একই নিয়ম প্রযোজ্য, শুধু সেখানে ভিত্তিবর্ষ থাকবে না। নাগরিকত্বের জন্য কী কী নথি গ্রহণযোগ্য হবে আমি শুধু তার তালিকাই দিতে পারি।

ফুটনোট হিসেবে একটু থাক-– কাগজপত্র-টিভি-ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম নেতারা বুক টানটান করে দৃপ্ত স্বরে বলছেন, ‘এনআরসি করতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে করতে হবে’ কিংবা ‘বাংলায় ডিটেনশন ক্যাম্প করতে এলে গুঁড়িয়ে দেব’ প্রভৃতি। আর অসমের ক্ষেত্রে ওই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়েছিল, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অসমে এনআরসি হচ্ছে। সিপিএম এই এনআরসি-তে পূর্ণ সহমত জানাচ্ছে। শুধু আমরা চাই অসমে শুদ্ধ এনআরসি হোক। একজনও প্রকৃত ভারতীয় যেন এনআরসি-তালিকার বাইরে না থাকেন।’
ত্রিপুরার এক ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন যে, অসমের মতো ত্রিপুরায় এনআরসি হোক। ভারতের যে কোনও প্রান্তের মানুষ ওই একই আবেদন করতে পারেন সুপ্রিম কোর্টে যে, গোটা দেশে এনআরসি হোক। এবং সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় দিলে বঙ্গীয় সিপিএম কী বলে সেটা দেখব বলে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেই হবে, অন্য উপায় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.