*NRC হল একটা বোমা। যখন যেখানে পড়বে, আশপাশের সকলকেই আহত করে ছাড়বে …*
— *প্রতিবাদী বাংলা*-র সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে লিখলেন *অনির্বাণ তলাপাত্র*
অয়ন বাংলা,প্রতিবেদন :- আসামে বহু প্রতীক্ষিত NRC তালিকা প্রকাশিত হল গত ৩১শে আগস্ট। বাদ গেল ১৯ লক্ষ মানুষের নাম। BJP-RSS সহ নব্য ও পুরানো গেরুয়া-লাল চাড্ডীদের মনে এখন খুব আনন্দ। ১৯ লক্ষ “বিদেশী” খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আসামে NRC-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরে পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে। এই পাঁচ দিনে প্রায় পাঁচ লক্ষ পরিবারের খবর স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যাঁরা অনায্যভাবে NRC তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। এই সমস্ত পরিবারের মধ্যে যেরকম আসামের মূলনিবাসীরা আছেন, সেইরকমই বহু এমন পরিবার আছেন, যাঁরা চার-পাঁচ পুরুষ ধরে আসামে বসবাস করে চলেছেন। হিন্দুদের রক্ষাকর্তা নরেন্দ্র মোদীর আমলে যে পরিমাণ হিন্দুরা নাগরিকত্ব হারালেন, হিন্দুদের এই মাপের সংকট ভারতের ইতিহাসে মুসলমান শাসনেও কখনও আসে নি। দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি থেকে খেতাবপ্রাপ্ত প্রাক্তন সেনা, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার, সকলেই বাদ পড়েছেন NRC-র চূড়ান্ত তালিকা থেকে। এমনকি যে আসাম আন্দোলনের ফলশ্রুতি আজকের এই NRC, সেই আসাম আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ও শহীদদের পরিবাররাও আজ নাকি “বিদেশী”। আটের দশকে আসাম আন্দোলনে ভূমিপুত্রদের হয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে মৃত্যু হয় মদন মালিকের। বর্তমানে তার নিজের পরিবার অর্থাৎ তার স্ত্রী ও পুত্রের নাম NRC-তে ওঠেনি। কারণ আসাম আন্দোলনে শহীদের তালিকায় “মদন মালিক সরকার”- এই নামের বদলে কেবল “মদন সরকার” – এই নাম উঠেছে আর বাকি সব নথিতে নাম উঠেছে “মদন মালিক”। তাই আসামে ভূমিপুত্র আন্দোলনে শহীদের স্ত্রী ও পুত্রের নামই NRC তে নেই। এরকমই ১৯ লক্ষ বিদেশীর মধ্যে আর একজন বিদেশিনীর কথা বলি।
এই মহিলার জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার ঢাকুরিয়াতে ষাটের দশকে। বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া শেখা কলকাতাতে। ঘটনাচক্রে এনার বিয়ে হয় আসামে বসবাসকারী একজন বাংলাভাষী ব্যবসায়ীর সাথে। সময়ের সাথে এনাদের একটি ফুটফুটে মিষ্টি কন্যাসন্তানও হয়। বছর গড়ায়; বাচ্চা মেয়েটি বড় হয়ে আজ কলকাতায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরতা। চাকুরীরতা যুবতী কন্যাকে সঙ্গ দিতে স্বামী-শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক দূরে এসে ঐ মহিলাও এখন কলকাতায় বসবাস করছেন। এমন সময় সুপ্রীম কোর্টের রায় বেরোল NRC নিয়ে। নিয়মমাফিক নিজের সমস্ত নথিপত্র জমা করলেন তিনি তাঁর স্বামী-কন্যার সাথে। কিন্তু প্রাথমিক খসড়া তালিকাতে কারোর নামই এল না। আবার একবার সকলে আবেদন করলেন। গত ৩১শে আগস্ট, ২০১৯ তারিখে যখন পূর্ণাঙ্গ NRC তালিকা প্রকাশিত হল, তখন দেখা গেল স্বামী ও কন্যার নাম তালিকাতে অন্তর্ভূক্ত হলেও নাম আসেনি তাঁর নিজের। আর তাই আজ ৩১শে আগস্ট, ২০১৯ তারিখে সকাল দশটার পর থেকে উনি রাষ্ট্রের চোখে হয়ে গেলেন বিদেশিনী। না; কোন কানে শোনা, কাগজে পড়া গল্প নয়। এই মহিলার কলকাতায় কর্মরতা একমাত্র কন্যাসন্তান আমারই সহকর্মী। এই মহিলা আমাদের এই দেশেরই একজন বৈধ নাগরিক আমার সহকর্মীর জন্মদাত্রী মা, যিনি এই NRC নামক তুঘলকি সিদ্ধান্তের ফলে আজ থেকে রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়লেন। এই ঘটনা আজ আর কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত পাঁচদিন ধরে একের পর এক এই ধরণের হৃদয়বিদারক খবর একটু একটু করে যেন আমাদের চোখে সয়ে যাচ্ছে।
আসামে NRC তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরে প্রায় চারশো “Foreigners’ Tribunal” গঠন করছে সরকার, যেখানে নাকি এই ১৯ লক্ষের বেশি NRC ছুট মানুষদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আগামী ১২০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে।যদি এই “Foreigners’ Tribunal” কাউকে বিদেশী ঘোষণা করে, তাহলেই নাকি সেই ব্যক্তিকে “Detention Centre”-এ বন্দী করা হবে। এই ভাবে বিপুল সংখ্যক নিরীহ মানুষকে কারারুদ্ধ করা হলে তা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্যতম নিদর্শন। একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রে এই রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য কোনওভাবেই চলতে পারে না। আমরা দেখলাম যে ইতিমধ্যেই এই Detention-এর বিষয় নিয়ে United Nations-ও প্রবল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় জনতা পার্টি আসামে প্রমাদ গুণলেও পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু তারা এখনও পিছু হঠতে রাজি নয়। অথচ এখনও এই বাংলাতে “NRC চাই” বলে রাজ্য BJP-র যে সমস্ত নেতৃত্বরা উদ্বাহু নৃত্য করছেন, তাঁরা নিজেরাও কতজন ঠিকঠাক Legacy Document আর Linkage Document যোগাড় করতে পারবেন, তা কিন্তু তাঁরা নিজেরাও জানেন না। এঁদের অনেকেই NRC নিয়ে বেশ আনন্দে আছেন। এঁরা অনেকেই ভাবছেন যে তাঁরা যুগ যুগ ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, তাই NRC তালিকায় তাঁদের নাম আসবেই; আর বাদ যাবে শুধু সাতচল্লিশ বা একাত্তরে বা তারপরে যাঁরা ওপার বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসতে বাধ্য হয়েছেন, শুধু তাঁরাই। এই ভুল ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আসামে যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের মধ্যেও এরকম বহু মানুষ আছেন, যাঁদের পরিবার গত ১০০ বছর ধরে আসামে বসবাস করছে। আসলে যে প্রক্রিয়াতে এই NRC তৈরী হচ্ছে, সেটাই সম্পূর্ণ ভুলে ভরা। আজকে যদি একাত্তর সালের আগে ভোটার তালিকা থেকে আমার বা আপনার পূর্বপুরুষের সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য (নাম, বয়স, ঠিকানা) বের করতে হয়, তাহলে তা অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ভুল বেরোবে। কারণ সেই আমলে প্রযুক্তিগত ভুলভ্রান্তি অনেক বেশী হত। ফলে এই তথ্যের ভিত্তিতে NRC তৈরী করলে অনেক সঠিক লোকের নামই বাদ পড়বে, যেমনটা আসামে পড়েছে।
আর যাঁরা প্রাণের দায়ে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা অনুপ্রবেশকারী নন; তাঁরা উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তুদের অধিকার আজ এত বছর পরে NRC-র নামে হরণ করা যায় না। যুগ যুগ ধরে যাঁরা পেটের দায়ে এই দেশে এসেছেন, তাঁরা এত বছর ধরে এই দেশে কাজ করে এই দেশেই আয়কর দিচ্ছেন। তাঁদের যদি আজ বিদেশী বলে তাড়ানো হয়, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ভারতীয়দের কি হবে ??? তাঁদেরকেও যদি সেইসব দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন সামলানো যাবে তো ??? যে প্রক্রিয়ায় আসামে NRC তৈরী হয়েছে, তা যে একেবারে ভুলে ভরা, সেই বিষয়ে এখন ভারতীয় জনতা পার্টির কতিপয় সদস্য-সমর্থক ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষের অন্তত কোন সন্দেহ নেই। শুধুমাত্র নামের বা বাড়ীর ঠিকানার বানান ভুলের জন্যও যে কেউ এক লহমায় ভারতীয় থেকে “বিদেশী অনুপ্রবেশকারী” হয়ে যেতে পারে, তা অবশ্য এই NRC-র নামে ছেলেখেলাটা না হলে জানা যেত না।
অন্যদিকে খুড়োর কলের মতন যে সাম্প্রদায়িক এবং অসাংবিধানিক নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬ কে BJP এই রাজ্যের লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তুদের সামনে ঝুলিয়ে রেখে গত লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের ভোটের ঝুলি ভরেছিল, সেই বিলটির আইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ কঠিন। কারণ প্রথমতঃ, এই বিলটি দেশের সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নং ধারার সাথে সম্পূর্ণভাবে বিরোধী। ফলে এই বিল আইনে পরিণত হতে গেলেই এটির বিরুদ্ধে সংবিধান অবমাননার জন্য মামলা হবে এবং অবধারিতভাবে এই বিলটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিল করে দেওয়া হবে। দ্বিতীয়তঃ, আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যবাসীদের প্রথম থেকেই এই বিলটি নিয়ে আপত্তি আছে এবং সেই আপত্তি যে কিভাবে গণপ্রতিবাদে পরিণত হতে পারে, তা গত বছরে বিজেপিসহ গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬-র ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাচ্ছন্ন, সেই বিষয়ে বিশেষ কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
তাছাড়াও প্রশ্ন অবশ্যই উঠছে যে
১| Citizenship Act, 1955 এবং Citizenship (Amendment) Act, 2003 অনুযায়ী
ক) ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী থেকে ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই অবধি ভারতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষকে
খ) ১৯৮৭ সালের ২রা জুলাই থেকে Citizenship (Amendment) Act, 2003 চালু হওয়ার আগে অবধি ভারতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ, যাঁর বাবা অথবা মায়ের যে কোন একজন ভারতের নাগরিক, তাঁদের প্রত্যেককে
গ) Citizenship (Amendment) Act, 2003 চালু হওয়ার পরে আজ অবধি ভারতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ, যাঁর বাবা এবং মা দু’জনেই ভারতের নাগরিক, তাঁদের প্রত্যেককে
দেশের সংবিধান নাগরিকত্ব প্রদান করছে। তাহলে NRC প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামের ১৯ লক্ষ মানুষ, যাদের মধ্যে বহু মানুষই জন্মসূত্রে ভারতীয়, তাদেরকে কিভাবে বেনাগরিক ঘোষণা করা যেতে পারে ???
২| NRC নিয়ে Supreme Court-এর রায় তো শুধুমাত্র আসাম রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য, কারণ এই রায়প্রদানের ক্ষেত্রে আশির দশকের “আসাম চুক্তি” একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কিন্তু দেশের অন্যত্র কোথাও তো এই ধরণের কোন চুক্তি হয় নি। তাহলে কেন সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশে NRC প্রক্রিয়াকে চালু করতে চাইছে ???
৩| ভোটার তালিকা বা আধার তালিকাতে কি দেশের নাগরিকদের কি নাম নেই ??? তাহলে কেন আবার সরকারী অর্থের অপচয় করে পশ্চিমবঙ্গে NRC-র নামে আরেকটি নতুন নাগরিকপঞ্জী তৈরী করবার চেষ্টা হচ্ছে ???
৪| যদি অনুপ্রবেশকারীরা জাল ভোটার বা আধার কার্ড তৈরী করে এই দেশে বসবাস করতে থাকে, তাহলে কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা ও গুপ্তচর বাহিনীকে ব্যবহার করে সেই জাল ভোটার বা আধার কার্ডকে চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা কেন করা হচ্ছে না ??? কেন তার বদলে একটি ভুলে ভরা NRC প্রক্রিয়া চালু করবার কথা বলা হচ্ছে, যাতে কিনা একজন প্রকৃত ভারতীয়র নামও NRC থেকে বাদ যেতে পারে, যেরকমভাবে আসামে ৪২ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে ???
৫| অনুপ্রবেশ আটকাতে BSF যদি ব্যর্থই না হবে, তাহলে BJP-র দাবী অনুযায়ী “কোটি কোটি” অনুপ্রবেশকারী ভারতে আসছে কি করে ??? BSF-এর এই ব্যর্থতার দায় কেন কেন্দ্রীয় সরকার নেবে না ???
সর্বোপরি দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগকে শক্তিশালী ও আঁটোসাঁটো না করে, কেবলমাত্র NRC করে কিভাবে অনুপ্রবেশকে আটকানো সম্ভব ?? NRC তো কোন Sensor নয়, যে সীমান্তে কাঁটাতারের উপরে বসিয়ে দিলেই অবৈধ অনুপ্রবেশকে ধরে ফেলবে। আর BJP-র দাবী অনুযায়ী প্রতিদিন প্রতিঘন্টায় আসামে বা পশ্চিমবঙ্গে যে অবৈধ অনুপ্রবেশ হয়, তাকে আটকাতে যদি NRC করতে হয়, তবে তো প্রতিদিন প্রতিঘন্টায় একটা করে নতুন NRC করতে হবে। একটা আসাম রাজ্যে গত তিন বছর ধরে NRC প্রক্রিয়া চালাতে যে সরকারী অর্থ, শ্রমদিবস এবং জনগণের সময়ের অপচয় হয়েছে, সেই অপচয় কি ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে, এই প্রশ্নের মুখে কিন্তু দেশের সরকারকে পড়তেই হবে, যখন গোটা দেশের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র চরম শোচনীয়।
তাহলে এই পরিস্থিতিতে এখন যদি এই রাজ্যে NRC চালু হয়, সেক্ষেত্রে কি হবে ?? এই রাজ্যের কোটি কোটি মানুষের মনে এই প্রশ্নই ঘুরছে। উত্তর খুব সহজ, অথচ বড়ই ভয়ঙ্কর। এই রাজ্যে NRC হলে আসামে যা ঘটেছে, এই রাজ্যেও তা ঘটবে এবং আরো বড় আকারে ঘটবে। আসামে সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যার মধ্যে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম যদি বাদ পড়ে, তাহলে দশ কোটি জনতার পশ্চিমবঙ্গে NRC-র ফলাফল কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। দেশভাগের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে যে উদ্বাস্তু জনতা এই রাজ্যে এসে থিতু হয়েছেন, বসতি গড়েছেন এবং সর্বোপরি দেশ গঠনে অংশ নিয়েছেন, আজ NRC হলে এই জনতারা যে নতুন করে উদ্বাস্তু হবেন, সেই বিষয়ে তো কোন সন্দেহই নেই, কিন্তু এদের সাথে সাথে যে পশ্চিমবঙ্গের বহু আদি বাসিন্দারাও যে বাদ পড়ে যাবেন, তা আজ আসামের পরিস্থিতি দেখে অনেকেই বুঝতে পারছেন।
কিন্তু তা বলে এইরকম ভাববার কোন কারণ নেই যে BJP-RSS NRC-র সমর্থনে তাদের প্রচার বন্ধ করে দেবে। NRC তালিকা বেরোনোর ঠিক একদিন আগে আমি ছিলাম আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে। সেই আসাম-অরুণাচল প্রদেশ সীমান্ত অঞ্চলে তখনও NRC নিয়ে মানুষ আতঙ্কিত ছিলেন না; বরং একটু আনন্দিতই ছিলেন, কারণ BJP-RSS ঐ অঞ্চলে ক্রমাগত প্রচার করেছে যে, NRC তালিকাতে নাকি বহু সরকারী চাকুরিজীবিদের নাম বাদ পড়বে আর তার ফলে এই আসাম-অরুণাচল প্রদেশ সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসী, যাঁরা কিনা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকারী বঞ্চনার শিকার, তাঁদের জন্য এই NRC নাকি একটা বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে সরকারী চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে। অবাক হচ্ছেন ??? ভাবছেন কিভাবে একই রাজ্যের কিছু মানুষের নাগরিকত্ব হারিয়ে গেলে অন্য কিছু মানুষ এত আনন্দিত হয় ???
এটাই হল BJP-RSS-এর Masterstroke। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ; কিন্তু সেই ব্যর্থতাকে কি মসৃণভাবে NRC-র মাধ্যমে মানুষে মানুষে বিভেদের কাজে লাগানো যেতে পারে, তা এই অঞ্চলে না আসলে প্রত্যক্ষ করতে পারতাম না। একইসাথে আরো একবার প্রমাণ পেলাম যে মিথ্যা ও গুজবের রাজনীতিটা কত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে দক্ষ এই BJP-RSS। যেখানে গোটা বাংলা জুড়ে ওরা প্রচার করছে যে NRC নাকি প্রয়োজন “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী”-দের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য, সেখানে আসামের অধিকাংশ এলাকাতে প্রচার করছে যে NRC নাকি প্রয়োজন “বিদেশী”-দের খুঁজে বের করে “Foreigners Tribunal” নামক একটি বিশেষ আদালতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। আর এরাই আবার এই আসাম-অরুণাচল প্রদেশ সীমান্ত অঞ্চলে প্রচার করছে যে NRC নাকি প্রয়োজন এই অঞ্চলের অধিবাসীদের চাকুরীক্ষেত্রে সুযোগ বাড়ানোর জন্য। তাই এই -এর প্রচারকে আপনি কোন আলোচনা বা যুক্তি দিয়ে আটকাতে পারবেন না। দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতাকে এরা আজ যে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, তার থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে দেশের সংবিধানকে হাতিয়ার করুন। প্রচার করুন যে কিভাবে NRC-র নামে দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক নাগরিক অধিকারকে হরণ করবার চক্রান্ত করছে এই BJP-RSS। লড়াইটা দীর্ঘ এবং কষ্টসাধ্য। কিন্তু এই লড়াইটা আজ লড়তেই হবে আমাদের। তা না হলে যে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে আত্মত্যাগ করেছিলেন নেতাজী, ভগৎ সিং সহ লাখো লাখো বীর, সেই দেশ আবারো খন্ড-বিখন্ড হবে; অত্যাচারিত হবে দেশবাসী।
তাই কোন NRC আসাম বা বাংলাতে চলবে না। এই ধরণের যে কোন জনস্বার্থবিরোধী প্রক্রিয়া যে দেশের মেহনতী জনতার জন্য যে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা কিন্তু আজ আসামে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। এই ভুলে ভরা NRC প্রক্রিয়া, যাতে কিনা সরকারের কোন ভুলের খেসারতে এক মুহূর্তে দেশের যে কোন নাগরিক নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে, সেইরকমের একটি মানবিকতাহীন প্রক্রিয়াকে কোনভাবেই একটি সভ্য দেশে প্রয়োগ করা যায় না। দেশের সংবিধান অনুযায়ী যে সমস্ত মানুষেরা ভারতের নাগরিক হওয়ার অধিকার পেয়েছেন, তাঁদের কারোর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া যাবে না। দেশের প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা মানবাধিকার সংগঠন, প্রগতিশীল উদ্যোগ এবং সর্বোপরি প্রতিটি সুস্থ চিন্তার রাজনৈতিক শক্তির উচিত অবিলম্বে NRC প্রসঙ্গে একটি সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করবার। আজ যদি আমরা এর থেকেও ভয়ানক পরিণাম এই বাংলাতে না চাই, তাহলে এগিয়ে আসতে হবে এই রাজ্যের আপামর জনগণকেই।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকপঞ্জী (NRC) বিরোধী যুক্ত মঞ্চ আসামে NRC প্রক্রিয়াতে বাদ যাওয়া মানুষদের অবিলম্বে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। বাংলাতে যাতে কোনভাবেই NRC চালু না হয়, তাই নিয়েও তারা প্রবলভাবে সক্রিয়। কিন্তু শুধু এই একটি বা দুটি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বাংলায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বাত্মক বিরোধ করতে হবে এই অযৌক্তিক এবং জনবিরোধী প্রক্রিয়ার। মনে রাখবেন কোন বাংলাদেশী চিহ্নিতকরণ নয়, কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী খুঁজে বার করা নয়, কোন বিদেশীদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া নয় – এই NRC হল আসলে দেশের সমস্ত প্রাথমিক ও ঘোরতর সমস্যা থেকে জনগণের চোখ সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি অত্যন্ত কু-প্রচেষ্টা, যার বলি হবেন আমার-আপনার মতন সাধারণ মানুষ। আপনি বাঙাল না ঘটি, হিন্দু না মুসলিম, আদিবাসী না ব্রাক্ষ্মণ, বিজেপি না সিপিএম – তাতে কিচ্ছু এসে যাবে না।
*NRC হল একটা বোমা। যখন যেখানে পড়বে, আশপাশের সকলকেই আহত করে ছাড়বে …*