হিজলের দ্বারপ্রান্তে ,’জাহাজ বাড়ী’

Spread the love

“খবর পেলাম গত মাসের বন্যায় হিজলের জাহাজবাড়ি ভেঙে গিয়েছে। ইতিহাসের এক অধ্যায় রহস্য আর জনশ্রুতির আড়ালে থাকতে থাকতেই নষ্ট হয়ে গেল চিরতরে। তার রহস্য উন্মোচন আর হল না।”

 

 

*রক্তিম মুখার্জী* :-  হিজল। উত্তর রাঢ়ের এক রহস্যময়ী মায়াপুরী। এই একবিংশ শতাব্দীর উগ্র নাগরিকতার মরুভূমির মধ্যে প্রাগৈতিহাসিকের মরুদ্যান। তার বুকে ধীর মন্থর চরণে ভুজঙ্গবঙ্কিম পথে বয়ে চলে রাঢ়ের তিন নদী। কুয়ে ময়ূরাক্ষী ও ডাগরা। ডাগরা হল দ্বারকা ও ব্রাহ্মণী নদীর মিলিত স্রোত। তিনে মিলে এক হয় ত্রিমোহনা বা ত্যামুনের জলায়। উত্তর রাঢ়ে হিজলের চতুষ্পার্শ্বস্থ নদী অববাহিকায় ইতিহাসের অনেক তরঙ্গ যুগে যুগে আছড়ে পড়েছে। কিন্তু হিজল রয়ে গেছে দ্বীপের মতোই নিঃসঙ্গ অধরা।
হিজলের দক্ষিণ পশ্চিম সীমা প্রারম্ভ হয় মুর্শিদাবাদের রাণীপুর ভবানীপুর গ্রামের কাছে। নাম থেকেই বোঝা যায় গ্রাম দুটি একসময় নাটোরেশ্বরী রাণী ভবানীর সুবিশাল জমিদারির অন্তর্গত ছিল। রাণীপুরে হিজলের প্রান্তসীমায় কুয়ে নদীর তীরে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে জাহাজবাড়ি। অভিশাপ আর হাহাকারের অবগুণ্ঠন তার সর্বাঙ্গে। শোনা যায় কান্দির সিংহ রাজবাড়ীর সবথেকে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ (স্বনামধন্য বৈষ্ণবসাধক লালাবাবুর পিতামহ) এই গুপ্তগৃহটি নির্মাণ করিয়েছিলেন জনবিরল হিজলের অন্তরালে একান্ত ব্যক্তিগত নির্মমতা ও লোভ চরিতার্থ করতে। নদীপথে দেওয়ানজি আসতেন এখানে। দিক ভুল হতো না কখনওই। কারণ বাড়িটির ছাদে উড়োজাহাজের আকৃতি বহু দূর থেকেই দিক নির্দেশ করত। আরও আসতেন অনেক ব্রিটিশ পুঙ্গব। জমিদারি খাজনার দরকষাকষি হত। তবে গঙ্গাগোবিন্দ ছিলেন মহা ধূর্ত। প্রজাদেরও শোষণ করতেন। আবার জাল চুক্তিপত্র বানিয়ে ব্রিটিশদেরও ঠকাতেন। তবে জাহাজবাড়ির বদনামের কারণ আরও মর্মন্তুদ। যে সব প্রজা খাজনা দিতে পারতো না বা বিদ্রোহী হত তাদের আনা হত এখানে। একতলার ঘরটির বিশেষ মেঝেত সেই হতভাগ্য পা রাখতেই তলিয়ে যেত নিচের অন্ধকূপে। তারপর অতিথি আপ্যায়ন হত নির্জলা অনাহারে। সঙ্গী হত হিজলের ভয়াবহ জনবিরলতা; কুয়ে নদীর কলতানে বাইরের জগতের ক্ষীয়মাণ হাতছানি; ‘আগে যারা এখানে এসেছে’ তাদের গলিত দেহাবশেষ; নিঃসীম অন্ধকার আর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তির অদম্য কিন্তু নিষ্ফল আকুলতা। আজও সেই স্মৃতি এই জাহাজবাড়ির বাতাসকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। এসবের ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবু জনশ্রুতি আজও আছে। এখনও মানুষ এই স্থানটিকে বিশেষত রাত্রিকালে এড়িয়ে চলে।
জাহাজবাড়ি থেকে ত্যামুনে বা ত্রিমোহনার পথে একটু এগোলেই পথে পড়ে পরীর নালা। কুয়ে থেকে নিকটবর্তী বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে জল আসার একটি প্রাচীন খাত। আজও এই নালা বহন করে চলেছে কোন গগনচারিণী অপরূপার অলৌকিক আবেশ।
আউলগ্রাম থেকে হিজল অভিমুখে যাওয়ার পথে পড়ে মল্লিকপুর শুনিয়া মদনপুর বেড়বাড়ি ও গোবিন্দপুর গ্রাম। গ্রামগুলোর নাম তথা এখান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর সাক্ষ্য থেকে জানা যায় বঙ্গে তুর্কি আক্রমণের প্রথম অভিঘাতের এক গতিপথ।
অতীতে এই গ্রামগুলো ছিল বিষ্ণুপূজা ও সহজযানী সাধনার ক্ষেত্র। রীতিমতো বর্ধিষ্ণু। আর এদের মধ্যে মুখ্য ছিল আউলগ্রাম বা সঙ্কটগ্রাম। এই গ্রামগুলির পাশ দিয়ে প্রশস্ত সড়ক চলে যেত গৌড়তন্ত্রের কেন্দ্রস্থল পরমভট্টারক শশাঙ্কদেবের ঔদক নগরী কর্ণসুবর্ণে। বণিকেরা গঙ্গাপথে কর্ণসুবর্ণে ফিরে গোযানে এক বেলার মধ্যে আসতেন আউলগ্রামে। বসতো “সাঁঝের বাজার”। পরবর্তী কালে পাল ও সেন যুগেও বজ্রাসন শক্তিপুরের গুরুত্ব অটুট ছিল। শক্তিপুরে পরমশৈব শশাঙ্কের প্রতিষ্ঠিত কপিলেশ্বর শিবালয় আজও উত্তর রাঢ়ে “শিবের বাড়ি” নামে পরিচিত। তবে তখনও হিজল ছিল আজকের মতোই বিচ্ছিন্ন; জনমানবহীন। রূপকথার তেপান্তরের মাঠের একাংশকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে পরী রাক্ষসী বেঙ্গমা বেঙ্গমিদের কথায় মগ্ন হয়ে থাকত তখনকার হিজলের আদিগন্ত জলাভূমি ও তৃণময় প্রান্তর। তার সীমা কেউ লঙ্ঘন করত না। এই অঞ্চল সুপ্রাচীন কাল থেকে বিষবৈদ্যদের নিবাসস্থল। লোকে বলে তাঁদের পূর্বসূরিরাই নাকি চাঁদ বণিকের মিত্র বিখ্যাত বিষবৈদ্য ধন্বন্তরি শঙ্কর গারুড়ীর শিষ্য ছিলেন। বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘরে যাতে কোনো সাপ প্রবেশ না করে; সেই দায়িত্ব ছিল তাঁদের ওপর। কিন্তু দেবী মনসার মায়ায় সে কার্যে তাঁরা বিফল হন। তাই চাঁদের দেওয়া নির্বাসন দণ্ড মাথায় নিয়ে চম্পকনগর থেকে চলে আসতে হয় মানুষের অগম্য এই হিজলের জলাভূমিতে। বিষহরি মা পদ্মাবতী নিজের আটনে তাঁদের স্থান দিয়েছিলেন পরম স্নেহে। এই হিজলই মায়ের সেই বিশেষ পীঠ। তাঁদের সেই নিজস্ব উপকথার জগতকে সাহিত্যিক মর্যাদায় কালোত্তীর্ণ করেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; “নাগিনী কন্যার কাহিনী” উপন্যাসে।

এই লোককথার ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে পারিপার্শ্বিক বেশ কিছু সূত্র বিচার করলে অতীতের এক খণ্ডচিত্রের পুনর্নির্মাণ খুব কঠিন নয়। উত্তর রাঢ়েই হিজল থেকে অল্প দূরে মুর্শিদাবাদের প্রাচীন জজান বা জয়যান গ্রামে আছে মা সর্বমঙ্গলার মন্দির। মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপি অনুযায়ী অষ্টম শতকে চাঁদ বণিকের বংশধর রামেশ্বর সাধু এখানে চর্চিকা মাতৃকার মূর্তির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার হিজলের এক সীমায় মুর্শিদাবাদের গোকর্ণ থেকে বহরমপুরের কাছে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত বিস্তৃত কালীদহ নামক সুপ্রাচীন বিল বা জলাশয়টি গঙ্গার এক সুপ্রাচীন প্রবাহের অংশ ছিল। মঙ্গলকাব্য অনুযায়ী এই কালীদহেই ডুবেছিল চাঁদ বণিকের সপ্তডিঙা। আবার এখান থেকে মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম পর্যন্ত গঙ্গার প্রবাহের সমান্তরালে চাঁদ ও অন্যান্য প্রাচীন বণিকদের নামাঙ্কিত বেশ কিছু স্থানের উল্লেখ আজও পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সুপ্রাচীনকালে বাঙালি বণিকদের গঙ্গাপথে সমুদ্রবাণিজ্যের একটি প্রধান জলপথ হিসাবে এই এলাকাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং সম্ভবত হিজলের বিষবৈদ্যরা ঐ পথেই পুণ্ড্র থেকে এখানে এসেছিলেন। গ্রহণ করেছিলেন সর্পমাতৃকা মনসার উপাসনার প্রাচীন ধারা।

হিজল থেকে নিরাপদ দূরত্বে মদনপুরের সীমায় কাটা নগরপরিখা (যা আজও বর্তমান) যেন নির্দেশ করত বাস্তব আর মায়াপুরীর ব্যবধানবলয়। উত্তর রাঢ়ের লোকেরাও এই সুবিস্তৃত প্রান্তরকে পাশে ফেলে সড়কপথে যাতায়াত করত। একমাত্র বর্ষাকালে স্থানীয় গোপেরা গোচারণার জন্য এই তৃণভূমিকে গোরুর বাথান রূপে ব্যবহার করত। এখনও করে।


এই হিজলের পূর্বদিকের একাংশ কর্ণসুবর্ণের উপকণ্ঠে তৎকালীন ময়ূরী নদীতীরে পরিণত হয়েছিল মৃগাধ্যুষিত অরণ্যশ্যামলিমায়। তার নামেই রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রাচীন নাম ছিল মৃগশিখাবন বিহার।
ত্রয়োদশ শতকে বখতিয়ার খলজির অধীনস্থ তুর্কিবাহিনী নবদ্বীপ থেকে অগ্রসর হয়েছিল গৌড়ের পথে। লক্ষ্মণসেনের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিল গৌড়ের উপকন্ঠে। তারপর থেকে উত্তর রাঢ়ের এই অঞ্চলে বারবার আক্রমণ নেমে এসেছে। সেন ও দেববংশের শাসনকালের পর গণেশের ছেলে যদু বা জালালুদ্দিনের সময় থেকে এই সমস্ত অঞ্চলে নেমে আসে ভয়ঙ্কর আঘাত। আউলগ্রামের চর্চিকা ও অবলোকিতেশ্বরের সাধনপীঠ ধ্বংস হয়। মঠ পরিণত হয় দেবীদহ নামের এক অভিশপ্ত পুকুরে। আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ে মল্লিকপুর মদনপুর গোবিন্দপুরে। আক্রোশের অনলে জ্বলে যায় ঐ গ্রামগুলোর অতীতের সমৃদ্ধি। ব্যাপক নরহত্যা ও ধর্মান্তরিতকরণের পর তুর্কি যোদ্ধাদের যাত্রাপথ হারিয়ে যায় হিজলের উপকণ্ঠে। মদনপুরের পরিখা ঘিরে বেড়বাড়িতে বাস করতে থাকে তাদের অধীনস্থ চর্মকার বৃত্তির নিকিড়ি শ্রেণীর সৈন্যরা। এঁদের অন্যান্য অভিজাত মুসলিমরা সামাজিক ভাবে নিকৃষ্ট জ্ঞান করতেন। আজও হিজলের উপকণ্ঠে গ্রামগুলোর সাথে আউলগ্রাম থেকে মদনপুর পর্যন্ত গ্রামগুলির সাংস্কৃতিক এমনকি উপভাষাগত বিভাজন অতি প্রকট।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.