নির্বাচন পরবর্তী হিংসা !
পাশারুল আলম
প্রতিবেদন :- পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পরবর্তীকালে বেশ কিছু পকেটে হিংসাত্বক ঘটনার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এই হিংসাকে দলমত জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিন্দা জানানো উচিত। পশ্চিম বাংলায় নির্বাচন পরবর্তী হিংসা একটা ট্রাডিশন হিসাবে এখনো বেঁচে আছে। যা যেকোনো সুস্থ মানসিকতার মানুষ মেনে নিতে পারে না। কিন্তু কেন বারবার নির্বাচন পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে? এই কালচার থেকে কি আমাদের উত্তরণ সম্ভব নয় ? যদি আমরা সবাই চাই তাহলে অবশ্যই সম্ভব।
আমরা দেখছি বাম জমানায় এই কালচার শুরু হয়েছে। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জির আহবান ছিল বদল চাই, বদলা নয়। এই আহ্বান সেবার বেশ কার্যকরী হয়েছিল। তাই আমরা দেখেছিলাম সামান্য কয়েকটি জায়গায় কিছু কিছু ঘটনা ঘটলেও তা ব্যাপক আকার নেয়নি। আবার ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই হিংসা ২০১১ সালের তুলনায় একটু বেশি হয়। এই হিংসা আবার ২০২১ সালে যে হচ্ছে তা আমরা টের পাচ্ছি। এই টের পাওয়ার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়া। এই সোস্যাল মিডিয়া দিয়ে একদিকে যেমন ঘটনার সংবাদ পাচ্ছি তেমনি বেশ কিছু অতিরঞ্জন চিত্রও তুলে ধরা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিশেষ একটি আইটি সেল মারফৎ অনবরত অত্যাচারের সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। দুঃখের বিষয় সেই আইটি সেল এই হিংসাকে নিন্দা করে প্রতিহত করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়না। উল্টে রাজনৈতিক সংঘর্ষকে ধর্মীয় সংঘর্ষ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তো ?
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নির্বাচন কমিশন আট দফায় ভোট করেছে। একাধিক সভা সমাবেশ হয়েছে। সেই সমস্ত সভা সমাবেশে নেতা-নেত্রীদের ভাষণ আংশিকভাবে আজকের এই উত্তেজনার জন্য দায়ী। আমরা জানি যখন কারো উপরে চাপ পড়ে তখন সে বাপ বলে। অর্থাৎ এখন যখন বিভিন্ন স্থানে হিংসার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তখন আমরা সবাই হায় হায় করছি। অথচ যখন এই হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছিল তখন কিন্তু আমরা অনেকেই হাততালি দিয়ে বেশ আনন্দ উপভোগ করেছি। আমি কোনো নেতা-নেত্রীর নাম দিয়ে তাদেরকে ছোট কিংবা বড় কোনোটাই করতে চাই না কিন্তু তাদের প্রদত্ত ভাষণের কিছু কথা বলে সেই হিংসার বীজ সম্পর্কে একটু মনে করে দিতে চাই।
নির্বাচনের একেবারে শুরুতেই একনেতা বললেন, আমরা সত্তরভাগ আর ওরা তিরিশভাগ। সেদিন আমরা কেউ প্রতিবাদ করেনি। আমরা কেউ বলিনি এমন কথা বলতে হয়না। আমরা কেউ বলিনি এই কথা বলে তুমি ভোটে জিতে যেতে পার কিন্তু আমাদের সমাজে যে সামাজিক বিভাজন তুমি করে দিচ্ছ তার ফলতো আমাদের ভোগ করতে হবে। একইভাবে আরেক নেতা বললেন, ক্ষমতায় এসে পুলিশকে জুতো চাটানো হবে। এর প্রতিবাদ কেউ করিনি। বরং এতে হাততালি দিয়ে মজা নিয়েছি। কেউ বলিনি পুলিশ সরকারের আজ্ঞা বহনকারী মাত্র। সেই সত্যকে না বুঝে আমরা মজা নিয়েছি। বাংলা হোক বা উত্তরপ্রদেশ সব রাজ্যে পুলিশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে।
যে কোন হিংসা যেমন নিন্দনীয় তেমনি যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু যে কোনো কারণে হতে পারে। এমনও হতে পারে যে বা যারা মারা যায়, তারা দোষী কিংবা নির্দোষও হতে পারে। তা বিচার করার জন্য দেশে একটি বিচার প্রক্রিয়া আছে। ততদিন অপেক্ষা করায় বাঞ্ছনীয়। সেখানে কেউ বলতে পারে এই মৃত্যু অন্যায়, আমি আইনের পথে লড়াই করব, আবার উল্টো পক্ষ বলতে পারত এমনটা না হলে ভালো হত কিন্তু জনগন বড্ড বে-পরোয়া হয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু তা না বলে যদি কোনো নেতা বলে আরও শীতলকুচি হবে, তিনি আবার যখন বলেন আগে সরকার গঠন করব তারপর দরজা বন্ধ করে পেটাব। তখন কোন বাপ রক্ষা করবে ? এসব কথার অর্থ কি ? এটা ভাবা উচিত ছিল বাপেরও বাপ আছে। সেদিন আমরা কেউ প্রশ্ন তুলিনি। আবার কেউ যদি বলে চার কেন ? আটটি মারা হয়নি কেন ? তার জন্য কমিশনকে শোকজ করা হোক। সেদিন কিন্তু আমরা কেউ বলিনি, এটা কেমন কথা বললেন আপনি, এতে হিংসা বাড়বে। রাজনৈতিক নেতা হিসাবে আপনি হিংসাকে কেন বাহবা দিচ্ছেন ?
এর উল্টোদিকে আর এক যুব নেতা যখন বলেন, সব মনে রাখা হবে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হিসেব নেওয়া হবে তখন কিন্তু আমরা কেউ প্রশ্ন করিনি এটা রাজনৈতিক ভাষা নয়। এতে নির্বাচন পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ সত্যি সত্যি হিসেব নিতে পারে। এই বক্তব্য নিয়ে সাধারণ মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে যদি বসে থাকে তাহলে তার পরিণাম কি হতে পারে ?
আসলে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। এই সংস্কৃতি যতদিন না গড়ে উঠবে ততদিন এই কালচার থাকবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না উঠার জন্য দায়ী বাংলার সমস্ত রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীরা চাইলেই তা বন্ধ হতে বাধ্য। পাশাপাশি এই বাংলায় সুশীল সমাজের অভাব নেই। তাদেরও এই কাজে এগিয়ে আসা উচিত। বাংলার সুশীল সমাজ যদি মনে করে আমরা শহরবাসী। আমাদের আশেপাশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে। সমস্যা কোথায় ? তাহলে বড় ভুল হবে। এবার নয় সকল নির্বাচনের পরবর্তীকালে এই হিংসা গ্রামীন এলাকায় বেশি হয়। সত্যি কথা বলতে কি যারা এই কাজ করে এরা কোনো দলের বা ধর্মের মানুষ নয়। লুটপাট সন্ত্রাস আর হিংসা ছড়ানো এদের জীবিকা।
পরিশেষে বলব, এই হিংসাকে প্রতিহত করতে হবে। বাংলার একজন গরিব মানুষ আর একজন গরিব মানুষকে মারছে, তার সম্পত্তি লুট করছে। তা মানা যায়না। একদিকে কোভিডের আক্রমন আর একদিকে এই অস্থিরতা দুইই আমাদের ব্যথিত করছে। কোভিডের কারনে বহু মানুষ মাঠে নেমে প্রতিহত করতে পারছে না। এই সুযোগে ওরা আরও সুযোগ পেয়ে গেছে। তাই প্রশাসনে ভূমিকায় এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে শিক্ষিত মানুষের কাছে অনুরোধ আপনারা নিজের নিজের গ্রাম ও এলাকাকে থামান। তাহলে দ্রুত শান্ত হবে বাংলার ভূমি।