::স্বীকৃতি :: পলাশ হালদার

Spread the love

স্বীকৃতি :
পলাশ হালদার

অয়ন বাংলা:- রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার জন্য পকেটে হাত দিতে যাবো হঠাৎ দেখলাম রবিন চোখ মুছছে।ভাবলাম গামছা দিয়ে হয়তো ঘাম মুছছে।কিন্তু খুচরো পয়সা ফেরত নেওয়ার সময় দেখলাম রবিন চোখের জল আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।রবিন আমাদের এলাকায় সবার খুব পরিচিত রিক্সাওয়ালা।আর পাঁচ জন রিক্সাওয়ালার মতো সে নেশা করে না।সারা দিনের উপার্জন সে রাতে এসে স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। গৃহিণীর সুনিপুণ পরিচালনায় তার সংসার দিব্যি চলে যায়। তাদের যাবতীয় স্বপ্ন একমাত্র সন্তান ঋষিকে নিয়ে। পড়াশোনায় দক্ষ ঋষি স্কুলের শিক্ষকদের কাছে খুবই প্রিয়। রবিন ও একসময় অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল ।কিন্তু ভাগ্য তাকে ধাক্কা দিতে দিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাটুলির রিক্সা স্ট্যান্ডে এনে ফেলেছে।এখন সে সারাদিন রিক্সা চালায় আর সুযোগ পেলেই মনের টানে কাগজ কলম নিয়ে বসে যায় ছড়া/কবিতা লিখতে।

কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-“কি ব্যাপার রবিন? কাঁদছো কেন?বাড়িতে কোনো বিপদ?”
-“ও কিছু না দাদা।” বলে জোর করে হেসে ভিতরের আবেগটাকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।কিন্তু ওর সমস্যা টা না শোনা পর্যন্ত শান্তি পাবো না।তাই বললাম-“চলো রবিন বাড়ি থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেয়ে যাবে।যা ভ্যাপসা গরম পড়েছে আর পারা যাচ্ছে না।” রবিন কোনো দ্বিরুক্তি না করে আমার সঙ্গে সঙ্গে এলো।

ঘরে ঢুকে গৃহিণীকে বললাম-“দুজনকে ঠান্ডা জল দাও তো।” কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনের জন্য লাড্ডু সহযোগে ঠান্ডা জল এলো।জল পান করতে করতে বললাম-” হ্যাঁ এবার বলোতো রবিন তোমার সমস্যা টা কি ?” লজ্জায় মাথা নত করে রবিন সেই একই জবাব দেয়-“ও কিছু নয় গো দাদা।” তার পিঠে হাত রেখে সস্নেহে বললাম-“দেখো রবিন তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে সমস্যা র কথা বলতে পারো।পারলে সুপরামর্শ ই দেবো কিন্তু কোনো ক্ষতি করবো না।” আশ্বস্ত হয়ে রবিন হঠাৎ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলে-“দেখো তো দাদা এই লেখাটা কেমন ?” সাগ্রহে তৎক্ষনাৎ পড়ে বললাম-“বাহ! খুব ভালো তো কবিতা টা!”
-“এই কবিতা টা আবৃত্তি করে আমাদের ঋষি যাদবপুর জোনে প্রথম হয়েছে।”
-“তাই! কার লেখা কবিতা টা ?আগে তো কোনোদিন দেখিনি বা শুনিনি। ” প্রশ্ন টা এড়িয়ে রবিন কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-“কিন্তু ঋষিদের স্কুল থেকে বলে দিয়েছে সাব ডিভিসনে এই কবিতা আর চলবে না।আরো ভালো কোনো কবিতা তৈরী করতে হবে।”
-“সেতো বুঝলাম। কিন্তু এই কবিতাটা চলবে না কেন?” বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করতে আমতা আমতা করে রবিন বলে -“আর্যদা ওটা আমি লিখেছি তো তাই।ওদের স্কুলের স্যার বলেছেন কোনো বিখ্যাত কবির কবিতা মুখস্থ করতে। তা নাহলে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারবে না।” রবিনের এই টুকটাক সাহিত্য চর্চার খবর আমরা শুনেছিলাম। কিন্তু কোনোদিন পরখ করিনি।অবাক বিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম যে ছেলেটা সারাদিন রিক্সা চালায় তার কলম থেকে এমন কবিতা কি করে বের হয়!নয় নয় করে আমার বয়স তো কম হলো না।গল্প, উপন্যাস, কবিতা কম তো পড়িনি।তাই তার গুণাগুণ সম্বন্ধে একটু আধটু ধারনা তো হয়েছে।রবিনের এই কবিতা যে কোনো নাম করা কবির কবিতা অপেক্ষা কম নয়।কিন্তু শুধু রিক্সাওয়ালার লেখা বলে তাকে স্বীকৃতি দিতে এতো দ্বিধা। মনের মধ্যে হঠাৎ একটা জেদ চেপে বসলো।চোয়ালটা শক্ত হয়ে এলো।রবিনের পিঠ চাপড়ে বললাম- “রবিন হাল ছেড়ো না।তোমার ছেলেকে নিয়ে আজ বিকেলেই আমার কাছে এসো।দেখি আমি কি করতে পারি।”

সন্ধ্যার মুখে ঋষিকে নিয়ে হাজির রবিন।জানতে পারলাম স্কুল থেকে ওকে কবি শ্রীজাত র একটি কবিতা মুখস্থ করতে দিয়েছে।কিন্তু ঋষির খুব ইচ্ছা সে তার বাবার কবিতা আবৃত্তি করবে।তার বিশ্বাস যে কবিতা তাকে যাদবপুর জোনে প্রথম পুরস্কার এনে দিয়েছে সেই কবিতা ই তাকে সাব ডিভিসনে ও পুরস্কার এনে দেবে।কিন্তু …….।সব শুনে ঋষি কে বললাম-“শোনো বাবা, শ্রীজাত র কবিতা টা তুমি মুখস্থ করো।স্কুলে ধরলে তুমি ওটাই বলবে।কিন্তু মনে মনে প্রস্তুতি নাও তোমার বাবার কবিতা টাই তুমি সাব ডিভিসনে আবৃত্তি করবে।” আমার কথা শুনে চমকে ওঠে রবিন।
-“কি বলো গো আর্যদা…স্কুলে আর আমার ছেলেকে ঢুকতে দেবে?”
-“চিন্তা কোরো না রবিন।এ যুগে পুরস্কার টাই সব।কিভাবে এলো সেটা বড়ো কথা নয়।আর তাছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমার কবিতার বিষয় ভাবনা ই ঋষিকে জিতিয়ে দেবে।আর ও যদি সাব ডিভিসনে প্রথম হতে পারে তাহলে স্যার রা এসব ভুলে যাবেন।”

গোপনে প্রস্তুতি চলতে লাগলো।স্কুলে এক কবিতা আর বাড়িতে অন্যটা।ঝুঁকি একটা ছিলই। শিক্ষকদের কথা অমান্য করে ব্যর্থ হলে তার ফল মারাত্মক হতে পারে।কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে কে কবে সাফল্যের স্বাদ পেয়েছে।আর তাছাড়া ঋষির মধ্যে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তার অভাব ছিলনা।

বিজয়গড়ের ‘নিরঞ্জন সদন’ কানায় কানায় পূর্ণ। প্রতিযোগী ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয় ছাত্র ছাত্রী, ছেলে মেয়েদের পারফরমেন্স দেখার জন্য। একে একে সবাই মঞ্চে উঠছে , সাধ্যমতো সৃজনশীলতা তুলে ধরছে।যথা সময়ে ঘোষক ঘোষণা করলেন-“এবার আবৃত্তি করবে ঋষি মন্ডল। ” ঋষি মঞ্চে উঠছে। আমি আর রবিন শক্ত হয়ে চেয়ারে চেপে বসলাম।কয়েক মুহূর্তে র জন্য আমাদের যেন শ্বাস রোধ হয়ে আসছে।মঞ্চে উঠেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঋষি আবৃত্তি শুরু করলো।বিচারকরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন ছেলেটি যে কবির নাম না বলেই আবৃত্তি শুরু করেছে।এমনটা তো তারা কখনোই শোনেননি। ঋষির স্কুলের শিক্ষকরা লজ্জায় মাথা নীচু করে নিলেন।পনেরো দিন ধরে ছেলেটাকে তাঁরা কি শিখিয়েছেন আর আজ ভুল করে কি আবৃত্তি করছে!তাঁরা কি করে জানবেন যে ভুল করে নয় ঋষি ইচ্ছে করেই পরিকল্পনা মাফিক তার বাবার লেখা কবিতা আবৃত্তি করছে।ঋষির আবৃত্তি শেষ।হাততালিতে ফেটে পড়লো সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ। বিচারকরা ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে করতালি দিতে থাকলেন।কিন্তু সে যে কবির নাম বলেনি ……।হাততালি কমতেই মাইক্রোফোন টা আরো কাছে টেনে নিয়ে ঋষি বললো-“এতক্ষণ যে কবিতা টি আমি আবৃত্তি করলাম সেটি লিখেছেন রবিন মন্ডল- আমার বাবা, পেশায় রিক্সাচালক।প্রথমে কবির নাম বলিনি কারন তাহলে অনেকেই শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন।আমি গর্বিত এমন বাবার ছেলে হতে পেরে।” বিচারকরা সবাই দাঁড়িয়ে উঠে করতালি দিচ্ছেন।চোখে মুখে অপার মুগ্ধতা। সম্পূর্ণ নিরঞ্জন সদন দাঁড়িয়ে উঠে আবার ও করতালি দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে কবিতা ও তার কবিকে।ঋষি দুচোখ ভরে তার বাবার কবিতার স্বীকৃতি দেখছে।আনন্দে কখন যে আমার চোখের জল গন্ডদেশ পেরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি।সম্বিত ফিরতেই দেখলাম রবিনের দুচোখে ঘন শ্রাবণ ধারা।এই ধারার মূল্য যে মণিমুক্তোর থেকে ও বেশি।
কলমে — পলাশ হালদার

ছবিটি সেই শ্রী রবীন মন্ডলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.