পাঠকের কলম :- লক্ষ লক্ষ আদিবাসী-বনবাসী কাদের ষড়যন্ত্রে গৃহহীন-ভূমিহীন হলো ? এক গভীর চক্রান্ত ও বঞ্চনার ইতিহাস জানুন –

Spread the love

23 লাখ আদিবাসী-বনবাসী কাদের ষড়যন্ত্রে গৃহহীন-ভূমিহীন হলো ? এক গভীর চক্রান্ত ও বঞ্চনার ইতিহাস জানুন —:

ভারতবর্ষের মূল অধিবাসী বা মূল জনগন হলেন আদিবাসী-মূলনিবাসী মানুষেরা। তাঁরাই এদেশের প্রাচীন সভ্যতা ( হরপ্পা- মহেঞ্জোদাড়ো বা সিন্ধু সভ্যতা ইত্যাদি) ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাঁদের রক্ত-মাংস ও কঠোর পরিশ্রমে গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষ। কিন্তু পরবর্তীকালে খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপ থেকে এদেশে প্রবেশ করে বর্বর লুন্ঠনকারী, যাযাবর আর্যজাতি ( ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য)। আর তখন থেকেই শুরু হলো এদেশের আদিবাসী মূলনিবাসীদের উপর নির্মম হত্যাকান্ড, শোষন, অত্যাচার ও বঞ্চনার ইতিহাস — যা আজও সমানে চলেছে। অথচ বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই আর্যজাতির (ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) সংখ্যা মাত্র 8.1% (2011 সালের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী, সূত্র– SPR-32/107)। অথচ ছলে, বলে, কৌশলে আজও এই আর্য তথা বর্ণবাদীরা এদেশের ধর্মনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ দখল করে আছে।অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে তারাই প্রভূ, আর ভারতবর্ষের মূল জনগন বা মূলনিবাসীরা তাদের গোলাম বা কৃতদাস হয়ে বেঁচে আছে। অথচ মূলনিবাসীদের সংখ্যা (S.C/S.T/OBC ও মাইনরিটি) 91.9% ( 2011 সালের সেন্সাসের রিপোর্ট, সূত্র — SPR-33/ 107)

স্বাধীনতার 73 বছরেও এই আর্য তথা বর্ণবাদীদের দ্বারা এদেশের মূলনিবাসীদের প্রতি সমানে চলেছে অত্যাচার, শোষন, নির্যাতন, বঞ্চনা, ভূমিলুন্ঠন। তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটানোর চক্রান্ত চলেছে। ধীরে ধীরে তাঁদের অরন্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার গভীর ষড়যন্ত্র চলেছে। অর্থাৎ সংবিধানে ডঃ আম্বেদকরের দেওয়া “জমি ও জঙ্গলে”র অধিকার থেকে বঞ্চিত করার “মাষ্টার প্লান” চলেছে। আর সেই কফিনের শেষ পেরেক পুঁতে দিলেন গত 13-ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের এক ব্রাহ্মন বিচারপতি অরুন মিশ্রের রায়। এই রায় ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের প্রায় 23 লাখ 75 হাজার আদিবাসী-বনবাসী ভিটেহারা, গৃহহীন, জমিহারা, জঙ্গলহারা হয়ে অনিশ্চিত অনাহার জীবনের দিকে ধাবিত হলেন। একটি রায়ে তাঁরা শত শত বছরের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে গেলেন। আগামী দিনে এই সংখ্যাটা প্রায় ছয় থেকে আট গুন হবে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে। ভারতের মাটি থেকে আদিবাসী-বনবাসীদের উৎখাত করতে বর্ণবাদীরা কেন এই ষড়যন্ত্র করেছে তা নিন্মে আলোচনা করা হলো —
বন ও বন্যপ্রানী প্রেমী কিছু সংগঠন তারা বন ও বন্যপ্রানী ধ্বংসের জন্য সরাসরি আদিবাসী বনবাসীদের দোষী সাব্যস্ত করে সুপ্রিমকোর্টে মামলা দায়ের করে। এদের মামলার ভিত্তিতে গত 13-ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের ব্রাহ্মন বিচারপতি অরুন মিশ্র রায় ঘোষনা কোরে দেশের 16 টি রাজ্যকে নির্দেশ দেন –” যেসকল আদিবাসীদের পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে সেই পরিবার গুলিকে আগামী 27 জুলাইয়ের মধ্যে উচ্ছেদ-উৎখাত করতে হবে”। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বন্য ও বন্যপ্রানী ধ্বংসের জন্য কারা দায়ী ? আদিবাসীরা ? নাকি অন্য কেউ ? নিচে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো —
সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট (সি. এস. ই) এর 2008 সালের একটি রিপোর্টে জানা যায় –” এদেশের 1.64 লাখ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস ও বনজসম্পদ লুন্ঠন হয়েছে “খনি” শিল্পের জন্য এবং 0.48 লাখ হেক্টর বনভূমি সাফ হয়েছে শিল্প ও কলকারখানার জন্য”। এরফলে এই অঞ্চল গুলি থেকে প্রায় আড়াই হাজার প্রকারের ছোটবড় উদ্ভিদ এবং 520 ধরনের প্রানী অবলুপ্ত হয়েছে। এই রিপোর্টে আরেকটি ভয়ংকর চিত্র উঠে এসেছে তাহলো –” স্বাধীনতার পর দেশে খনি গড়তে উচ্ছেদ হয়েছে সাড়ে তিন কোটি মানুষ — যার দুই কোটি 62 লাখ আদিবাসী। এর এক চতুর্থাংশেরও পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত হয়নি”।

বেআইনি খনি বিষয়ে অনুসন্ধান করতে 2005 সালে কেন্দ্র সরকার একটি পার্লামেন্টরি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির রিপোর্ট দেখে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হতে হয় — “সারাদেশে আইনি খনি আছে 8700 টি। আর বেআইনি খনি রয়েছে 14,504 টি”। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। এই বেআইনি খনি গুলির বকলমে মালিক গুলি হলো বেদান্ত, জিন্দাল, টাটা, বিড়ালা ইত্যাদি শিল্পপতি গোষ্ঠী। এই বেআইনি খনি গুলি থেকে নির্বিচারে চলে বন ও বন্যপ্রানী ধ্বংসের কাজ। এদের কোনো লাগাম নেই। অথচ সরকার সব জেনে-বুঝেও চুপ থাকে। কারন এদের টাকায় ভোটে জয়লাভ করতে হয়।

জঙ্গল ধ্বংস করে খনি বানানোর হিড়িকে ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশা থেকে দলে দলে হাতি পালিয়ে আসছিলো ছত্তিশগড়ে। তাই ছত্তিসগড়ের ঐ অঞ্চলে একটি বিরাট হাতির অভয়ারন্য তৈরির কথা ছিলো। কিন্তু 2006 সালে ছত্তিসগড়ের রামন সিংহের বিজেপি সরকার ঐ অভয়ারণ্যের প্রস্তাবটি খারিজ করে দেয়। কারন ঐ বনভূমির কিছুটা অংশ ছিলো কয়লাখনি অঞ্চল। তাই বিভিন্ন শিল্প গোষ্ঠীর কয়লা উত্তোলনে যাতে বাঁধা না পড়ে সেই কারনে ঐ অভয়ারণ্যের প্রস্তাবটি সরকার বাতিল করে দেন। তাহলে সরকার কি বন ও বন্যপ্রানী প্রেমী ? নাকি শিল্পপতি প্রেমী ? এরকম অসংখ্য অসংখ্য উদাহরন রয়েছে।

বন্যপ্রানী ধ্বংসের আরেকটি অন্যতম কারন হলো, চোরাশিকারি ও আন্তর্জাতিক পশুপাচার চক্র। এরা হাতি, হরিন, গন্ডার ইত্যাদি পশু মেরে তাদের চামড়া, হাড়,দাঁত, সিং ইত্যাদি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে। আর এ পর্যন্ত যত চোরা শিকারী মাফিয়া ধরা পড়েছে তার প্রায় সবই তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোক। এদের মধ্যে একজনও আদিবাসী সমাজের লোক নেই।

এখন প্রশ্ন হলো, বিচারপতি অরুন মিশ্র আদিবাসীদের প্রতি এরকম অমানবিক রায় ঘোষনার আগে তিনি কি ভালো করে বিচার করে দেখেছেন যে, অরন্য ও অরন্যপ্রানী ধ্বংসের জন্য কারা সত্যিকারে দায়ী ? তিনি যদি নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করতেন তাহলে অরন্য ও অরন্য সম্পদ ধ্বংসের জন্য প্রকৃত যারা দায়ী, সেই শিল্পপতি ও বেনিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর রায় ঘোষনা করতেন। নির্দোষ, সরলপ্রান আদিবাসীদের জীবনে এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা নামিয়ে আনতেন না। আসলে এটা আদিবাসীদের প্রতি বর্ণবাদীদের একটা গভীর ষড়যন্ত্র। কারন যে বন্যপ্রানী-প্রেমী সংগঠন গুলি আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে গিয়েছে, সেই সংগঠন গুলি বড় বড় শিল্পপতিদের এজেন্ট। আর শিল্পপতিদের নির্দেশেই তারা এই কাজ করেছে। এর প্রধান কারন, বিগত পাঁচ বছরে দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন কলকারখানা ও খনি মালিকদের অবৈধ ভাবে বনভূমি দখলের প্রচেষ্টাকে সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ করে রুখে দিয়েছে স্থানীয় আদিবাসীরা। নিন্মে তার মাত্র কয়েকটি উদাহরন তুলে ধরা হলো। প্রথমত —: টাটা লৌহ ও ইস্পাত কোম্পানি বস্তার জেলার লোহান্ডিগুদা অঞ্চলে সরকারের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ অবৈধ ভাবে 30 টি গ্রামের আদিবাসীদের প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি ও বাসস্থান অধিগ্রহণ করে — যার বেশির ভাগই চাষযোগ্য উর্বর জমি। সর্বোপরি এ জমি পঞ্চম তফশীলের অন্তর্ভূক্ত। ফলে টাটার এই কারখানার বিরুদ্ধে স্থানীয় আদিবাসীরা প্রবল প্রতিবাদ করে চলেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ভয়ংকর যুদ্ধ চললেও বাসস্থান থেকে তাঁরা পিছু হটেনি। দ্বিতীয়ত :– বাইলাডিলা “এসার স্টিল” কোম্পানির সঙ্গে স্থানীয় বনবাসীদের সংঘর্ষ। তৃতীয়ত–: বস্তারের দক্ষিণ অঞ্চলে দান্তেওয়াড়া জেলার ধূরলী ও ভাঁসী ( ভানসি) অঞ্চলে জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সঙ্গে 2005 সাল থেকে খনি মালিকদের সংঘর্ষ, ইত্যাদি অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ফলে আদিবাসীদের এই সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে ভয় পেয়ে এই সকল শিল্পপতিরা সুকৌশলে তাদের কাজ হাসিল করার জন্য তাদের এজেন্ট সেই ভাওতাবাজ বন্যপ্রেমীদের দিয়ে মামলা করিয়েছে। আর টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে বিচারপতিকে — তার ফলে এই রায়। ফলে ভবিষ্যতে অবাধে বনভূমি ও বনবাসীদের বাসস্থান দখল করায় আর কোনো বাধা রইল না। এইসব ছদ্মবেশী, ভাওতাবাজ বন্যপ্রানী-প্রেমীরা জানে কি যে, যুগ যুগ ধরে বন ও বন্যপ্রানীদের সঙ্গে আদিবাসীদের সম্পর্ক ও ভালোবাসা কত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। আদিবাসীরা বৃক্ষকে মাতৃসম শ্রদ্ধা করে, কখনোই অরন্যধ্বংস করেনা। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে তাঁরা শিকার করে — যা তাঁদের সম্পূর্ন সাংবিধানিক অধিকার। অথচ তাঁদের একদিনের শিকার উৎসবে বর্ণবাদীরা গেল গেল রব তোলে।

গত 13 ফেব্রুয়ারি বিচারপতি অরুন মিশ্র রায় ঘোষণা করে বলেন, “যে সকল আদিবাসীদের পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে সেই পরিবার গুলিকে আগামী 27 জুলাইয়ের মধ্যে উচ্ছেদ করতে হবে “। এখন বড় প্রশ্ন হলো, এরা ভূমিহীন, গৃহহীন হয়ে কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে ? তাছাড়া আদিবাসী বনবাসীদের পাট্টা না পাওয়ার জন্য দায়ী কারা ? আদিবাসীদের পরিচয় পত্র (S.T কার্ড)ই বা কারা দেয় ? জমির পাট্টা, পরচা, দলিল সবটাই তো ‘অ-আদিবাসী’ উচ্চবর্ণের সরকারি কর্মকর্তাদের হাত দিয়েই এদের পেতে হয়। ফলে এই উচ্চবর্ণের কর্মকর্তাদের চূড়ান্ত গাফিলতি ও সদিচ্ছার অভাব চোখে পড়ে। গাফিলতি ও সদিচ্ছার অভাব চোখে পড়ে ব্রাহ্মন্যবাদী রাজনৈতিক দলগুলির ও তাদের নেতা-নেতৃদের। একটা উদাহরণ দিলে তা পরিস্কার হয়ে যাবে।পশ্চিমবঙ্গে 2011 সালের এপ্রিল পর্যন্ত বামফ্রন্টের সময়ে পাট্টা চেয়ে 1 লাখ 47 হাজার আদিবাসী-বনবাসী পরিবার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাট্টা পেয়েছে মাত্র 44 হাজার আবেদনকারী। ঠিক তেমনি মমতা ব্যানার্জীর আমলে জমির পাট্টা চেয়ে এ পর্যন্ত (2018 সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) 1 লাখ 58 হাজার আদিবাসী-বনবাসী পরিবার আবেদন করেছেন। কিন্তু পাট্টা পেয়েছে মাত্র 38 হাজার আবেদনকারী। তাই আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনা ও উদাসীনতার ব্যাপারে সব ব্রাহ্মন্যবাদী দলই সমান। এছাড়া পাট্টা চেয়ে আবেদন পত্র জমা দেননি অসংখ্য আদিবাসী-বনবাসী মানুষ। কারন 2014 সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে মালিকানা সংক্রান্ত নথিপত্র পাওয়ার প্রক্রিয়াটি নানা অছিলায় জটিল করে দিয়েছে। ফলে দরিদ্র, সরল, সাধারন অক্ষরজ্ঞানহীন আদিবাসীদের পক্ষে বারবার প্রশাসনের কাছে গিয়ে উপযুক্ত নথি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব কারন গুলির জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় সরকারেরই সমান দোষ ও দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। সবচেয়ে লজ্জার ও ঘৃনার কথা হলো, সুপ্রিমকোর্ট 13 ফেব্রুয়ারির এই রায় পাশ করানোর সময় তিন তিনবার কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত চেয়েছেন। কিন্তু এই অমানবিক রায়ের ব্যাপারে কোনো আপত্তি তোলেননি বা বিরোধিতা করেননি কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি মোকাদ্দমার শেষ তারিখে সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে এই ব্যাপারে মতামত জানানোর নোটিশ দিলে সেই দিন কেন্দ্রের আইনজীবীরা কোর্টেই উপস্থিত হয়নি। ফলে ফাঁক মাঠে রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি অরুন মিশ্র।
“রাষ্ট্রীয় খনি নিয়ন্ত্রক কমিটি” র 2013 সালের একটি রিপোর্টে জানা যায় —” স্বাধীনতার পর খনি ও শিল্প কলকারখানা গড়তে ভারতে যত হেক্টর অরন্য ধ্বংস হয়েছে তার 69% হলো আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলি থেকে আদিবাসীদের বেআইনি ও অমানবিক ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে।” তাই পরিবেশবিধ বিশ্বনাথ মুর্মু দুঃখ করে বলেছেন –” আদিবাসীদের দুর্ভাগ্য যে, তাদের বসবাসের জায়গাতেই বালি, পাথর, কয়লা, অভ্র, কাঠ পাওয়া যায়।” তাই বাবাসাহেব ডঃ বি. আর. আম্বেদকর গভীর দূরদৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন যে, উচ্চবর্ণের শাসক ও শোষকের দ্বারা ভবিষ্যতে আদিবাসীদের উপর নির্মম শোষন-বঞ্চনা ও অত্যাচার নেমে আসবে, তাঁদের জমি কেড়ে নেওয়া হবে। তাই তিনি সংবিধানে আদিবাসীদের রক্ষাকবচ হিসাবে শক্ত-পোক্ত আইন তৈরি করে গিয়েছিলেন। কিন্তু বর্ণবাদী গোষ্ঠী সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আদিবাসীদের সর্বশান্ত করে চলেছে। ড. বি. আর. আম্বেদকর সংবিধানের “পঞ্চম তফসিলে”র 2-এর (ক), (খ), (গ) নং ধারায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন যে– “আদিবাসীদের ভূমি অ-আদিবাসী কেউ হস্তান্তর করতে পারবেনা। খনি, শিল্প- কলকারখানা, পার্ক, উদ্যানের নামেও অধিগ্রহণ করা যাবে না। এমনকি রাষ্ট্রের উন্নয়নশীল কাজের নাম করে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া যাবে না ” (পঞ্চম তফসিল, 2- এর খ নং ধারা )। 2-এর (ক) নং ধারায় বলা হয়েছে– “অরন্য ও অরন্যজাত সম্পদের অধিকার আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে তাঁদের কোনরূপ বঞ্চিত করা যাবে না।কেউ বঞ্চিত করতে চাইলে রাষ্ট্র তাঁদের এই অধিকার সুরক্ষা করবে”। পঞ্চম তফসিলের 2-এর (ক) নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে —” আদিবাসীরা যেখানে যে বসবাস করছেন, সেখানে সে জমির মালিক বলে গন্য হবে এবং তাঁদের জমির মালিকানা সত্তা দিতে হবে “। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হলো রাষ্ট্র তাঁদের সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে সব কেড়ে নিচ্ছে সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। ড. আম্বেদকর “জাতীয় খনি ট্রাইব্যুনাল” আইনে আরো উল্লেখ করেছেন —
(1) আদিবাসী অঞ্চলে খনি ও কলকারখানা গড়ে তুলতে হলে আগে তাঁদের উপযুক্ত পুনর্বাসন ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
(2) উক্ত খনি বা কলকারখানার 26% মালিকানা স্থানীয় মানুষকে দিতে হবে।
(3) পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয় মানুষদের উক্ত খনি ও কলকারখানায় 40% চাকুরী সুনিশ্চিত করতে হবে।
(4) আদিবাসী অঞ্চলে জমি দখলের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগে গ্রামসভার সাথে আলোচনা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(5) কলকারখানা ও খনি অঞ্চলের রাস্তাঘাট স্থানীয় উন্নয়নে জোর দিতে হবে, ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই আইন গুলির কিছুই মানা হচ্ছে কী ? ফলে দেখা যাচ্ছে 72% আদিবাসী দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে (2015 সালের কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রাম-উন্নয়ন ও সমাজ কল্যান বিভাগের রিপোর্ট), ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া অধিকাংশ আদিবাসী পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়নি, স্থানীয় খনি ও কলকারখানায় 1% আদিবাসীকেও কাজ দেওয়া হয়নি — আর যে সামান্য সংখ্যক আদিবাসী কাজ পেয়েছে তাঁদের বেতন দিনে 80 থেকে 100 টাকা মাত্র।

 


তাই গত 13 ফেব্রুয়ারির এই ভয়ংকর রায়ের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে সমস্ত আদিবাসী, মূলনিবাসী, বহুজনকে পথে নামতে হবে। এই অমানবিক রায়কে যদি পরিবর্তন করা না হয় তবে স্তব্ধ করে দিতে হবে সারা ভারতবর্ষকে তথা মনুবাদীদের শোষনের যন্ত্রকে। সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও বন্ধু। তোমরা বীর-বিপ্লবী সিঁদু-কানু, বীরসা মুন্ডা, তিলকা মাঝির সন্তান — তাঁরা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন।।
(লেখক — প্রশান্ত রায়)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.