শ্যামল নাইয়া খাইরুল আনাম (শিকাগো)

Spread the love

শ্যামল নাইয়া (অনুগল্প)
-খায়রুল আনাম

নামে শ্যামল হলেও, ওর নামের সঙ্গে গায়ের রঙের কোন মিল ছিল না। ধবধবে না হলেও, শ্যামলা তাকে কোনমতেই বলা যেত না। শুধু কি তাই? বয়সের তুলনায় তার চেহারাটাও ছিল দশাসই। আমরা যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখনই সে ক্লাসের ছেলেদের চেয়ে মাথায় ছ’ইঞ্চি লম্বা ছিল। বুকের ছাতিও ছিল সবার চেয়ে চওড়া। দেখে মনে হতো যেন একটা পাথরে খোদাই করা চেহারা। ওই বয়সে পাথরে খোদাই করা চেহারা কেমন হয় তা অবশ্য জানা ছিল না। বস্তুত নামও শুনিনি!

এ হেন গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজনের কেমন করে যে আমার মতো সত্যিকারের শ্যামলা, বেঁটে, লিকপিকের সঙ্গে ভাব হয়েছিল, তা খোদায় মালুম। শুধু ভাব না। আমার উপর তার যে একটা মায়া ছিল, তা বেশ বুঝতে পারতাম। চেহারার সুবিধার জন্যই হোক বা কুশলতার কারণেই হোক, ক্লাসের ফুটবল খেলায় সে ছিল সবার চেয়ে পটু। ‘পাস’ করার সময় কেউ তার কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নিতে পারত না। আর উল্টোটা ছিলুম আমি। যে আমার কাছে আসত, সেই আমার থেকে বল কেড়ে নিয়ে চলে যেত। আমার অবস্থা দেখে প্রতিদিন টিফিনের সময়, শ্যামল আমাকে নিয়ে ফুটবল খেলত। কোন আপত্তিই শুনত না। বুঝতে পারতাম ও আসলে তালিম দিয়ে আমার দৈন্যতা ঘোচাবার চেষ্টা করত।

ক্লাস সেভেনে ওঠার পর বছরের মাঝামাঝি শ্যামল হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল। আর কোনদিন স্কুলের ত্রিসীমানায় ফিরে আসতে কেউ দেখেনি। ইতিমধ্যে আমরা হাই স্কুল পাস দিয়ে কলেজে ভর্তিও হয়ে গেছি। কলেজে ক্লাস আরম্ভ হওয়ার দু’দিন আগে ফুটবল ম্যাচে খুব জোরে একটা শট করার সময় একটা ইটের টুকরোয় আমার ডানপায়ে ভীষণ চোট লাগে। কলেজে যাবার প্রথম দিনে রেল স্টেশন থেকে কলেজ পর্য্যন্ত অতটা রাস্তা কি করে হেঁটে যাব চিন্তায় অস্থির। মা পকেটে দু’টো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “চিন্তা কো’রনা, রিক্সায় চলে যেও। এতে চারদিন চলবে। ততদিনে পা ভালো হয়ে যাবে”।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের পেছনে আসতেই সবাই একসঙ্গে হেঁকে উঠল, “বাবু আসুন, আমারটাতে আসুন, আমারটাতে আসুন”। ওর মধ্যে একজন বলে উঠল, “এই যে মহিমবাবু, মহিম বাবু, আপনি আমারটাতে আসুন”। কি মুস্কিল! এই রিক্সাওয়ালাটা আবার আমার নাম জানল কি করে? তার দিকে ফিরে তাকিয়ে আমার চক্ষু তো ছানাবড়া। আরে, ও তো আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, আমাকে অনেক আদর করা সেই শ্যামল নাইয়া!

সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের উপর থেকে নীচ পর্য্যন্ত যেন একটা হিমপ্রবাহ বয়ে গেল। আমার চেয়ে অনেক গুণের অধিকারী সেই ছেলেটার মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এই অবস্থা হয়েছে? সে আমাকে বাবু বলে ডাকছে? কি লজ্জা। আমি কি করে তার রিক্সায় বাবু হয়ে চড়ে বসব আর আমার একসময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু এখন রিক্সাচালক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আমাকে কলেজে নিয়ে যাবে? যদিও জানি উপায়টা তার বড় দরকার, কিন্তু আমি কি করে……ছি ছি।

একটু থেমে ওর চোখে চোখ পড়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ি, এমন ভাবে চোখ নামিয়ে নীচুস্বরে বলি, “না লাগবে না”।
তারপর, মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তৈমুর লং-এর মতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে কলেজের পথে ধাবিত হই।
( শিকাগো )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.